শেয়াল রাজার সাজা

শিশু-কিশোর বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই শুনেছো কিংবা পাঠ্য বইয়ে পড়েছো যে, ‘সহজেই তরুলতা, পশু-পাখি সহজেই পশু-পাখি। কিন্তু মানুষ অতি কষ্টে মানুষ।’ মানুষ অনেক কষ্ট কোরে এবং বিবেক বুদ্ধি খাটিয়ে পথ চলে বলেই মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব বলা হয়। তবে অনেক মানুষ আছে যারা তার সৃষ্টি উদ্দেশ্য বুঝে না, স্রষ্টাকে ভয় করে না এবং অসৎ পথে জীবন পরিচালনা করে তারা পশুর চেয়েও অধম। তাদের কারণেই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে। এসব মানুষ যেন পশুত্বকে বর্জন করে প্রকৃত মানুষ হতে পারে সে কামনা করে শুরু করছি আজকের আসর। আজকের অনুষ্ঠানের শুরুতেই থাকবে একটি গল্প। আর গল্প শেষে থাকবে এক নতুন বন্ধুর সাক্ষাৎকার। আশা করি আমাদের আজকের আয়োজনও তোমাদের ভাল লাগবে।

এক গ্রামের পাশে ছিল ছোট্ট একটা বন। সেই বনে ছিল নানা জাতের পাখি, বানর, বনবিড়াল, বনমোরগ, খরগোশ আর দু’চারটে সাপ। অন্য বনের মতো সেখানে বাঘ, সিংহ না থাকায় কোনো রাজাও ছিল না। সবাই সবার ইচ্ছে মতো চলত। ভালোই কেটে যাচ্ছিল বনবাসীদের জীবন।

এক সকালে কোথা থেকে এক শেয়াল এল সেই বনে। এসেই নাক সিঁটকে বলল,
শেয়াল: ধ্যাত! কোথায় এসে পড়লাম? এখানে তো মান-সম্মান নিয়ে থাকা যাবে না। এটা আবার বন হলো নাকি?

শেয়াল একটা ডুমুর গাছের নিচে দাঁড়িয়ে এসব কথা বলছিল। সেই গাছে বসে ডুমুর খাচ্ছিল ছোট্ট একটা বানর। শিয়ালের কথা শুনে সে বলল,
বানর: আমাদের এ বনটা পছন্দ হচ্ছে না বুঝি? তুমি কে হে? কোথা থেকে এসেছো?

শেয়াল: আগে তোর পরিচয় দে। তুই কে?
বানর: আমি মানে.. আমার নাম টুকু। এই বনেই জন্ম হয়েছে- এই বনেই বেড়ে উঠছি। তা তুমি কে? কখনো দেখিনি তো তোমাকে।

শেয়াল: তুই তো এক ছোট্ট বানর। তোর কাছে পরিচয় দিলে মান-সম্মান থাকবে না। তুই বরং তোদের রাজাকে ডেকে আন। তার কাছেই সব বলবো।
বানর: আমাদের তো কোনো রাজা-টাজা নেই। আমরা সবাই রাজা।

শেয়াল: ও বুঝতে পেরেছি। তার মানে এই বনে কোনো আইন-শৃঙ্খলা নেই। মান্যগণ্য নেই। সবাইকে তোরা সমান ভাবিস। এটা ভালো কথা নয়। তোদের একজন রাজা থাকা খুবই দরকার।
বানর: তাহলে আমি এক কাজ করি। বনের সবাইকে ডেকে জড়ো করি। তুমি তাদের কাছে এসব কথা বলো।

শেয়াল: ভালো কথাই বলেছিস। তবে যা, সবাইকে ডেকে জড়ো কর। বল, শেয়াল সাহেব ডেকেছেন। জরুরি সভা হবে।

বানরের ডাকে সাড়া দিয়ে বনের ভেতরের পুকুর পাড়ে এসে হাজির হলো সাপ, ব্যাঙ, খরগোশ, বেজি আর ইঁদুররা। গাছের ওপর বসল পাখি, প্রজাপতি আর বানরের দল। সবাই বসার পর হেলে দুলে শেয়াল এসে বসল একটা উঁচু ঢিবির ওপর। তারপর বলল,
শেয়াল: আমি এই বনে নতুন এসেছি।

এসেই দেখতে পেলাম এখানে কেন উন্নত শ্রেণীর প্রাণী নেই। সবাই নিজ নিজ ইচ্ছে মতো চলে। এটা ভালো কথা নয়। শেয়ালের কথা শুনে একটা বুড়ো বানর খক্‌খক্‌ করে কাশতে কাশতে বলল:
বুড়ো বানর: কে বললো ভালো কথা নয়? আমরা খিদে লাগল ফুল-ফুল পেড়ে খাচ্ছি, কিচির-মিচির করে খেলছি, ঘুম পেলে ঘুমোচ্ছি। কোনো সমস্যা তো হচ্ছে না। এ বনে সবাই স্বাধীন। আর এটাই এ বনের বৈশিষ্ট্য।

শেয়াল বললো,
শেয়াল: বুঝলাম তোমার কথা। কিন্তু সব বনেই একজন রাজা থাকেন। তিনি প্রজাদের শাসন করেন আর আপদে-বিপদে পাশে গিয়ে দাঁড়ান। তোমাদের কোনো রাজা নেই। এটা তো খুব লজ্জার কথা। ঝটপট একজন রাজা ঠিক করে নাও।

বুড়ো বানর জবাব দিল,
বুড়ো বানর: আমি যতোটুকু জানি সিংহকে বনের রাজা বলা হয়। সিংহ না থাকলে বাঘ মামাকে সবাই মিলে রাজা করে নেয়। আমাদের এই বনে তো উনারা নেই। কাকে রাজা বানাবো?

এ কথা শুনে শেয়াল বললো,
শেয়াল: এটা একটা সমস্যা বটে। তবে সমস্যা যেমন আছে তেমন তার সমাধানও আছে। বাঘ নেই সিংহ নেই বলে কি এ বনটা উচ্ছন্নে যাবে? তা তো হতে দেয়া যায় না। শোনো- আমি যখন এসেই পড়েছি, তাই বলছিলাম কি- তোমরা রাজি হলে আমিই বনের শাসনভার নিজের কাঁধে তুলে নেবো। ভারটা বইতে যদিও অনেক কষ্ট হবে কিন্তু উপায়ও তো নেই। তোমাদের মুখের দিকে চেয়ে আমিই তোমাদের রাজা হতে চাই।

বুড়ো বানর বললো,
বুড়ো বানর: আচ্ছা, মেনে নিলাম। আজ থেকে তুমি আমাদের রাজা। আমরা তোমার কথা মেনে চলবো।

ব্যস, সেই থেকে শেয়াল হয়ে গেলো বনের রাজা। রাজা হয়েই শেয়াল বনের সব নিয়মকানুন বদলে দিল। সাত সকালে পাখিরা কিচির মিচির করতে পারবে না। বানররা পাঁচটার বেশি ডুমুর খেতে পারবে না। সাপেরা ফোঁস ফোঁস করতে পারবে না- এমন সব অদ্ভুত আইন। মোট কথা, দুষ্টু শেয়াল দু’দিনেই সবার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলল।

কিন্তু শেয়াল রাজার অত্যাচার মেনে নিতে আপত্তি করতে পারছে না কেউ। রাজার আদেশ যতোই অদ্ভুত আর কড়া হোক, মেনে চলতে তো হবে এটাইতো দুনিয়ার নিয়ম। কিন্তু একদিন শেয়াল যখন বললো রোজ তাকে দুটো করে বনমোরগ খেতে হবে, তখন সবার মনখারাপ হয়ে গেলো। প্রথম প্রতিবাদ করলো ছোট বানর। সে বললো,
বানর: শেয়াল রাজার এ আদেশ আমরা মানবো না। বনমোরগদের সাথে আমরা মিলে মিশে বড়ো হয়েছি। ওদের আমরা শিয়ালের মুখে তুলে দিতে পারবো না।

বনের সবাই বানরের কথার সাথে একমত হলো। কিন্তু শেয়াল রাজার হাত থেকে মুক্তির উপায় কারো জানা ছিল না। হুতুম প্যাঁচা একটা উপায় বের করার জন্য সাতদিন সময় চাইল। কিন্তু সাত দিন সময় দিতে রাজি হলো ছোট্ট বানর। সে বলল,
বানর: তোমার আর ভেবে দরকার নেই প্যাঁচা দাদু। শেয়ালকে তাড়াবার বুদ্ধি আমি পেয়ে গেছি। তোমরা শুধু ধৈর্য ধরে দেখো আমি কি করি।

বানরের কথায় সবাই আশ্বস্ত হল। বানর তখনই ছুটে গেল মৌমাছিদের কাছে। মৌমাছিদের কাছে গিয়ে বললো,
বানর: তোমরা তো জানো, কোথা থেকে এক শেয়াল এসে আমাদের রাজা সেজেছে। শেয়াল রাজার অত্যাচারে জীবনটা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আমরা এখন ওকে এ বন থেকে তাড়াতে চাই। তোমরা কি কোনো সাহায্য করতে পারবে?

মৌমাছিরা বললো,
মৌমাছি: পারবো। আমরা ওকে হুল ফুটিয়ে পাগল করে ছাড়বো। তবে সবুজ গ্রামের কুকুরদের সাহায্য পেলে কাজটা আরো সহজ হবে। তুমি কুকুরদের কাছে যাও। অন্য বানরদের সঙ্গে কুকুরদের যেমন সম্পর্কই থাক, ছোট্ট বানর টুকুর সঙ্গে সম্পর্ক খুব ভালো ছিলো।

টুকু গিয়ে ওদের দুঃখের কথা জানালো কুকুরদের। তাদেরাও দুষ্টু শেয়ালটাকে বনছাড়া করার কথা বলল। সিদ্ধান্ত হলো আজ রাতেই সবাই মিলে শেয়ালের ওপর আক্রমণ চালাবে।

এদিকে বনে এতো কিছু যে ঘটে যাচ্ছে, শেয়াল তার কিছুই জানতে পারল না। তাই রাতে নিশ্চিন্ত মনে তার গর্তে ঘুমোতে গেলো। শুয়ে পড়ার পর সবে মাত্র বেচারার চোখ দুটো লেগে এসেছে, এমন সময় সবুজ গ্রামের কুকুররা ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে এলো ওকে। আর মৌমাছিরা চারদিক থেকে ঘিরে ধরে কুটুস কুটুস করে হুল ফুটাতে লাগলো।

শেয়াল তো এমন আক্রমণের জন্য একেবারেই তৈরি ছিল না। হুলের ব্যথা আর কুকুরদের কামড় খেয়ে এতোটাই ঘাবড়ে গেলো সে যে, কোনো দিকে না তাকিয়ে এক দৌড়ে বলে গেল বন ছেড়ে-আর ফিরে এলো না।

ছোট্ট বনের সবাই খুব খুশি হলো দুষ্টু শিয়ালের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে। আর এ কাজটা সাহস করে টুকু করেছে, তাই সবাই একমত হয়ে টুকুকে তাদের রাজা করে নিলো। পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম এক বানর হলো বনের রাজা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়তে পারেন...

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন প্রাচ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী, শিক্ষাবিদ, ভাষাবিদ, লেখক, গবেষক ও সমাজ সংস্কারক।…

অপু ও ফলচুরি রহস্য

মহানগরের কোলাহলের মাঝে, ব্যস্ত জনপথের কিছুটা দূরে একফালি সবুজ ল্যান্ডস্কেপ । সদ্য গড়ে ওঠা আবাসন…

ভালুক ও কাঠবিড়ালী

কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘খুকি ও কাঠবিড়ালী’ কবিতাটি কম-বেশি সবাই পড়েছে। এ কবিতাটির কারণেই ছোট্ট…