শেষ কথা– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর– চতুর্থ অংশ

দিনের আলো প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এইবার অচিরার ঘরে ফেরবার সময়, কিংবা ওর দাদামশায় এসে ওকে বেড়াতে নিয়ে যাবেন। এমন সময়ে একজন হিন্দুস্থানী গোঁয়ার এসে অচিরার হাত থেকে হঠাৎ তার ব্যাগ আর ডায়ারিটা ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছিল, আমি সেই মুহূর্তেই বনের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বললুম, “কোনো ভয় নেই আপনার।”— এই ব’লে ছুটে সেই লোকটার ঘাড়ের উপর গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেই সে ব্যাগ আর খাতা ফেলে দৌড় মারলে। আমি লুঠের ধন নিয়ে এসে অচিরাকে দিলুম।

অচিরা বললে, “ভাগ্যিস আপনি—”

আমি বললুম, “আমার কথা বলবেন না, ভাগ্যিস ও লোকটা এসেছিল।”

“তার মানে? ”

“তার মানে, ওরই সাহায্যে আপনার সঙ্গে প্রথম কথাটা হয়ে গেল। এতদিন কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলুম না, কী যে বলি।”

“কিন্তু ও যে ডাকাত।”

“না, ও ডাকাত নয়, ও আমার বরকন্দাজ।”

অচিরা মুখে তার খয়েরী রঙের আঁচল তুলে ধ’রে খিল্‌খিল্‌ করে হেসে উঠল। কী মিষ্টি তার ধ্বনি, যেন ঝর্‌নার স্রোতে নুড়ির সুরওয়ালা শব্দ।

হাসি থামতেই বললে, “কিন্তু সত্যি হলে খুব মজা হত।”

“মজা হত কার পক্ষে।”

“যাকে নিয়ে ডাকাতি তার পক্ষে। এইরকম যে একটা গল্প পড়েছি।”

“তার পরে উদ্ধারকর্তার কী হত।”

“তাকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে চা খাইয়ে দিতুম।”

“আর এই ফাঁকি উদ্ধারকর্তার কী হবে।”

“তার তো আর-কিছুতে দরকার নেই। সে তো আলাপ করবার প্রথম কথাটা চেয়েছিল— পেয়েছে দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ পঞ্চম কথা।”

“গণিতের সংখ্যাগুলো হঠাৎ ফুরোবে না তো।”

“কেন ফুরোবে।”

“আচ্ছা, আপনি হলে আমাকে প্রথম কথাটা কী বলতেন।”

“আমি হলে বলতুম, রাস্তায় ঘাটে কতকগুলো নুড়ি কুড়িয়ে কী ছেলেমানুষি করছেন। আপনার কি বয়স হয় নি।”

“কেন বলেন নি।”

“ভয় করেছিল।”

“ভয়? আমাকে ভয়? ”

“আপনি যে বড়ো লোক। দাদুর কাছে শুনেছি। তিনি যে আপনার লেখা প্রবন্ধ বিলিতি কাগজে পড়েছিলেন। তিনি যা পড়েন আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করেন।”

“এটাও করেছিলেন? ”

“হাঁ, করেছিলেন। কিন্তু লাটিন নামের পাহারার ঘটা দেখে জোড়হাত ক’রে বলেছিলুম, দাদু, এটা থাক্‌, বরঞ্চ তোমার কোয়ন্টম থিয়োরির বইখানা নিয়ে আসি।”

“সেটা বুঝি আপনি বুঝতে পারেন? ”

“কিছুমাত্র না। কিন্তু দাদুর একটা বদ্ধ সংস্কার আছে— সবাই সব-কিছুই বুঝতে পারে। তাঁর সে বিশ্বাস ভাঙতে আমার ভালো লাগে না। তাঁর আর-একটা আশ্চর্য ধারণা আছে— মেয়েদের সহজবুদ্ধি পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি তীক্ষ্ম। তাই ভয়ে ভয়ে আছি এইবার নিশ্চয়ই ‘টাইম-স্পেস’-এর জোড়-মেলানো সম্বন্ধের ব্যাখ্যা আমাকে শুনতে হবে। আসল কথা, মেয়েদের উপর তাঁর করুণার অন্ত নেই। দিদিমা যখন বেঁচে ছিলেন, বড়ো বড়ো কথা পাড়লেই তিনি মুখ বন্ধ করে দিতেন। তাই মেয়েদের তীক্ষ্ম বুদ্ধি যে কতদূর যেতে পারে, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ দিদিমার কাছ থেকে পান নি। আমি ওঁকে হতাশ করতে পারব না। অনেক শুনেছি, বুঝি নি, আরো অনেক শুনব আর বুঝব না।”

অচিরার দুই চোখ কৌতুকে স্নেহে জ্বল্‌জ্বল্‌ ছল্‌ছল্‌ করে উঠল। ইচ্ছে করছিল, স্নিগ্ধ কণ্ঠের এই আলাপ শীঘ্র যেন শেষ হয়ে না যায়। দিনের আলো ম্লান হয়ে এলে। সন্ধ্যার প্রথম তারা জ্বলে উঠেছে শালবনের মাথার উপরে। সাঁওতাল মেয়েরা জ্বালানি-কাঠ সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছে ঘরে, দূর থেকে শোনা যাচ্ছে তাদের গান।

এমন সময় বাইরে থেকে ডাক এল, “দিদি, কোথায় তুমি। অন্ধকার হয়ে এল যে। আজকাল সময় ভালো নয়।”

“ভালো তো নয়ই দাদু, তাই একজন রক্ষাকর্তা নিযুক্ত করেছি।”

অধ্যাপক আসতেই তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করলুম। তিনি শশব্যস্ত হয়ে উঠলেন। পরিচয় দিলুম, “আমার নাম নবীনমাধব সেনগুপ্ত।”

বৃদ্ধের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বললেন, “বলেন কী, আপনিই ডাক্তার সেনগুপ্ত? আপনি তো ছেলেমানুষ।”

আমি বললুম, “নিতান্ত ছেলেমানুষ। আমার বয়স ছত্রিশের বেশি নয়।”

আবার অচিরার সেই কলমধুর কণ্ঠের হাসি, আমার মনে যেন দুনো লয়ের ঝংকারে সেতার বাজিয়ে দিলে। বললে, “দাদুর কাছে পৃথিবীর সবাই ছেলেমানুষ, আর দাদু হচ্ছেন সকল ছেলেমানুষের আগরওয়ালা।”

অধ্যাপক বললেন, “আগরওয়ালা? একটা নতুন শব্দ বাংলায় আমদানি করলে। কোথা থেকে জোটালে।”

“সেই যে তোমার ভালোবাসার মাড়োয়ারি ছাত্র, কুন্দনলাল আগরওয়ালা; আমাকে এনে দিত বোতলে করে আমের চাটনি; আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলুম, আগরওয়ালা কাথাটার মানে কী। সে বলেছিল, পায়োনিয়র।”

অধ্যাপক বললেন, “ডাক্তার সেনগুপ্ত, আপনার সঙ্গে আলাপ হল যদি, আমাদের ওখানে যেতে হবে তো।”

“কিচ্ছু বলতে হবে না, দাদু। যাবার জন্যে লাফালাফি করছেন। আমার কাছে শুনেছেন, দেশকালের একজোট তত্ত্ব নিয়ে তুমি ব্যাখ্যা করবে আইন্‌স্টাইনের কাঁধে চ’ড়ে।”

মনে মনে বললুম, ‘সর্বনাশ। কী দুষ্টুমি।’

অধ্যাপক অত্যন্ত উৎসাহিত হয়ে বললেন, “আপনার বুঝি ‘টাইম্‌-স্পেস’-এর—”

আমি ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলুম, “কিচ্ছু বুঝি নে ‘টাইম্‌-স্পেস’-এর। আমাকে বোঝাতে গেলে আপনার সময় নষ্ট হবে মাত্র।”

বৃদ্ধ ব্যগ্র হয়ে বলে উঠলেন, “সময়! এখানে সময়ের অভাব কোথায়। আচ্ছা, এক কাজ করুন-না, আজকে নাহয় আমাদের ওখানে আহার করবেন, কী বলেন।”

আমি লাফ দিয়ে বলতে যাচ্ছিলুম, “এখ্‌খনি।”

গল্পের পঞ্চম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

দুঃখিত!