সবাই বলে বিষফোঁড়। অভিজাত এলাকার পাশে বলেই হয়তো। কেউবা উল্টো। নুন-তেল-পানির মতই প্রয়োজনীয় এই ঝুপড়ি ঘরগুলো। ভাতের ফ্যান খেয়ে থাকার মত অভাব আর নেই এই ছোটলোকদের। কাজ আছে, ভাতকাপড় আছে, মাথা গোজার ঘরও আছে। বস্তিটা বেশ পুরোনো। যিনি ফি বছর কম্বল বিতরণ করেন তিনিই দখলদার। এ পাড়ার কেউ কেউ তার ভাই-বেরাদার। আমি তার পাড়াতো না মামাতো এটা নিয়ে ভাবা এখন জরুরি নয়। কথা ছিল, গল্পটা উগলে ফেলবো একদিন।
যেদিন আমি তুলসিপাতায় নেয়ে ধুয়ে খুলেছিলাম জীবনের নতুন ধারাপাত। হলুদসন্ধ্যার পিঁড়িতে বসে ক্লিনজার আর ময়েশ্চারাইজার আমার মশার কামড়গুলো আড়াল করলেও ঢুলুচোখ আমার চেয়ে ছিল টঙঘরের দরজায়। কেউ এসে নিয়ে যাক সেই ঘরে! কেউতো আসুক একবার! আসলে কোন বন্ধু নেই আমার। ওরা চেনাজানা লোক। দেশালের টানে যাই। ওরাও আসে। শূন্যে হাত উঁচিয়ে বলি ফুরিয়ে গেছে। ওরা বলে , ‘কয় পুরিয়ার চাই তোমার তাসা ?’ আমি হাসি আর বলি, যতখুশি দাও। দেশাল আর মোজার্টে না নেই আমার। ২/৩ পুরিয়া আর তার সাথে মোজার্টের ভায়োলিন হলে আমার বিষন্ন রাতগুলো নরমপালক মেলে দেয়। আমি রাতপাখি হই। স্বপ্নলোকের পাড়ে নয়, হই আমি নিয়মভাঙা মলাটের কীট।
রাতে ভাল ঘুম হয়না। টঙঘরের আড়াআড়ি লাইলাক ফ্ল্যাটের বাসিন্দা আমি। নেশায় থাকি, গান শুনি, মাঝে মাঝে আঁকাঝুকি। বাড়ির কারো সাথেই কথা হয়না। এর কারন আমি জানিনা। পড়াশুনায় মন নেই, ছিলোনা কখনো। প্রথমদিকে বাবা বকাঝকা করতো, দুএকবার ভাইয়াও। আমার সবই সয়ে গেছে। কলেজে যেতাম সময় কাটাতে, এখন তাও ভাল লাগেনা। মিলির বিয়ের পর আসলে আমি একা হয়ে গেছি।
মিলি নয় মিলিবু। ও আমার অনেক বড়। তবে আমরা জোড় বিজোড়। ওর সাথে আমার সব লেনদেন, বোঝাপড়া, অভিমান। ছোটবেলায় খুব বেশি অভিমান হলে হাতে কাটাকুটি করতাম। হাতটাকে মনে হতো মাটি। নরম মাটি। ব্লেডের আঁচড় বসাতাম। মিলি এসে থামাতো আমাকে। মিলি আর বুলাফুফু বাড়ি এলে আমার ঘরে আসে। অন্যকেউ নয়। আর কেউ দুএকবার এলেও মা কখনই আসেনা। মিলিকে বলেছিলাম, ‘আমি কি তোদের আপন বোন, সত্যি করে বলতো মিলি!’ ও শুধুই হাসে।
মাইনাস ফাইভ চশমার লোকটা আমাদের দুর্সম্পকের আত্মীয়। এক বিকেলে বুলাফুফু আমায় ডেকে বিয়ের কথা বলেছিলো। আমি রাজি নই বলতেই বাবার চিৎকারে লোকটা আরো গুটিসুটি হয়ে অন্য ঘরে চলে গেলো। আমি অনেক কথা বলেছিলাম সেদিন। লোকটা কিছুই বলেনি। বিয়েটা পাকা করলো রেজাভাই। মিলির বরের অদ্ভুত এক শক্তি আছে , নাকি জাদু! বাবাকে,আমাকে,এমনকি ঐ লোকটাকেও কি করে রাজি করলো সেদিন।
টঙঘরের কথা বলি। বলতে ইচ্ছে করছে। বস্তি উচ্ছেদের খবর আসে মাঝে মধ্যে। পুলিশভ্যান বস্তির মোড়ের কাঁচারাস্তায় হুইসেল দিলে টেনশন বাড়ে প্রতিবেশি ফ্ল্যাটগুলোর। এ ঘরটা হারালে নতুন কোন নেশার ঠিকানা খুঁজে নিতে হবে এ নিয়ে ভাবতেই মেজাজ খিচড়ে যায়। দখলদার লোকটার নম্বরে ফোন করি। সে ঠান্ডাগলায় বলে, ‘সব ঠিক হয়া যাইবো তাসা, তোমরা চিন্তা কইরো না’। ঘন্টাকয়েক পরে ভুড়িয়াল পুলিশ বস্তিটাকে নিজের চাতাল ভেবে ময়লাটাকার বান্ডেল শুঁকে। ‘হারামজাদা টাকা চিবিয়ে খা, দালালের বাচ্চা!’ একথা বলতে বলতে আমরা আবার ফিরে যাই টঙঘরে। ওখানে বুঁদ হয়ে থাকা প্রানীকুলের টালমাটাল জীবনে ফিরে আসে স্বস্তি। স্বস্তি আর কি এতো রুটিরুজির ধান্দা! নিজেকে দেখি। ওদেরকেও। দিনের আলোয় মানুষগুলো রুগ্ন আর অসহায় অথচ রাতে কি অদ্ভুত ফুলকির তেজ। কি আছে কি নেই যাদের কোন হিসেব নেই। প্রতিবারই ছোটলোকেদের সঙ্গে সম্পর্ক আরো কিছুটা মজবুত হয়, লেনদেনও বাড়ে।
বর্ষায় ফাঁটা প্লাস্টিকে মোড়ানো ঘরটা চুইয়ে পানি পড়ে। আচমকা দমকা হাওয়ায় নড়ে ওঠে ছায়াছবির রঙিনপোষ্টার। কখনো কখনো নায়কের বাহুপাশে আধশোয়া নাগিনীর নাগমণি ঠিকড়ে রোদ ঝলসায়। প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম পলিমার যমজ ভাইবোনের মত রোদ পোহায়। শীত,বর্ষায়, প্রখর রোদে নেশারা ঘাপটি মেরে থাকে ঘুমন্ত মানুষের মগজে,ফুসফুসে,রক্তে। আধভেজা দরজা ঠেলে মানুষ আসে টঙঘরে। ভালমানুষ, মন্দমানুষ, ভালমন্দে আটকে যাওয়া দারুন মানুষ। দিন ও রাতের সাথে বেমানান হয়না কেউ। আমিও না। ওঘরে সকাল সন্ধ্যা সাপলুডু খেলাচ্ছে ইলিয়াস, চিমনি, কাকলি আর বোকামত ছেলেটা। দুতিনমাস থেকে দেখছি ছেলেটাকে। ওর বামচোখের নিচে কাটাদাগটা বিশ্রীরকমের। আমার গা গুলিয়ে আসে। ড্রেনের পাশে দাড়িয়ে বমি বমি ভাবটাকে লালন করি আর প্রতিদিন ভাবি আজ ওর নাম জানতে চাইবো।
সেদিনের সন্ধ্যেটা বারবার মনে পড়ে। প্যান্ডেলের পেছনের এক কোনে ওরা ক’জন জমে ছিল। ঠিক যেটুকু অন্ধকার পেলে নেশা তরল হতে শুরু করে। ওরা ফুর্তিতে আছে আজ। ব্যান্ডবাজনা,খানাপিনা। একবার রূপম আমার কাছে আসতেই বল্লাম, ‘ডাবলডেকার মিঠাই খাও দোস্ত, ওতে ধরবে ভাল!’,’কি বলিস, আমি কি নতুন খাই নাকি ? তোর না আজ গায়েহলুদ! তুই কি খাবি বল!’ আমি কিছু একটা বলতেই বুলাফুফু ডেকে নিয়ে যায় রূপমকে। কত আনন্দ, কত্ত প্ল্যান ওদের! আমি জানতাম। আফটার আওয়ার পার্টির শুরুটা টঙঘর থেকেই। তিনটাঅব্দি থাকবে ওখানে। তারপর একটানে চলে যাবে ওরা গোর্কিদের বাসায়, এইতো ফ্লাইওভারের পরেই। নতুন কিছু যোগ হবে আড্ডায়, ‘সংকর ধাতু’ ! কি সব নাম রে বাবা! উত্তরা থেকে কে যেনো নিয়ে আসবে, রূপম তাই বলেছিলো। সেলিব্রেটিং মাই ওয়েডিং! সারারাত মউজ মাস্তি! আন্টিরা গেছেন দেশের বাইরে। কোন বাধা নেই। আর গোর্কির বউটা একেবারেই আমাদের মত, কোন কমপ্লেইন নেই মেয়েটার।
একদন্ড ভাল লাগছেনা। এত আলো, এত সজ্জা! ভীড়ের মধ্যে নিজেকে পিষে ফেলেছি বারবার। যেনো একটা যুদ্ধবিমান ভনভন করছে কানের চারপাশ। যখন রক্তের সম্পর্কের মানুষগুলো আমার ভালমন্দ হিসেব করছিল। পালাতে চাইছিলাম জীবন থেকে। পাঁচঘন্টারও বেশি হয়ে গেছে। সেই বিকেলে থেকে ডলপুতুল হয়ে বসে আছি। মনে হচ্ছিলো রেললাইনের ফিসপ্লেট খুলে ফেলেছে কেউ! আমার নেশা চাই, চাই টানাঘুম, অন্তত একটা পুড়িয়া চাই। পেন্ডুলামের মত ভাসছি আমি আর দরজার হাতল। সেটা টঙঘরের। কাঁচাহলুদের রক্তময় গন্ধে কি এক নেশা চেপে বসেছিলো সেদিন। এমন জন্ডিস সন্ধ্যায় অতিথিদের জোড়াহাতে কুলা, ফল ও শস্যাদি আমার কপাল ছুঁয়ে আশির্বাদ করেছে বারবার। ভৎসনা চেয়েছিলাম সেই রাতে। পালাবার, আত্মাহুতি দেবার। আমায় কেন আশির্বাদ দাও? রাত বাড়ছে, অতিথিদের হাসি আর গল্পের লেজুর বাড়ছে তারই সাথে। আমার সাথীরা চলে গেছে সেই কবে। আমি যাদের সঙ্গি হতাম। আমার মিসকল এড়িয়ে যাচ্ছে ওরা! বাবামার জন্যে করুণা, নাকি আমার জন্যে! তবে ঐ হবু লোকটার জন্যে কখনই হতে পারেনা। এমন ভাবলেশহীন মানুষের জন্যে মায়া বা করুণা কিছুই হয়না কারো।
রেজাভাই আমাকে ফলো করছিলো। আমি এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। বস্তির দখলদারের সাথে কি একটা লেনদেন আছে রেজাভাই এর। টঙঘরে দেখেছি কয়েকবার। মিলিকে বলেছিলাম, ও শোনেনা এসব কথা। লোকটা জাদুকরই বটে। রেজাভাই আর মিলি আমার পাশেই বসে ছিল। দুবার মনে হয়েছে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ি। প্যান্ডেলে মোড়ানো ছাদ নিজের শৈশব, কৈশোরকেও অচেনা করে দেয়। হাঁটছিলাম আমি কার্নিশের খোঁজে। কারচুপি কাজের শাড়ির আঁচলটা ভারী ছিল। কারিগরের নিপুণ হাত কি আমাকে থামিয়ে দিয়েছিলো সেদিন ? কে তুমি দরদি ! কোন বেনারসী পল্লীতে থাকো তুমি মহাজন! রেশমি আর কসমস শাড়ি যে ভাল লাগেনা আমার। আমিও নকশা আঁকি খাতায়। আমি আঁকি মৃত্যু ও খরা, মনখারাপের শৈশব। সেই রাতে আমারই ছায়া আত্মাহুতি দিয়েছিলো। এই দেহ পারেনি আলগা হতে! ভোরের আলো ফোটার আগেই মনখারাপের তাসাকে নিয়ে আমি ঘরের বাইরে পা রেখেছিলাম।
বাড়ি ফেরা আর হয়নি। সেই যে লাইলাক ফ্ল্যাট ছেড়েছি হলুদগন্ধা রাতে। নিয়মভাঙা মলাটের কীট আমি। ভবঘুরে জীবনের স্বাদে গন্ধে বুদ হয়ে আছি। বছর খানেক পরে একবার দেখা হলো মাইনাস ফাইভ চশমার লোকটার সাথে টঙঘরে! সিগারেটের ধোয়াটুকু টানেনা যে লোক সে কিনা দেশালের ডেরায়! অবাক হয়েছিলাম। তাকে দেখে আমার অপরাধবোধ হবার কথা ছিল কিন্তু হলোনা। ‘তাসা, তুমি বাড়ি ফিরে যাওনা কেন ?’ আরো কতকিছু বলে যাচ্ছে লোকটা। অনবরত। সেই ছেলেটার পাশে গিয়ে বসি। বামচোখের নিচে বিশ্রীরকম কাটাদাগের সেই ছেলেটার হাত শক্ত করে ধরে বসে আছি আমি। দ্বীর্ঘশ্বাস নেই, বিকার নেই। তবে বমিবমি ভাবটা আজও আছে। চলছে তেল-নুন-পানির সাথে দেশালের রসায়ন পাঠ। আর শূন্যে ওড়ে ফুলকি ও ছাই। কসমিক প্লাজায় অদৃশ্য কাঁচ। ফুরিয়ে যাচ্ছে ঘনবন, আমার দেশালের পুরিয়াও।মোজার্টের ভায়লিন শুনবো বলে হেডফোনটা ঠুসে দেই কানে।আচ্ছা, মাইনাস ফাইভ চশমার লোকটাকে কি নিরোপরাধ বলা যায় ?
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।