শেয়ালের ধোঁকা

এক বাগানে এক মোরগ বাস করতো। সে গল্প বলতে ও শুনতে পছন্দ করতো। কবুতর ও চড়ুই পাখিদের দেখলেই মোরগ বিভিন্ন বিষয় জানতে চাইতো। তাদেরাও মোরগের ডাকে সাড়া দিতো এবং গোল হয়ে বসে গল্প বলতো। মোরগের ওপর শিয়াল ও শিকারীর আক্রমণ এবং তাদের বিভিন্ন ধোঁকা সম্পর্কে তারা আলোচনা করতো। এসব আলোচনা শুনতে শুনতে মোরগ শত্রুর চক্রান্ত সম্পর্কে সব সময় সজাগ থাকতো।

বসন্তের কোন এক একদিন মোরগ ছিল একা। সে ঘর থেকে উঁকি দিয়ে নানারকম ফুল, ফল এবং অঙ্কুরিত লতাগুল্ম দেখছিল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর ফুলের গন্ধে তার মন আনন্দে নেচে উঠলো এবং মনের অজান্তেই উচ্চস্বরে ডাক দিতে শুরু করলো। ওই বাগানের কাছেই ছিল একটি শিয়াল। মোরগের ডাক শোনার পর সে দৌড়ে মোরগের কাছে এলো। মোরগকে গোশত খাওয়ার জন্য সে একটা ফন্দি আঁটলো। কিন্তু শিয়াল মোরগের কাছে পৌঁছার সাথে সাথে মোরগ প্রাণভয়ে একটি গাছের ডালে গিয়ে বসল। এরপর মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল কিছুতেই সে শিয়ালের চক্রান্তের ফাঁদে পা দেবে না।

যাহোক, শিয়াল যখন দেখলো মোরগ তার নাগালের বাইরে চলে গেছে তখন সে কথার মারপ্যাঁচে মোরগকে বাগে আনার পরিকল্পনা করলো। মোরগকে উদ্দেশ্য করে সে মিষ্টি ভাষায় বলতে লাগলো : আরে, কি ব্যাপার! আমাকে দেখে গাছে উঠলে কেন? তোমার মিষ্টি আওয়াজ শুনে আমি তোমার সাথে বন্ধুত্ব করতে এলাম আর তুমি কিনা আমার কাছ থেকে দূরে চলে গেলে! কতইনা ভাল হতো যদি আমরা একসাথে এ মাঠে ঘুরে বেড়াতে পারতাম!!

মোরগ বলল: তুমি ঠিক কথাই বলেছো, এত সুন্দর পরিবেশে তোমার সাথে ঘুরতে পারলে আমারো ভাল লাগতো। কিন্তু তো তোমাকে আমি চিনি না। তাছাড়া আমার বাবা আমাকে সব সময় উপদেশ দিতেন অপরিচিত কারো সাথে যেন বন্ধুত্ব না করি।

শিয়াল বলল : আমি তোমার অপরিচিত কে বললো? আমি তো তোমার বাবার বন্ধু। তুমি যখন ছোট ছিলে তখন প্রায় প্রতিদিনই আমি তোমাদের বাসায় যেতাম। এইতো গতকালও তোমার বাবার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। তিনি আমাকে বলেছেন, আমি যেন তোমার ব্যাপারে সতর্ক থাকি কেউ যাতে তোমার দিকে চোখ তুলে তাকাতে না পারে।

শেয়ালের কথা শুনে মোরক অবাক হয়ে গেল। কারণ তার বাবা অনেকদিন আগেই মারা গেছে। তাই সে বিস্মিত হয়ে বলল : তুমি এসব কি বলছো! আমার বাবা তো মারা গেছেন বছরখানেক আগে। তুমি নির্ঘাত মিথ্যা বলছো।

মোরগের কাছে মিথ্যা ধরা পরার পর শিয়াল কিছুটা বিব্রতবোধ করলো। তারপর স্বভাবসূলভ ভাষায় কথা ঘুরিয়ে সে বললো : দেখো দেখি কাণ্ড! আমি আসলে তোমার মায়ের কথা বলতে চেয়েছিলাম। তিনিই আমাকে বলেছেন, তোমাকে যেন একা না রাখি। এখন তুমি যদি আমার সাথে চলতে না চাও তাহলে অন্য কথা।

মোরগ বলল: তোমার ব্যাপারে আমি বাবা-মা কারো কাছেই কোন কথা শুনিনি। তবে আমি জানি যে, মোরগ ও শিয়ালের বন্ধুত্ব করা উচিত নয়। কারণ শিয়াল সবসময় মোরগকে খাওয়ার জন্য ব্যস্ত থাকে। আমার মতে, কোন মোরগেরই শিয়ালের মতো শত্রুর সাথে বন্ধুত্ব করা উচিত নয়।

শিয়াল বলল: হায়! হায়!! তুমি আমাকে শত্রু বললে! আরে তুমি দেখছি কোন খবরই রাখো না। কয়েকদিন আগে বনের রাজা আদেশ দিয়েছেন, সকল জীবজন্তুর মধ্যে যেন বন্ধুত্ব থাকে, কেউ যেন কারো সাথে শত্রুতা না রাখে। তুমি শুনে অবাক হবে যে, রাজার এ ঘোষণার পর এ জঙ্গলে বাঘ ও ভেড়াও বন্ধু হয়ে গেছে! আর তুমি কিনা চাচ্ছো শত্রুতা সৃষ্টি করতে!!

শিয়াল যখন এসব কথা বানিয়ে বানিয়ে বলছিল, মোরগ তখন দূরে মাঠের দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখছিল। এ দৃশ্য দেখে শিয়াল বললো: ওদিকে তাকিয়ে কি দেখছো? তোমার কি এখানে মন নেই?

মোরগ বলল: মন কি খালি একখানে রাখলেই চলবে? আরো সামনের দিকে একটু তাকিয়ে দেখো। ওই যে একটি প্রাণী দেখতে এদিকে দৌড়ে এগিয়ে আসছে। জানি না ওটা কোন্‌ প্রাণী। তবে তোমার চেয়ে একটু বড়, লম্বা কান ও লম্বা লেজ দেখতে পাচ্ছি। পাগুলোও লম্বা ও চিকন।

এ কথা শুনে শিয়াল খুব ভয় পেয়ে গেল। মোরগকে খাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে সেখান থেকে পালানোর চিন্তা করতে লাগলো। এরপর সে আস্তে আস্তে একটি ঝোপের দিকে রওনা হলো। এ দৃশ্য দেখে মোরগ মিটমিট করে হাসতে লাগলো। শিয়ালকে উদ্দেশ্য করে সে বললো : আরে তুমি যাচ্ছে কোথায়? ওই প্রাণীটা আসার পর্যন্ত অপেক্ষা কর। হতে পারে সে তোমারই মতো কোন শিয়াল।

শিয়াল বলল: শিয়াল না ছাই! তুমি যে বর্ণনা দিয়েছো তাতে আমার বুঝতে বাকী নেই যে, ওটা একটা কুকুর। আর কুকুর যদি আমাকে নাগালে পায় তাহলে আমার খবর আছে!

মোরগ বলল: তা হতে যাবে কেন? তুমি না একটু আগে বললে যে, বনের রাজা একে অপরের সাথে বন্ধুত্ব রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। এ নির্দেশের পর বাঘ ও ভেড়াও নাকি একে অপরের বন্ধু হয়ে গেছে।

শিয়াল বলল: হ্যাঁ বলেছি, তবে আমার ভয় হচ্ছে এ কুকুরটিও হয়তো তোমার মতো- বনের রাজার আদেশ শুনেনি। তাই আমার এখানে থাকা একটুও নিরাপদ নয়। এ কথা বলে শিয়াল দ্রুত ওই স্থান ত্যাগ করলো।

শিয়াল চলে যাওয়ার পর মোরগ নিজের বুদ্ধির তারিফ করতে লাগলো এবং নিজেকে বাঁচাতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

লোভ-লালসা সংক্রান্ত অসাধারণ একটি শিক্ষণীয় ঘটনা

চিত্রকর ও পাহলোয়ান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *