শুয়াইব (আঃ)

মহান আল্লাহ আল কুরআনে যেসব সম্মানিত নবীর নাম উল্লেখ করেছেন হযরত শুয়াইব (আঃ) তাঁদেরই একজন। অন্য সকল নবীর মতো তিনিও এই মহা সত্যের প্রতিই মানুষকে আহবান করেছিলেন-

“হে আমার জাতির ভাইয়েরা, তোমরা কেবল এক আল্লাহর দাসত্ব, আনুগত্য এবং হুকুম পালন করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই।”

 

শুয়াইব কোন জাতির নবী ছিলেন?

কুরআন মাজীদে শুয়াইব (আঃ) কে মাদইয়ান ও আইকাবাসীদের নবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কোন কোন মুফাসসির বলেছেন- এই দুটি নাম মূলত একটি গোত্রের দুটি নাম। আবার কেউ কেউ বলেছেন- এ দুটি আসলে দুটি গোত্রেরই নাম। হযরত শুয়াইব (আঃ) এই দুটি কওমের কাছেই নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন।

ঐতিহাসিক ও মুফাসসিরগনের মতে, এই দুটি গোত্র ইবরাহীম (আঃ) এর বংশধর। তাঁদের বসবাসও ছিলো পাশাপাশি। কুরআনে বলা হয়েছে এ দুটি জাতি উম্মুক্ত রাজপথে অবস্থান করতো। মাদইয়ানবাসীদের বসবাস ছিলো উত্তর হিজায থেকে ফিলিস্তিনের দক্ষিনাঞ্চল জুড়ে এবং সেখান থেকে সিনাই উপত্যকার শেষ পর্যন্ত আকাবা উপসাগর এবং লোহিত সাগরের তীর জুড়ে। মাদইয়ান ছিলো তাঁদের প্রধান শহর।

বর্তমান তাবুক অঞ্চলের প্রাচীন নাম ছিলো আইকাহ। তাবুকের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আইকাবাসীরা বসবাস করতো। মাদইয়ান এবং আইকাবাসীদের মধ্যে বৈবাহিক, বাণিজ্যিক এবং অন্যান্য সামাজিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো। এ ছাড়া উভয় জাতি একই ধরনের অসামাজিক কাজকর্ম এবং অন্যায় ও অপরাধে লিপ্ত ছিলো। সে কারনে আল্লাহ তাঁদের উভয় জাতির হেদায়েতের জন্যে একজন ব্যাক্তিকেই নবী নিযুক্ত করেন।

হযরত শুয়াইবের জন্ম হয় মাদইয়ান গোত্রে। কুরআন মাজীদে মাদইয়ানবাসীদের হজরত শুয়াইবের জাতি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি তাঁদেরকে ‘হে আমার জাতির ভাইয়েরা’ বলে সম্বোধন করতেন।

 

হযরত শুয়াইব কোন সময়কার নবী?

হযরত শুয়াইব (আঃ) যে ঠিক কোন সময়কার নবী ছিলেন, সে কথাটি একেবারে নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তবে কুরআনের বর্ণনা ভঙ্গি থেকে বুঝা যায়, শুয়াইব (আঃ) হজরত মুসা (আঃ) এর পূর্বেকার নবী ছিলেন। তবে কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, হযরত মুসা (আঃ), হযরত শুয়াইব (আঃ) এর সাক্ষাত লাভ করেছিলেন।

 

মাদইয়ান ও আইকাবাসীদের দুরাচার

মাদইয়ান ও আইকাবাসী তাঁদের পূর্বপুরুষ ইবরাহীম (আঃ) এর প্রচারিত দ্বীন ইসলামেরই উত্তরাধিকারী ছিলো। কিন্তু কয়েকশ বছরের ব্যবধানে তাঁরা ইসলামকে বিকৃত করে ফেলে এবং বাস্তবে ইসলামের আদর্শ থেকে অনেক দূরে সরে পড়ে। বিশ্বাস ও চরিত্রের দিক থেকে তাঁরা যেসব অপরাধে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিলো সেগুলো হলো-

১. তারা আল্লাহর দিনকে বিকৃত করে ফেলেছিলো।

২. তারা আল্লাহর সাথে শিরক করতো। মূর্তি পূজা করতো।

৩. তারা জীবন যাপনের সঠিক পথ থেকে দূরে সরে পড়েছিলো।

৪. তারা মাপে কম দিতো। লেনদেনে হেরফের করতো। মানুষকে ঠকাতো। প্রতারনা করতো।

৫. ডাকাতি ও হাইজ্যাকি ছিলো তাঁদের নিত্য দিনের কাজ।

৬. এছাড়াও অন্যান্য পাপাচার এবং ধ্বংসাত্মক কাজে তারা লিপ্ত ছিলো।

 

হযরত শুয়াইবের সংস্কার আন্দোলন

এই দুটি অধঃপতিত কওমকে সংশোধন করার জন্যে আল্লাহ তায়ালা মাদইয়ানের মহান চরিত্র ও ব্যাক্তিত্বের অধিকারী শুয়াইবকে নবী নিযুক্ত করেন। শুয়াইব ছিলেন অত্যন্ত সুভাষী ও বলিষ্ঠ ব্যাক্তিত্বের অধিকারী। তিনি মর্মস্পর্শী দাওয়াত এবং আহনবানের মাধ্যমে আল্লাহর দিনের প্রচার ও জাতিকে সংশোধনের সংগ্রাম শুরু করেন। তাঁর কর্মধারা সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র আল কুরআনে বলেন –

“আর আমি মাদইয়ানবাসীদের কাছে তাঁদের ভাই শুয়াইবকে পাঠিয়েছি। সে তাঁদের বলেছিল- হে আমার জাতির ভাইয়েরা, তোমরা এক আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য করো, তিনি ছাড়া তোমাদের অপর কোন ইলাহ নাই। তোমাদের কাছে তোমাদের প্রভুর নিকট থেকে সুস্পষ্ট প্রমান এসে গেছে। তাই তোমরা তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী মাপ ও ওজন পূর্ণ করে দাও। মানুষকে তাঁদের দ্রব্য সামগ্রীতে ঠকিওনা। দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করোনা। এতেই তোমাদের জন্যে রয়েছে কল্যাণ। প্রতি পথে ডাকাত হয়ে বসোনা। সন্ত্রাস সৃষ্টি করোনা। যারা ঈমান এনেছে তাঁদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিরত রেখোনা এবং সহজ সরল পথকে বাঁকা করার চেষ্টা করোনা। চোখ খুলে দেখো অতীতে যারা ধ্বংসাত্মক কাজ করেছে তাঁদের পরিনতি কী হয়েছে? ” (সূরা আরাফ-আয়াতঃ ৮৫-৮৬)

মাদইয়ানবাসীদের মতো আইকাবাসীদেরও সংশোধন করার জন্যে হজরত শুয়াইব (আঃ) আপ্রান চেষ্টা করেন। তাঁর এ প্রচেষ্টা সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ বলেন-

“আইকাবাসীরা রাসুলদের অস্বীকার করে। শুয়াইব যখন তাঁদেরকে বললো- তোমরা কি ভয় করোনা? আমি তোমাদের জন্যে একজন বিশ্বস্ত রাসুল, সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো আর আমার আনুগত্য করো। এই উপদেশ দানের কাজে আমি তো তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক চাইনা। আমাকে পারিশ্রমিক দেয়ার দায়িত্ব তো মহান আল্লাহর। ওজন পূর্ণ করে দাও, মানুষকে তাঁদের মাল কম দিওনা, পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করোনা। সেই মহান স্রষ্টাকে ভয় করো যিনি তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মকে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা আশ শোয়ারা, আয়াত ১৭৬-১৮৪)

এভাবে মর্মস্পর্শী ভাষায় হজরত শুয়াইব (আঃ) এই দুইটি জাতিকে সংশোধন করার চেষ্টা করেন, কিন্তু তারা তাঁর দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে এবং তাঁর সাথে বিতর্ক ও দ্বন্ধ-সংঘাতে লিপ্ত হয়। তারা বললো- “হে শুয়াইব তোমার সালাত কি তোমাকে এই শিক্ষাই দেয় যে, আমরা সেই সব মাবুদদের পরিত্যাগ করবো, আমাদের পূর্বপুরুষরা যাদের ইবাদাত করতো? আর আমাদের অর্থ সম্পদ ইচ্ছামত ব্যয় করার অধিকার আমাদের থাকবেনা? তুমি একজন মহৎ হৃদয়ের বড় সদাচারী ব্যাক্তিই রয়ে গেলে। ” (সূরা হুদ, আয়াত ৮৭)

তারা আর বললো- “তুমি একজন যাদুগ্রস্থ মানুষ, তুমি তো আমাদের মতই একজন সাধারন মানুষ ছাড়া আর কিছুই নও। আমরা তোমাকে পরিস্কার মিথ্যাবাদী মনে করি। তুমি যদি সত্যবাদী হও তাহলে এক টুকরা আকাশ ভেঙ্গে আমাদের উপর ফেলো দেখি।” (সূরা আশ শোয়ারা, আয়াত ১৮৫-১৮৭)

শুয়াইব বললো- “আমি তো কেবল তোমাদের সংশোধন চাই। আমার সাধ্য অনুযায়ী সংশোধনের এই চেষ্টা আমি করে যাবো। আমার বিরুদ্ধে তোমাদের হঠকারীতা যেন সেই পর্যায়ে না যায়, যার ফলে নূহ, হুদ, ও সালেহ এর জাতির উপর আল্লাহর আযাব এসেছিলো। আর লুত জাতির ধ্বংসের ইতিহাস তো তোমাদের থেকে বেশী আগের নয়। তোমরা আল্লাহর কাছে মাফ চাও এবং তাঁর দিকে ফিরে ফিরে এসো। তিনি বড় দয়ালু, বড় বন্ধু সুলভ।” (সূরা হুদ ৮৮-৯০)

এসব কথার জবাবে তারা বলছিলো – “শুয়াইব, তোমার অনেক কথাই আমাদের বুঝে আসেনা। ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক না থাকলে তোমাকে আমরা পাথর মেরে হত্যা করতাম। আমাদের চাইতে তোমার ক্ষমতা বেশী নয়।”

তাঁদের এসব কথা শুনে শুয়াইব বললেন – “আমার সাথে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক কি আল্লাহর চাইতেও সম্মানিত? তোমরা ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কের কথা বলছো, অথচ আল্লাহর ব্যাপারে মোটেই তোয়াক্কা করছোনা? তোমরা অবশ্যই আল্লাহর বেষ্টনীতে আছো।” তিনি আরো বললেন – “আমার কাজ আমি অবশ্যই করে যাবো, তোমরা অচিরেই জানতে পারবে, কার উপর অপমানকর আযাব আসে আর মিথ্যাবাদীই বা কে? তোমরা অপেক্ষা করো, আমিও অপেক্ষা করছি।”

চরম বিরোধিতার মুখেও একদল যুবক হযরত শুয়াইবের প্রতি ঈমান আনে। চরম নির্যাতনের মুখেও তারা আল্লাহর নবীর সাথে দীনের পথে চলতে থাকে। কিন্তু বিরোধীনেতারা কিছুতেই এদের সহ্য করতে পারেনা। তারা অবশেষে হুংকার ছেড়ে ঘোষণা দিলো – “হে শুয়াইব, আমরা তোমাকে এবং তোমার সাথে যারা ঈমান এনেছে তাঁদেরকে দেশ থেকে বের করে দেবো। অথবা তোমাদেরকে আমাদের প্রচলিত ধর্মে ফিরে আসতে হবে।” (সূরা আরাফ-আয়াতঃ ৮৮)

তারা জনসভা করে জনগনের মাঝে ঘোষণা করে দিলো – তোমরা যদি শুয়াইবের দলে যোগ দাও তাহলে তোমাদের ধ্বংস কেউ ঠেকাতে পারবেনা। এ সব হুংকারের জবাবে হজরত শুয়াইব মহান আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করলেন –

“ওগো আমাদের প্রভু, আমাদের মাঝে আর আমাদের জাতির মাঝে সঠিক ফায়সালা করে দাও। তুমি তো সর্বোত্তম ফায়সালাকারী।” (সূরা আরাফ-আয়াতঃ ৮৯)

 

মাদইয়ান ও আইকাবাসীর ধ্বংস

হযরত শুয়াইবের অনেক চেষ্টা সাধনার পরেও যখন এই দুইটি জাতি আল্লাহর পথে আসলনা এবং নবী ও তাঁর সাথীদের উৎখাত করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলো, তখন আল্লাহ তায়ালা এই উভয় জাতিকে ধংস করে দিলেন। মাদইয়ানবাসীদের ধংস করলেন প্রচণ্ড বজ্রধ্বনি দিয়ে। এমনভাবে তাঁদের বিরান করে দিলেন, যেনো ওখানে কোন দিনই কোন লোক বসবাস করেনি। অপরদিকে আইকাবাসীদের ধংস করে দিলেন ছাতার মতো মেঘমালা পাঠিয়ে। মেঘ থেকে আযাব বর্ষিত হলো আর আইকাবাসীরা সম্পূর্ণভাবে ধংস হয়ে গেলো। কিন্তু মহান আল্লাহ হযরত শুয়াইব এবং তাঁর সাথীদেরকে এসব ধংসের আযাব থেকে রক্ষা করলেন। তাঁদের বাঁচিয়ে রাখলেন এবং এই মুমিনদের ঘরেই জন্ম নিলো পরবর্তী প্রজন্ম।

 

কুরআনে উল্লেখ

কুরআন মাজীদে সূরা আরাফ ও সূরা হুদে মাদইয়ানবাসীদের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সূরা শোয়ারায় বর্ণিত হয়েছে আইকাবাসীদের ঘটনা। কুরআন মাজীদে হজরত শুয়াইবের নাম উল্লেখ হয়েছে ১১ বার। সে আয়াতগুলো হলো – সূরা আরাফঃ ৮৫, ৮৮, ৯০, ৯২। সূরা হুদঃ ৮৫, ৮৭, ৯১, ৯৪। আন কাবুতঃ ৩৬। শোয়ারাঃ ১৭৭।

আপনি যদি কুরআন পড়েন এবং সরাসরি কুরআন থেকেই এসব ঘটনাবলী জানার চেষ্টা করেন, তাহলে অনেক কিছুই জানতে পারবেন এবং শিখতে পারবেন অনেক কিছুই। আসুন আমরা সবাই কুরআন পড়ি। নবীদের ঘটনাবলী জানি এবং নবীদের আদর্শ অনুযায়ী জীবন গড়ি।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!