শেষ কথা– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর– প্রথম অংশ

জীবনের প্রবহমান ঘোলা রঙের হ-য-ব-র-লর মধ্যে হঠাৎ যেখানে গল্পটা আপন রূপ ধরে সদ্য দেখা দেয়, তার অনেক পূর্ব থেকেই নায়কনায়িকারা আপন পরিচয়ের সূত্র গেঁথে আসে। পিছন থেকে সেই প্রাক্‌গাল্পিক ইতিহাসের ধারা অনুসরণ করতেই হয়। তাই কিছু সময় নেব, আমি যে কে সেই কথাটাকে পরিষ্কার করবার জন্যে। কিন্তু নামধান ভাঁড়াতে হবে। নইলে জানাশোনা মহলের জবাবদিহি সামলাতে পারব না। কী নাম নেব তাই ভাবছি, রোম্যাণ্টিক নামকরণের দ্বারা গোড়া থেকেই গল্পটাকে বসন্তরাগে পঞ্চমসুরে বাঁধতে চাই নে। নবীনমাধব নামটা বোধ হয় চলে যেতে পারবে, ওর বাস্তবের শাম্‌লা রঙটা ধুয়ে ফেলে করা যেতে পারত নবারুণ সেনগুপ্ত; কিন্তু তা হলে খাঁটি শোনাত না, গল্পটা নামের বড়াই ক’রে লোকের বিশ্বাস হারাত, লোকে মনে করত ধার-করা জামিয়ার প’রে সাহিত্যসভায় বাবুয়ানা করতে এসেছে।

আমি বাংলাদেশের বিপ্লবীদলের একজন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মহাকর্ষশক্তি আন্ডামানতীরের খুব কাছাকাছি টান মেরেছিল। নানা বাঁকা পথে সি.আই.ডি.-র ফাঁস এড়িয়ে এড়িয়ে গিয়েছিলুম আফগানিস্তান পর্যন্ত। অবশেষে পৌঁচেছি আমেরিকায় খালাসির কাজ নিয়ে। পূর্ববঙ্গীয় জেদ ছিল মজ্জায়, একদিনও ভুলি নি যে, ভারতবর্ষের হাতপায়ের শিকলে উখো ঘষতে হবে দিনরাত যতদিন বেঁচে থাকি। কিন্তু বিদেশে কিছুদিন থাকতেই একটা কথা নিশ্চিত বুঝেছিলুম, আমরা যে প্রণালীতে বিপ্লবের পালা শুরু করেছিলুম, সে যেন আতশবাজিতে পটকা ছোঁড়ার মতো, তাতে নিজের পোড়াকপাল পুড়িয়েছি অনেকবার, দাগ পড়ে নি ব্রিটিশ রাজতক্তে। আগুনের উপর পতঙ্গের অন্ধ আসক্তি। যখন সদর্পে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছিলুম তখন বুঝতে পারি নি, সেটাতে ইতিহাসের যজ্ঞানল জ্বালানো হচ্ছে না, জ্বালাচ্ছি নিজেদের খুব ছোটো ছোটো চিতানল। ইতিমধ্যে য়ুরোপীয় মহাসমরের ভীষণ প্রলয়রূপ তার অতি বিপুল আয়োজন সমেত চোখের সামনে দেখা দিয়েছিল— এই যুগান্তরসাধিনী সর্বনাশাকে আমাদের খোড়োঘরের চণ্ডীমণ্ডপে প্রতিষ্ঠা করতে পারবে সে দুরাশা মন থেকে লুপ্ত হয়ে গেল; সমারোহ ক’রে আত্মহত্যা করবার মতোও আয়োজন ঘরে নেই। তখন ঠিক করলুম, ন্যাশনাল দুর্গের গোড়া পাকা করতে হবে। স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলুম, বাঁচতে যদি চাই আদিম যুগের হাত দুখানায় যে কটা নখ আছে তা দিয়ে লড়াই করা চলবে না। এ যুগে যন্ত্রের সঙ্গে যন্ত্রের দিতে হবে পাল্লা; যেমন-তেমন করে মরা সহজ, কিন্তু বিশ্বকর্মার চেলাগিরি করা সহজ নয়। অধীর হয়ে ফল নেই, গোড়া থেকেই কাজ শুরু করতে হবে— পথ দীর্ঘ, সাধনা কঠিন।

দীক্ষা নিলুম যন্ত্রবিদ্যায়। ডেট্রয়েটে ফোর্ডের মোটর-কারখানায় কোনোমতে ঢুকে পড়লুম। হাত পাকাচ্ছিলুম, কিন্তু মনে হচ্ছিল না খুব বেশি দূর এগোচ্ছি। একদিন কী দুর্বুদ্ধি ঘটল, মনে হল, ফোর্ডকে যদি একটুখানি আভাস দিই যে, আমার উদ্দেশ্য নিজের উন্নতি করা নয়, দেশকে বাঁচানো, তা হলে স্বাধীনতাপূজারী আমেরিকার ধনসৃষ্টির জাদুকর বুঝি খুশি হবে, এমন-কি, আমার রাস্তা হয়তো করে দেবে প্রশস্ত। ফোর্ড চাপা হাসি হেসে বললে ‘আমার নাম হেন্‌রি ফোর্ড, পুরাতন ইংরেজি নাম। আমাদের ইংলণ্ডের মামাতো ভাইরা অকেজো, তাদের আমি কেজো করব— এই আমার সংকল্প।’ আমি ভেবেছিলুম, ভারতীয়কেও কেজো ক’রে তুলতে উৎসাহ হতেও পারে। একটা কথা বুঝতে পারলুম, টাকাওয়ালার দরদ টাকাওয়ালাদেরই ’পরে। আর দেখলুম, এখানে চাকাতৈরির চক্রপথে শেখা বেশি দূর এগোবে না। এই উপলক্ষে একটা বিষয়ে চোখ খুলে গেল, সে হচ্ছে এই যে যন্ত্রবিদ্যাশিক্ষার আরো গোড়ায় যাওয়া চাই; যন্ত্রের মালমসলা-সংগ্রহ শিখতে হবে। ধরণী শক্তিমানদের জন্যে জমা করে রেখেছেন তাঁর দুর্গম জঠরে কঠিন খনিজ পদার্থ, এই নিয়ে দিগ্‌‌‍বিজয় করেছে তারা, আর গরিবদের জন্যে রয়েছে তার উপরের স্তরে ফসল— হাড় বেরিয়েছে তাদের পাঁজরায়, চুপসে গেছে তাদের পেট।

আমি লেগে গেলুম খনিজবিদ্যা শিখতে। ফোর্ড বলেছে ইংরেজ অকেজো, তার প্রমাণ হয়েছে ভারতবর্ষে— একদিন হাত লাগিয়েছিল তারা নীলের চাষে আর-একদিন চায়ের চাষে— সিবিলিয়ানের দল দপ্তরখানায় তকমাপরা ‘ল অ্যাণ্ড অর্ডর’-এর ব্যবস্থা করেছে, কিন্তু ভারতের বিশাল অন্তর্ভাণ্ডারের সম্পদ উদ্‌ঘাটিত করতে পারে নি, কী মানবচিত্তের কী প্রকৃতির। বসে বসে পাটের চাষীর রক্ত নিংড়েছে। জামশেদ টাটাকে সেলাম করেছি সমুদ্রের ওপার থেকে। ঠিক করেছি আমার কাজ পটকা ছোঁড়া নয়। সিঁধ কাটতে যাব পাতালপুরীর পাথরের প্রাচীরে। মায়ের আঁচলধরা বুড়ো খোকাদের দলে মিশে ‘মা মা’ ধ্বনিতে মন্তর পড়ব না, আর দেশের দরিদ্রকে অক্ষম অভুক্ত অশিক্ষিত দরিদ্র বলেই মানব, ‘দরিদ্রনারায়ণ’ বুলি দিয়ে তার নামে মন্তর বানাব না। প্রথম বয়সে এরকম বচনের পুতুলগড়া খেলা অনেক খেলেছি— কবিদের কুমোরবাড়িতে স্বদেশের যে রাংতা-লাগানো প্রতিমা গড়া হয়, তারই সামনে বসে বসে অনেক চোখের জল ফেলেছি। কিন্তু আর নয়, এই জাগ্রত বুদ্ধির দেশে এসে বাস্তবকে বাস্তব বলে জেনেই শুকনো চোখে কোমর বেঁধে কাজ করতে শিখেছি। এবার গিয়ে বেরিয়ে পড়বে এই বিজ্ঞানী বাঙাল কোদাল নিয়ে কুড়ুল নিয়ে হাতুড়ি নিয়ে দেশের গুপ্তধনের তল্লাসে, এই কাজটাকে কবির গদ্‌গদকণ্ঠের চেলারা দেশমাতৃকার পূজা বলে চিনতেই পারবে না।

ফোর্ডের কারখানাঘর ছেড়ে তার পরে ন’বছর কাটিয়েছি খনিবিদ্যা খনিজবিদ্যা শিখতে। য়ুরোপের নানা কেন্দ্রে ঘুরেছি, হাতেকলমে কাজ করেছি, দুই-একটা যন্ত্রকৌশল নিজেও বানিয়েছি— তাতে উৎসাহ পেয়েছি অধ্যাপকদের কাছে, নিজের উপরে বিশ্বাস হয়েছে, ধিক্‌কার দিয়েছি ভূতপূর্ব মন্ত্রমুগ্ধ অকৃতার্থ নিজেকে।

আমার ছোটোগল্পের সঙ্গে এই-সব বড়ো বড়ো কথার একান্ত যোগ নেই— বাদ দিলে চলত, হয়তো ভালোই হত। কিন্তু এই উপলক্ষে একটা কথা বলার দরকার ছিল, সেটা বলি। যৌবনের গোড়ার দিকে নারীপ্রভাবের ম্যাগ্‌নেটিজ্‌মে জীবনের মেরুপ্রদেশের আকাশে যখন অরোরার রঙিন ছটার আন্দোলন ঘটতে থাকে, তখন আমি ছিলুম অন্যমনস্ক, একেবারে কোমর বেঁধে অন্যমনস্ক। আমি সন্ন্যাসী, আমি কর্মযোগী— এই-সব বাণীর দ্বারা মনের আগল শক্ত করে আঁটা ছিল। কন্যাদায়িকরা যখন আশেপাশে আনাগোনা করেছিল, আমি স্পষ্ট করেই বলেছি, কন্যার কুষ্ঠিতে যদি অকালবৈধব্যযোগ থাকে, তবেই যেন কন্যার পিতা আমার কথা চিন্তা করেন।

পাশ্চাত্য মহাদেশে নারীসঙ্গ ঠেকাবার বেড়া নেই। সেখানে আমার পক্ষে দুর্যোগের বিশেষ আশঙ্কা ছিল; আমি যে সুপুরুষ, দেশে থাকতে নারীদের মুখে সে কথা চোখের মৌন ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় শোনবার সম্ভাবনা ছিল না, তাই এ তথ্যটা আমার চেতনার বাইরে পড়ে ছিল। বিলেতে গিয়ে যেমন আবিষ্কার করেছি সাধারণের তুলনায় আমার বুদ্ধি বেশি আছে, তেমনি ধরা পড়েছিল আমাকে দেখতে ভালো। আমার এদেশী পাঠকদের মনে ঈর্ষা জন্মাবার মতো অনেক কাহিনীর ভূমিকা দেখা দিয়েছিল, কিন্তু হলফ করে বলছি,আমি তাদের নিয়ে ভাবের কুহকে মনকে জমাট বাঁধতে দিই নি। হয়তো আমার স্বভাবটা কড়া, পশ্চিমবঙ্গের শৌখিনদের মতো ভাবালুতায় আর্দ্রচিত্ত নই; নিজেকে পাথরের সিন্ধুক করে তার মধ্যে আমার সংকল্পকে ধরে রেখেছিলুম। মেয়েদের নিয়ে রসের পালা শুরু করে তার পরে সময় বুঝে খেলা ভঙ্গ করা; সেও ছিল আমার প্রকৃতিবিরুদ্ধ, আমি নিশ্চয় জানতুম, যে জেদ নিয়ে আমি আমার ব্রতের আশ্রয়ে বেঁচে আছি, এক-পা ফসকালে সেই জেদ নিয়েই আমার ভাঙা ব্রতের তলায় পিষে মরতে হবে। আমার পক্ষে এর মাঝখানে কোনো ফাঁকির পথ নেই। তা ছাড়া আমি জন্মপাড়াগেঁয়ে, মেয়েদের সম্বন্ধে আমার সেকেলে সংকোচ ঘুচতে চায় না। তাই মেয়েদের ভালোবাসা নিয়ে যারা অহংকারের বিষয় করে, আমি তাদের অবজ্ঞা করি।

বিদেশী ভালো ডিগ্রিই পেয়েছিলুম। সেটা এখানে সরকারী কাজে লাগবে না জেনে ছোটোনাগপুরে চন্দ্রবংশীয় এক রাজার— মনে করা যাক, চণ্ডবীর সিংহের দরবারে কাজ নিয়েছিলুম। সৌভাগ্যক্রমে তাঁর ছেলে দেবিকাপ্রসাদ কিছুদিন কেম্‌ব্রিজে পড়াশুনা করেছিলেন।

গল্পের দ্বিতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!