শেয়াল মামা পণ্ডিত বলিয়াই স্বীকৃত। বনে জঙ্গলে মাথা উঁচু করিয়াই চলেন তিনি। কিন্তু ফাঁদে পড়িয়া সদ্য খোয়া যাওয়া লেজটি লইয়া বিশেষ দুশ্চিন্তায় পড়িয়াছেন তিনি। বহুপূর্বে তাহার পরদাদারও একই অবস্থা হইয়াছিলো। সে যাত্রায় বনের প্রাণীরা শেয়াল জাতির পাণ্ডিত্যে একটা কলঙ্কের দাগ আঁকিয়া দিয়াছিলো। তাহার পরদাদা প্রাণীকুলে ব্যাপক ক্ষোভ এবং সমালোচনার মুখে পড়িয়াছিলেন বনের আর সকলের লেজ কাঁটিবার ফন্দী আঁটিয়া ধরা পড়িয়া।
দুই প্রজন্ম পর একই পরিস্থিতির সম্মুখিন যে তাহাকেও হইতে হইবে ইহা কি ভুলিয়াও তিনি কখনো কল্পনা করিয়াছিলেন? অদৃষ্ট এমনই নির্মম। মান-সম্মান যাহা ছিলো তাহার, সমস্তটাই ম্লান হইয়া যাইতেছে লেজ খোয়ানোর লজ্জায়। লেজ ছাড়া প্রাণী ! ‘হা ঈশ্বর রক্ষা করো! বুদ্ধিমানকে বুদ্ধি দাও!! মানীর মান রক্ষা করো !!!’
সমগ্র দিন পূর্ব বনে কাটাইয়া ঘোর অন্ধকারে পা টিপিয়া টিঁপিয়া ডেরায় ফিরিতেছিলেন পণ্ডিত মহাশয়। বিশেষ নজর রাখিতেছিলেন চতুর্দিকে, যাহাতে কেহ তাহাকে এই দুরাবস্থায় দেখিতে না পায়। ডেরায় ফিরিয়া পরিকল্পনা করিয়া কিছু একটা বাহির করিতে হইবেই। কিন্তু যেথায় ব্যাঘ্রের ভয় সেথায় নাকি প্রহর কাটিয়া যায়। বলা নেই কওয়া নেই রাজা মহাশয়ের খাস পেয়াদা সামনে আসিয়া হাজির হইলো।
– আরে পণ্ডিত মহাশয় এতো রাত্রে কোথা হইতে?
– ইয়ে পেয়াদা সাহেব , গিয়াছিলাম রাহুর দশা কাটাইতে।
– কাটিয়াছে?
– সবই ঈশ্বরের কৃপা। আসি তবে। প্রণিপাত।
ভাগ্যিস অন্ধকারে পেয়াদা বেটা তাহার লেজের দিকে নজর দিতে পারেন নাই। ‘যাক বাবা এ যাত্রায় বাঁচিয়া গেলাম’ মনে মনে একথা বলিয়া ডেরায় ফিরিলেন পন্ডিত শেয়াল।
সমগ্র রাত্রি নিদ্রাহীন কাটিলো তাহার। শেষ প্রহরে এক মহাবুদ্ধি মাথায় চাপিলো । ডেরার মুখে সূর্য উদিত হইবার পূর্বেই ঝোপঝাড় দিয়া ঢাকিয়া ফেলিলেন। নিজপুত্র ফটিককে দিয়া বনের রাজা ব্যাঘ্র মামাকে বিশেষ সংবাদ পাঠাইলেন। হন্তদন্ত হইয়া ব্যাঘ্র মামা সদলবলে ডেরার মুখে আসিয়া হাঁক ছাড়িলেন।
– কিহে পণ্ডিত, তোমার নাকি অসুখ করিয়াছে?
– আমার অসুখে দুশ্চিন্তা নহে রাজা মহাশয়। গিয়াছিলাম দূর দেশে গুরু মহাশয়ের নিকট হস্ত দেখাইতে, রাহুর দশা হইতে মুক্ত হইতে। ফিরিলাম নিদারুন দুঃখের সংবাদ বহন করিয়া। এ দুঃখ আমার একার নহে প্রিয় রাজা মহাশয়, এ দুঃখ সমগ্র রাজ্যের।
– বিচলিত হইয়া পড়িতেছি, খুলিয়া বলো।
– যখন রাজ্যের ভাগ্য গননা করিতে বলিলাম জ্যোতিষ গুরুকে, তখন তিনি এমনই এক দুঃখের সংবাদ দিলেন যাহাতে সমগ্র রাত্রি ঘুমাইতে পারি নাই ।
– ভনিতা ছাড়িয়া আসল কথাটি বলিয়া ফেলো হে পন্ডিত, আমাকে দুঃশ্চিতায় রাখিয়ো না।
– জ্যোতিষ গুরু রাজ্যের ভাগ্য গননা করিয়া বলিলেন, ‘তোমাদের রাজার আয়ুষ্কাল ফুরাইয়া আসিতেছে শনির অমঙ্গল প্রভাবে। দ্রুত ব্যাবস্থা না লইতে পারিলে মহা সর্বনাশ হইবে তাহার।’
– কি সে ব্যবস্থা খুলিয়া বলো।
– জ্যোতিষ মহাশয় বলিলেন এই রাজ্যের সব থেকে পণ্ডিত ব্যক্তির এক পক্ষ কাল সূর্যের মুখ দেখা নিষিদ্ধ, তাহার সহিত…
– তাহার সহিত কি? খুলিয়া বলো জলদি করে।
– ইহা বলিতে আমার ভয় হইতেছে প্রিয় রাজা মহাশয়। যদি অভয় দেন…
– তুমি নির্ভয়ে বলিয়া ফেলো।
– জ্যোতিষ গুরু বলিলেন, পন্ডিত ব্যক্তির এবং তাহার সহিত প্রাণীকূলের আরো কয়েকজন শক্তিমান ব্যক্তির লেজ কাঁটিয়া ফেলিতে হইবে। যাহাতে শনির কু-প্রভাব কাটিয়া যায়। আমি গতরাত্রেই নিজ হস্তে মহান রাজার শান্তির নিমিত্তে এবং রাজ্যের মঙ্গলার্থে নিজের অতিপ্রিয় লেজটি কাঁটিয়া ফেলিয়াছি।
বলিয়া মায়াকান্না জুড়িয়া দিলো চতুর শেয়াল । আর একথা শুনিয়া রাজা মহাশয় হুংকার ছাড়িয়া পেয়াদাকে ডাকিলেন।
– প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতি মন্ত্রী, উপমন্ত্রী সবাইকে ডাকা হউক এক্ষুনি। এই রাজ্যের ক্ষমতাধর এই সকল ব্যক্তিবর্গের লেজ কর্তন করিবার আশু নির্দেশ দেওয়া হইলো। তাহার সহিত এই সকল মহান ব্যক্তিদের জন্য রাষ্ট্রীয় সম্মাননার ব্যবস্থাও করা হউক।
– যথা আজ্ঞা জনাব। বলিয়া পেয়াদা ছুটিলেন …
সূর্যাস্তের পূর্বেই একে একে প্রধানমন্ত্রী, পাঁচজন মন্ত্রী, দুই জন প্রতিমন্ত্রী এবং একজন উপমন্ত্রীর লেজ কর্তন সম্পন্ন হইলো। নৈশভোজের আয়োজন করিয়া শিয়াল পণ্ডিতকে রাজ্যের এবং রাজার সর্বত্তম বন্ধুর মর্যাদা দেওয়া হইলো। সকল কর্তিত লেজগুলোকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হইলো।
এভাবেই চতুর শেয়াল পন্ডিত পরদাদার কলঙ্কের কালিমা মুছিয়া নতুন ইতিহাস রচনা করিলেন। ইহার জন্যই বলা হইয়া থাকে ‘শেয়াল পণ্ডিতের মেধার কাছে জঙ্গলের সব মেধাই চীরকাল পরাজিত হয়।’