শূন্য এ বুকে

বেহেরা আর পরিদা গিন্নীর গলায় গলায় ভাব। তিন তলায় দুটো মুখোমুখি ফ্ল্যাটে বেহেরা আর পরিদা পরিবারের বাস অনেক দিনের। বছর দশেক আগে সুভদ্রা হাউসিং সোসাইটি তৈরি হতেই, বলরাম বেহেরা আর বিজয় পরিদা ফ্ল্যাট কিনে সপরিবারে গ্রাম থেকে পাকাপাকি ভাবে এই ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। দু’পরিবারে বিশেষ করে দুই গৃহকর্ত্রীর মধ্যে চাপা প্রতিযোগিতার কথা সোসাইটির প্রায় সব বাসিন্দাই অল্প বিস্তর জানে। দেওয়ালীর দু’দিন আগে লেটেষ্ট মডেলের টিভি ঘরে আসতেই পরিদা গিন্নীর বুকে একটা চিনচিনে ব্যথা যেন ধাক্কা মারছে অনবরত। কিছুতেই বুঝত পারছে না বেহেরা গিন্নীর কানে নতুন টিভির খবরটা পৌঁছেছে কিনা।
বিজয়বাবু অফিস থেকে ফিরতেই পরিদা গিন্নী জামা প্যান্ট ছাড়ার সুযোগ না দিয়েই কর্তার উদ্দেশ্যে ছুড়ে দিল অদ্ভুত প্রশ্নটা, – “ওগো শুনছো? নতুন টিভিটা যখন আনলে, বেহেরাবাবুর সাথে দেখা হয়েছিল?” অদ্ভুত প্রশ্নটা শুনেই চোখ মুখ কুঁচকে, গিন্নীর দিকে তাকিয়ে টাইয়ের নটটা আলগা করতে করতে অলস ক্লান্ত স্বরে বিজয়বাবুর জবাব, – “নাহ্! কেন বলতো? – “নাহ্! গত দু’দিন ব্যালকনিতে দাড়িয়ে এত কথা হল অথচ বেহেরা গিন্নী নতুন টিভি নিয়ে কোনও প্রশ্ন করলনা কিনা, তাই তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম” বলেই পরিদা গিন্নী ঢুকে গেল রান্নাঘরে।

কিছুক্ষণ পর চায়ের কাপ প্লেট বিজয়বাবুর হাতে দিয়ে আবদার মেশানো গলায় পরিদা গিন্নী বলে উঠলো, – “অনেক দিন হয়ে গেল বেহেরাবাবুদের আমাদের এখানে খেতে ডাকিনি। সেই পিন্টুর জন্মদিনে, প্রায় মাস তিনেক হয়ে গেল। কাল দেওয়ালী উপলক্ষে ওদের ডিনারে ডাকলে হয় না? – “উপলক্ষটা দেওয়ালী নাকি তোমার নতুন টিভি?” বলেই মুচকি হেসে টিভির রিমোটটা ঘোরাতে ঘোরাতে নিউজ চ্যানেলে ডুবে গেল বিজয়বাবু। চোখ মুখ লাল করে দ্রুত পায়ে গিন্নী রান্নাঘরে ঢুকতেই, বিজয়বাবু মনে মনে ঠিক করে নিলো কাল সকালে বেহেরাবাবুর ফ্ল্যাটে গিয়ে ডিনারের নেমন্তন্নটা করে আসবে। ********** সকাল থেকেই বিজয়বাবুর ঘরে সাজো সাজো রব। বাজারের থলেটা রান্নাঘরে রেখেই বিজয়বাবু বেরিয়ে গেল বেহেরা পরিবারকে ডিনারের নেমন্তন্ন করতে আর গিন্নী ব্যস্ত হয়ে গেল রান্নাঘরে। পরিদা গিন্নী আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে ডিনারের সব খাবার এবেলাতেই তৈরি করে নেবে, নাহলে রান্নার ধকলে চোখের নীচে কালি পড়তে পারে। তাছাড়া ভালো রাঁধুনি বলে বেহেরা গিন্নীর গুমোর ভীষণ।

ওর কর্তা বলে ওর মত ফ্রায়েড রাইস নাকি আর কেউ রাঁধতে পারে না। তাই পরিদা গিন্নী বিজয়বাবুকে আগে থেকেই বলে রেখেছে বিবি’স কিচেন থেকে ফ্রায়েড রাইস, ফিস ফিঙ্গার আর চিলি চিকেন নিয়ে আসতে। বিকেল বিকেল নিয়ে আসলে কেউ আর বুঝতেই পারবে না, পরিবেশনের আগে মাইক্রোওয়েভ ওভেনে গরম করে নিজের রান্না বলে চালিয়ে দেবে। চিংড়ির কারিটা শুধু নিজে করতে হবে বলে সেটাই শুরু করে দিল। সবে কড়াইয়ে তেল গরম করে চিংড়ি ছেড়েছে কর্তা এসে দুঃসংবাদটা দিল, সকাল থেকে যে উৎসাহের ঢেউয়ের দোলায় দুলছিল, হঠাৎ তাতে ভাটার টান। অন্য জায়গায় ছেলেকে নিয়ে নেমন্তন্ন রক্ষা করতে হবে বলে বেহেরা গিন্নী আসতে পারবে না, বেহেরাবাবু একাই আসবে। দুঃসংবাদটা শুনেই ঝাঁঝিয়ে উঠল পরিদা গিন্নী, – “মনে মনে হিংসেটা দেখলে? নতুন মডেলের টিভিটা দেখতে হবে বলে ডিনারেই আসবে না? ধ্যাত্তারি! এখন বেগার খাটো….” বলতে বলতে চলতে থাকে কড়াই আর খুন্তির লড়াই…. – “ডিনারের প্রোগ্রামটা ক্যানসেল হবে নাতো?” মনে জ্বালা ধরানো ফোড়ন কেটে বিজয়বাবু রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই কড়াই আর খুন্তির আওয়াজটা যেন হঠাত আগের থেকে বেড়ে গেল। *********** দেওয়ালীর বেগার খাটুনির ধকলের ক্লান্তিতে পরিদা গিন্নীর ঘুম ভাঙতে একটু বেশিই বেলা হয়ে গেল। ছেলেকে আজ স্কুলে পাঠাবে না আগে থেকেই ঠিক ছিল। কর্তার অফিসেও আজ উইকলি অফ। ঘুম থেকে উঠে দু’কাপ চা বানিয়ে বিজয়বাবুর ঘুম ভাঙিয়ে বেড টি দিয়ে নিজের কাপটা হাতে নিয়ে ব্যালকনির দিকে তাকাতেই চোখে পড়ে গেল উল্টো দিকের ব্যালকনিতে দাড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে বেহেরা গিন্নী। সুযোগ হাতছাড়া করতে পরিদা গিন্নী একেবারেই অভ্যস্ত নয়। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দাঁড়ালো ব্যালকনিতে। মুখে চোখে এক টুকরো অনিচ্ছুক হাসি ছড়িয়ে পরিদা গিন্নী বলে উঠলো, – “কি গো! কর্তা কাল বাড়ি গিয়ে বলে এলো অথচ তুমি এলে না? তোমাকে ভীষণ মিস করছিলাম।” এক চিলতে ফিচেল মুচকি হেসে বেহেরা গিন্নীর জবাব, – “না গো! কাল আমার অন্য জায়গায় আগে থেকেই নেমন্তন্ন ছিল, তবে হ্যাঁ, কর্তা বলল তোমাদের নতুন টিভিটা ভালোই হয়েছে।

ডিনার নাই বা খেলাম, চা খেতে খেতেই না হয় তোমার নতুন টিভিটা দেখে আসব খন।” বেহেরা গিন্নীর গা জ্বলানো কথাগুলো যেন সারা শরীরে ছুঁচের মত বিঁধছে। ডিনারে ডাকার আসল কারণটা কি ধরে ফেলেছে? ধরে ধরুক, পরিদা গিন্নীর তাতে কিছু যায় আসেনা। এইতো মাস তিনেক আগে নতুন ইনোভা গাড়ি কিনে বেহেরা গিন্নী হঠাত রোববারের ম্যাটিনি শোয়ে সদলবলে মুভি দেখার নেমন্তন্ন করে বসল। সবাই মিলে একই গাড়িতে যাওয়া যায় বলেই নাকি এই ইনোভাটা কিনেছে। বেহেরা গিন্নীর শয়তানীটা আগেই ধরে ফেলেছিল বলে সেবার শরীর খারাপের বাহানা করে মুভি দেখতে যায়নি পরিদা গিন্নী। কথা ঘোরানোর জন্যে বেহেরা গিন্নীর উদ্দেশ্য পরিদা গিন্নীর চিমটি, – “কি গো, এবার দেওয়ালীতে কর্তা ফাঁকি দিল নাকি? নাকি তিন মাস আগে নতুন গাড়ি এলো বলে দেওলীতে…….” পরিদা গিন্নীর কথা শেষ করতে না দিয়েই বেহেরা গিন্নীর রেডিমেড উত্তর, – “হ্যাঁ গো, কর্তা তো নাই বলে দিয়েছিল প্রথমে, তা সেদিন হোটেল সি-হকে দুজনে গেছিলাম একটা পার্টি এটেন্ড করতে, তো সেখানে চলছিল একটা শাড়ির এক্সিবিশন, সেখান থেকে সস্তায় পেলাম বলে জোর করে কিনে হাতে একটা শাড়ি ধরিয়ে দিল, মাত্র আঠারো হাজারেই পেয়ে গেলাম।

তোমার তো এবার দেওয়ালীতে নতুন টিভি?” বেহেরা গিন্নীর পালটা চিমটি জ্বালা ধরিয়ে দিল পরিদা গিন্নীর মনে। কিন্তু তিনিও হেরে যাওয়ার পাত্রী নন। বাঁকা হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলে উঠলো, – “আর বোল না, কর্তাতো পরশু অফিস ফেরতা তানিস্কের শোরুম থেকে…….” পাশের ফ্ল্যাটের বাঙালী পরিবারের কর্তা মুচকি হেসে সাউন্ড সিস্টেমে বাজতে থাকা গানের ভল্যুউমটা আরও একটু বাড়িয়ে দিয়ে খবরের কাগজে ডুব গেলেন। বাকযুদ্ধরত দুই মহিলার গলার আওয়াজ ছাপিয়ে মিউজিক সিস্টেমে বেজে চলেছে “শূন্য এ বুকে…………..”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়তে পারেন...

আবিষ্কার

১ ‘ টুবলু, টুবলু, টুবলু উ উ উ ‘ মার গলা, অনেকক্ষন ধরেই শুনতে পাচ্ছি। …

সরল ও হাতি

সরল এখন খুব খুশি । কারণ সরল ইশকুলে ভর্তি হয়েছে । বাবু সরলকে ইশকুলে যেতে…

পুষুর দুঃস্বপ্ন

আলমারির তাকে থরে থরে সাজানো মধুভর্তি বয়ামগুলোর দিকে তাকিয়ে পুষুর দু চোখ চকচকিয়ে উঠলো। ‘কি…