শিবমের কথা

কুউ কুউ- কুউঃ,ভর দুপুরে কোকিল ডাকছে।তাও যদি বসন্ত কাল হত। চৈত্রের খরা চারি দিকে– বাইরে লু চলছে।বেশী সময় বাইরে ঘুরলে তো কথাই নেই,নির্ঘাত শরীরে জল কমে যাবে, আর ডিহাইড্রেশন হয়ে  যাবে।

এত বড় কথা লকু বোঝে না,সে গ্রামে থাকে,সকাল নেই, দুপুর নেই,শীত নেই,গ্রীষ্ম নেই,সব সময় সব জাগায় টো টোকরে বেড়াচ্ছে।

শিবম গ্রামে বেড়াতে এসেছে,মাসির বাড়িতে।ও থাকে বড় শহর খরকপুরে।খরকপুর বেশ বড় ও  পুরনো শহর।
–লু কাকে বলে জানিস তুই?শিবম জিজ্ঞেস করল লকুকে।
–কে জানে!হবে গরমের কিছু,লকু বলে।
শিবম বলে,লু মানে গরম হাওয়া–গরমের সময় যখন গরম হাওয়া বইতে থাকে তাকে বলে লু!
লকু হাসে,লু–ল্যাংড়া,লুলা!

শিবম পন্ডিতের মত বুঝিয়ে চলে,হ্যাঁ,তাই,ওই গরম হাওয়া যদি শরীরে কিছুক্ষণ লেগে যায়,আমাদের শরীরের মধ্যে যে জল থাকে তা শুকিয়ে যায়।আর শরীরে জল কম হলেই ডিহাইড্রেশন হয়ে যায়। মানুষ তখন ওই তোর কথার মত ল্যাংড়া লুলার মত হয়ে যায়। শিবম খুব সিরিয়াস এ সব ব্যাপারে।

লকু হাসে,যেন এসব সে গ্রাহ্যই করে না,কত গরমে তো ঘুরে বেড়াচ্ছে ও,কত গরম হাওয়া শরীরে উপর দিয়ে  বয়ে গেল–কোথায় লু–কোনো দিন কিছু তো হয়নি ওর!–ফুঃ,ওসব কিছু না,ওসব শহরের ব্যাপার!লকু বলে ওঠে,ও সব লু এখানে ফুঃ রে!গ্রামে ওসব কিছু নেই। যাবি নাকি আম কুড়াতে?এইয়া বড় বড় আম,হিমসাগর,ল্যাংড়া আর কাঁচা মিঠা–যাবি তো চল।

শিবমের ইচ্ছা তো করে ঘুরে বেড়াতে,আম কুড়াতে যেতে,নদীতে ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে যেতে,কিন্তু  ওই ভয়–লু …ক্লাসের টিচার লুয়ে এমন ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন যে দুপুর রোদ্দুরে কোথাও বেরোতে ভয় হয় শিবমের।

গ্রীষ্মের অবকাশ চলছে এখন।টানা এক মাস ছুটি চলবে।গরমের দিনে গ্রামের দিকগুলি একটু ঠান্ডা  থাকে বলে শিবমের মা বাবা শিবমকে নিয়ে এসেছেন তার মাসি মেসোর বাড়ি নতুন গ্রামে।নতুন গ্রাম, রানাঘাট থেকে বেশী দূর না,মাত্র একটা স্টেশন,রানাঘাট–তারপরে কালীনারায়ণপুর–ধরতে গেলে কত- আট দশ কিলোমিটার হবে।কালী নারায়ণপুর স্টেশনে নেমে তিন কিলোমিটার রিক্সায় যেতে হয়,বাস টাস
কিছুই যায় না গ্রাম পর্যন্ত।

প্রায় বছরে একবার শিবম ওরা চলে আসে নতুন গ্রাম ,মাসির বাড়ি।গরমের সময় এলে দুপুরে বের হতে পারে না শিবম।আর ওরই মাসতুতো ভাই লকু কেমন দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছে পল্টু খেদু ওদের সঙ্গে নিয়ে!ঝড়ে আম পাড়ছে,কুড়চ্ছে,ছিপ নিয়ে ভর দুপুরে মাছ ধরতে যাচ্ছে।শিবমের মাঝে মাঝে খুব রাগ হয় মাসি মেসোর ওপর। লকুকে কিছু বলেন না ওঁরা।যখন তখন যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে লকুটা।
–মাসি ও মাসি দেখো,লকু এখন আম কুড়োতে চলে গেলো। লকুকে থামাবার চেষ্টায় শিবম মাসিকে নালিশ করে।
মাসিও হাত পা ছড়িয়ে বলে ওঠেন,ও আমার কথা শোনে নাকি!পড়াশুনা তো নাই রাত দিন টো টো আর টো টো,ব্যাস হয়ে গেল মাসির শাসন।যার আম কুড়াতে যাবার কথা সে কি মার কথা শোনার জন্য বসে আছে!

শিবম ভাবতে লাগলো,আনন্দ তো আছে আম কুড়াবার,নদীতে স্নান করার,ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে যাবার।

একবার লকু নিয়ে গিয়ে ছিলো চুর্নী নদীতে মাছ ধরতে। ছোট নদী,কিন্তু জল ছিলো অনেক!নৌকা চলে,বর্ষার সময় লঞ্চ ও নাকি যায়।সে বার লকু পল্টু,খেদু কোমরে গামছা বেঁধে এলো,সঙ্গে মাছ ধরার তিন চারটে ছিপ.শিবমকে চুপি চুপি লকু এসে বলল,শিবম,যাবি নাকি নদীতে?আমরা যাচ্ছি।
শিবমের মন নেচে উঠলো,চারি দিকে তাকিয়ে দেখল,না রোদ নেই,গরমও বেশ কম,তার মানে লু লাগার সম্ভবনা খুব কম.নেচে উঠলো ও,চল আমিও যাবো,কিন্তু বাবা মা যেতে দেবেন তো!বলে ওঠে  শিবম।
লকু বলে,কেন দেবেন না,আমরা তো আছি।
–আমি তো সাঁতার জানি না রে!শিবম বলে।
–তুই স্নান করিস না,ঘরে এসে স্নান করে নিস।তুই সবার ছিপ দেখতে থাকিস,আমরা স্নান সেরে নেব,
শিবমকে লকু বলে দেয়।
–কিন্তু মা বাবাকে কে বলবে?শিবমের প্রশ্ন।
লকু খুব চঞ্চল–কোনো কাজে তার দেরী সয় না,সে মাসি মেসোর কাছে গিয়ে উপস্থিত হলো শিবমের নদীতে যাবার অনুমতি নিতে।
–শিবম তো সাঁতার জানে না,মেসো,মাসি বলে ওঠেন।
–মাসি,ও তো স্নান করবে না,পাড়ে বসে থাকবে,পাড়ে বসে মাছ ধরবে শুধু।
–তা, কি করে হয়,বলেই মাসি মেসোর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন,কি গো শিবম ওদের সঙ্গে মাছ ধরবে বলে নদীতে যাবে বলছে!
–তুই সাঁতার জানিস না, যাবি কি করে?বাবা প্রশ্ন করেন শিবমকে।
–আমি জলে নামব না,ছিপ নিয়ে ডাঙায় বসে থাকব,বাবা!এক ঘন্টার মধ্যে চলে আসব!আব্দারের
সুরে বলে ওঠে শিবম।

অগত্যা এক ঘন্টার মধ্যে ফিরে আসার এবং জলে না নামার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শিবম চলল চুর্নী
নদীতে মাছ ধরতে।
বাবাঃ ,এমনি খোলা মাঠে ঘাটে জঙ্গলে হাঁটতে দৌড়াতে কি আনন্দ!আশ পাশের বাতাস শরীর জুড়িয়ে দেয়–সরু মেঠো রাস্তা দিয়ে দূরের নদীতে যেতে উত্ফুল্ল আনন্দে শিবমের মন ভরে যায়।
–কি মাছ ধরব রে আমরা?শিবমের প্রশ্ন.
–লেটা,মাগুর,বেলে,অনেক রকম,চিংড়ি ও পাওয়া যায়,পল্টু বলে উঠে।
–একবার না আমরা একটা কচ্ছপ পেয়ে ছিলাম!খেদু শরীর নাচিয়ে বলে।
শিবম ছুট পেয়েছে বহুদিন পরে,চার দিকের রাস্তা,ঘাট মাঠ,জঙ্গল দেখতে দেখতে চলল,কি সুন্দর নালা বেয়ে ঢালানে জল গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে!কোথাও কত আলের সরু রাস্তা,কোথাও লাল মাটির  আঁকাবাঁকা পথ চলতে চলতে ঢুকে গেছে বন বনান্তরে,গ্রাম গ্রামান্তরে!লাফাতে,ছুটতে,ভাবতে কি না  ভালো লাগছে!ছুট পাওয়া মনের উন্মুক্ত আনন্দ অনুভব করতে থাকে শিবম। চার সাথী চলেছে,কখনো জোর পায়ে,কখনো দৌড়নোর মত হেঁটে চলেছে,খেদুর ঘাড়ে সব ছিপের তাড়া।

শিবম বলল তোদের সবার গামছা আছে ,আমার তো গামছা নেই!
লকু বলল,তুই তো স্নান করবি না,মাসি মেসো বলেছে।
মাঝ খান থেকে পল্টু বলে উঠলো,আমাদের তো গামছা আছে,দরকার হলে নিয়ে নিবি!নদীতে যাবি আর স্নান করবি না,এটা হয় কি করে?

গল্পে গল্পে,হাঁটতে হাঁটতে,ছুটতে ছুটতে তিন কিলোমিটার পথ বিশ পঁচিশ মিনিটে পৌঁছে গেলো। চুর্নী নদী,খরস্রোতা,চৌওড়া বেশী নয়,তবু নিয়মিত ঘাট পারাপারের নৌকো আছে।ও পারে যেতে গেলে মাথা পিছু আট আনা পয়সা লেগে যায়।

নির্জন জাগা দেখে,সেখানে ছিপ পাতবে বলে ঠিক করল ওরা।গোনাগুন্তি চার জনের চারটা ছিপ।বেশি ছিপ লকু মনে করে শিবমের জন্য নিয়ে এসেছে। এবার বড়শিতে  মাছ ধরার জন্য কেঁচো গাঁথার পালা, শিবমের হাতে কেঁচো বড়শিতে গাঁথার জন্যে দেওয়া হলো।কেঁচো হাতে নিয়ে তার শিহরণ জেগে উঠলো শরীরে!ওগুলো কেমন যেন হাতের মধ্যে দিয়ে বাইতে থাকে!গা শিরশির করে ওঠে শিবমের। অনেক চেষ্টা করেও গাঁথতে পারে না.অগত্যা কেঁচো গাঁথায় ওস্তাদ খেদু শিবমের বড়শিতে কেঁচ গেঁথে দিলো।ছিপ পাতা হলো। শিবমের ছিপে মাছ ধরার অভিজ্ঞাতা নেই,তাই লকু কি করে ছিপ টেনে মাছ ধরতে হবে বুঝিয়ে দিতে লাগলো-
–দেখ,এই ভেসে আছে ফাতনা,মাছে খেলে ওটা নড়তে থাকে,আর বেশী নড়ে উঠলে বা ডুবে গেলে ভাববি এবার মাছে আধার খেয়েছে,বুঝলি!

ইতিমধ্যে পল্টু একটা মাছ ধরে ফেলেছে,পুঁটি মাছ.ছিপ ছেড়ে মাছ দেখতে গেলো শিবম।বড়শির কাঁটা মাছের গলায় আটকে আছে।পল্টু মাছের গলা থেকে বড়শি খুলে আধারের কেঁচো ঠিকঠাক গেঁথে আবার ছিপ ফেলল।

ওরা বেশকিছু মাছ ধরে ফেললো,লকু প্রায় একশ গ্রামের একটা বেলে ধরে ফেলেছে।শিবমের ছিপের ফাতনা বেশ ক’ বার জলে ডুবলো,ছিপ ধরে ও এত জোরে টান মারছে যে কিছুই ধরা পড়ছে না.একবার একটা মাছ জলের উপর পর্যন্ত উঠে আবার ছিটকে জলে পড়ে গেলো। পল্টু শিবমকে বলল,ছিপ অত জোরে টানলে হবে না,এদিক ওদিক করে হেঁচকা টানতে হবে।

অনেক সময় কেটে গেলো,নিরাশ শিবমের আর ছিপ ধরে বসে থাকতে ভালো লাগলো না।লকু,খেদু ,পল্টু সবাই স্নানের জন্যে নদীতে নেমে পড়েছে,ওরা লাফাচ্ছে,ডুব দিচ্ছে,মাঝে মাঝে জলের মধ্যে ডোবাডুবি  করে ছোঁয়া-ছুই খেলছে। শিবমের বেশ মজা লাগছে.কিন্তু মজার সঙ্গে খুব কথাটা যোগ করতে পারছে না।কারণ,ও নিজে ওদের সঙ্গে খেলায় মেতে উঠতে পারছে না.শুধু মাত্র দর্শক হয়ে,যতটুকু আনন্দ উপভোগ করা যায় ততটুকু সে উপভোগ করছে।

এমনি সময় ঘটনাটা ঘটল।শিবম দেখল তার ছিপের ফাতনা বারবার ডুবছে আর ভাসছে,তার মানে ছিপ এবার তাকে হেঁচকা টানতে হবে।ছুটে ছিপ ধরে হেঁচকা টান মারলো শিবম।আর সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো কোনো বড় মাছ বড়শিতে লেগে গেলো।সে ছিপ ধরে টানতে লাগলো,অন্য দিকে বড় মাছ বেশ টানছে তাকে।

চেঁচিয়ে উঠলো শিবম,বেশ বড় মাছ হবে,শিবমের জোরে কুলোচ্ছে না,কোনো মতই ছিপ টেনে তুলতে পারছে না।চেঁচিয়ে সবাইকে ডেকে উঠলো শিবম,ইতিমধ্যে শিবম দেখল তার ছিপের সুতোয় লাগা একটা সাপের গলার মত গলা একবার ভেসে আবার ডুব দিলো জলে।ভয় পেয়ে গেলো শিবম,ও চীত্কার করে উঠলো,ওরে বাবা,সাপ লেগেছে ছিপে,ভয়ে হাত থেকে ছিপ ছুটে গেলো,এবার ছিপ শুদ্ধু টেনে নিয়ে যেতে
লাগলো আপাতত আনুমানিক দেখা সাপটা।

ডাঙায় ছুটে এলো সবাই,ওদের মধ্যে হই চই লেগে গেলো,ছিপ ধরার জন্য খেদু আর পল্টু ঝাপ দিলো জলে.ছিপ ক্রমশঃ গভীর জলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি সাঁতরে গিয়ে খেদু ছিপ টেনে ধরলো। জলের মধ্যে তাই জলজ প্রাণীর জোর কম নয়,খেদু সাঁতার কেটে জলের মধ্যে দিয়ে ছিপ টেনে আনতে পারছে না।অবস্থা দেখে পল্টু খেদুর এক হাত ধরে টানতে লাগলো।এবার আস্তে আস্তে পারের দিকে
আসছে ওরা।

পারের ওপর থেকে উত্তেজিত শিবম সমানে চীত্কার করে যাচ্ছে,সাবধান সাপ হলে তোদের কামড়ে দেবে,সাপ আছে, ছিপ তোরা ছেড়ে দে,কে কার কথা শোনে,সাপ টাপের অত ভয় গ্রামের ছেলেদের কোথায়! ওরা জানে সাধারণ ভাবে জলের মধ্যে বিষধর সাপ থাকে না।আর থাকলেও সে সাপ মাছের মত ডুব দিয়ে আধার খেতে যাবে না।

ছিপ নিয়ে পারে উঠলো খেদু আর পল্টু,এখনো আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি,–ছিপে যেটা বেঁধেছে,সেটা মাছ,সাপ না অন্য কিছু!কারণ সেটাকে এখনো জলের উপর ওঠানো হয়নি.শিবমের উত্তেজনা বেড়েই চলেছে,মুখ দিয়ে বারবার একি কথা বের হোয়ে আসছে,সাবধান,সাবধান…

এবার লকু ডাঙ্গা থেকে ছিপ ধরে নিল আর গায়ের জোরে টানতে থাকলো।জন্তুটা সামান্য ভেসে আবার ডুবলো।সবাই একমাত্র শিবম ছাড়া,চীত্কার করে উঠলো,কচ্ছপ,কচ্ছপ,বড় কচ্ছপ লেগেছে।কচ্ছপের উল্টো দিকের চেহারা দেখে শিবম আরও ভয় পেয়ে গেলো।টেনে তোলার আগে কচ্ছপ পালাবার জন্যে খোলের ভিতর থেকে তার হাত পা মুখ ছটফটাচ্ছে।জলের মোধ্যে কচ্ছপের ওই ধরণের হাত পা মুখ ছড়িয়ে লাফ ঝাপ দেখলে সত্যি শহরের ছেলেরা ভয়ে আঁতকে উঠবে,এটা স্বাভাবিক।

সারা রাস্তা আনন্দে ছিপের সুতোয় লাগা কচ্ছপ ঝুলিয়ে চার শিকারী ঘরে ফিরল.কচ্ছপের মাংস নাকি সুস্বাদু হয়,শিবম জানে না,ও কোনো দিন কচ্ছপের মাংস খায় নি। বরং ওর চেহারা ছবি দেখে ভয়ই লেগেছে,খাবার কথা চিন্তা করতে পারে না। কচ্ছপের মাংস রান্না অবশ্য লকুর মা,শিবমের মাসি করলেন।পল্টু আর খেদুকে খেতে বলা হলো।বাড়ির সবাই মিলে কচ্ছপের মাংস খেলো,কেবল শিবম খেলো না, আর ওর মাও খেলেন না।

যাই হোক,এবার ছুটিতে এসে শিবমের কচ্ছপ ধরার অ্যাডভেঞ্চার  ভালই লাগলো।স্মরনীয় একটা ঘটনা বটে।কিন্তু তখন শিবম চিন্তা করতে পারেনি যে তার জীবনে আরও অ্যাডভেনচার বাকি ছিলো!

 

সে ঘটনা বলে ফেলা যাক এবার।
বাড়ি ফিরতে আর তিনদিন বাকী আছে,গরমের ছুটি, এসময় তো গাছের আমগুলি বড় বড়,ডাঁসার কাছাকাছি,ওজনেও বেশ ভারী থাকে।আর গরম কালেই মাঝে মধ্যে ওঠে ঝড়,ধুপ ধাপ একের পর এক আম পড়তে থাকে গাছ তলায়.গাঁয়ের ছেলেরা কি তখন ঘরের মধ্যে ঝড়ের ভয়ে বসে
থাকতে পারে!

অবশ্য শিবমের ব্যাপার আলাদা,ওর মনের দিক থেকে এলার্জি আছে বলতে হবে.স্কুলের টিচার লুর ব্যাপার তার মনের ভিতর এমনি গেঁথে দিয়েছে যে সে গরমের দিনে রোদ্দুরে কোথাও বেরোতে চায় না।তবু সময় সুযোগ মূহুর্ত আমাদের প্রবল অনিচ্ছাকেও স্বেচ্ছায় বরণ করে নিতে প্ররোচিত করে।

এমনি এক ঝড়ের দিন ছিলো।বিকেল হয় হয় করছে,দু চার মিনিট আগেও রোদ ছিলো বেশ,এর মধ্যেই হাওয়া চলতে লাগলো,কোত্থেকে কালো মেঘের দল আকাশে মারামারি শুরু করে দিলো,ফলে বিদ্যূত চমকের সঙ্গে সঙ্গে হালকা বৃষ্টি শুরু হলো সে সঙ্গে দমকা হাওয়া চলতে লাগলো.
হাতে বেগ নিয়ে ছুটে আসলো লকু। শিবমকে বলল,চল আম কুড়াতে,সর্দারের আম বাগানে যাবো,চল, তাড়াতাড়ি চল।

শিবম একটু থমকালো,বাইরেটা দেখল,না রোদ নেই,মেঘের ফাঁক দিয়ে সামান্য রোদের ঝিলিক আছে। কিন্তু সেটুকু রোদ যেন হালকা বর্ষায় ভিজে যাচ্ছে। গরম অনেক কমে গেছে। পরক্ষণেই তার মন দোলা খেলে গেলো,সে দিনের মাছ ধরতে যাবার আনন্দ,রোমাঞ্চ,তার মনকে দুলিয়ে দিল। ঝড় বৃষ্টি, গ্রামের মাঠ ঘাট,ছুটে চলা মেঠো পথ যেন হাত ছানি দিয়ে তাকে ডেকে উঠলো। সে যেন ঝড়ে আম গাছের দুলুনি দেখতে পেল–ওরা যেন বলছে,আয়,আয়,আর ধুপ ধাপ আম গুলি মাটিতে পড়তে লাগলো!আয়,আয়,আজ আমরা সবাই আনন্দে মাতি!

লকু,হাতে টান দিয়ে,চল শিগগিরই,বলে শিবমকে টেনে নিয়ে চলল সর্দারের আম বাগানের দিকে। ঘর থেকে বের হবার পর শিবমকে আর টেনে নিয়ে যেতে হলো না,প্রকৃতির উত্ফুল্ল আনন্দে সেও মেতে  উঠলো,ওরা ছুটতে ছুটতে লাফাতে লাফাতে,কখনো দু হাত তুলে হই হই করতে করতে পৌঁছে গেলো সর্দারের আম বাগানে।

পল্টু খেদু আরও দু একটা ছেলে আগে থেকেই সেখানে হাজির ছিলো।শিবম,লকু পৌঁছতেই তাদের দিকে তাকিয়ে সবাই আনন্দের সামান্য হাসি ছড়িয়ে দিলো। ঝড়ের ঝাপটা এসে গাছ নাড়িয়ে দিয়ে গেলো,ধুপ ধাপ সমানে আম পড়ে যেতে লাগলো,লাফিয়ে লাফিয়ে ওরা সবাই আম কুড়োতে লাগলো। এখান থেকে ওখানে,এদিক থেকে ওদিকে ছোটা ছুটি করে এক সময় দেখল সবার আমের সব ব্যাগ ভরে গেছে।

এদিকে অন্ধকার ছুঁই ছুঁই করছে,ফিরছে ওরা,শিবমের হাতে আম ভরা ব্যাগ।চলতে চলতে শিবমের চোখে পড়ল,একটা পাখির ছানা। বড় একটা গাছের গোড়ায় গুটিয়ে শুটিয়ে পড়ে আছে।
–দাঁড়া ,একটা পাখির ছানা,লকুকে বলে,পাখীর বাচ্চাকে হাতে তুলে নিল শিবম,জ্যান্ত আছে ওটা, শরীর ভিজে কুঁকড়ে গেছে। শালিকের বাচ্চা,গাছের দিকে তাকালো শিবম,দুটো শালিক বসে আছে মনে হোলো,ও দুটোরই বাচ্চা হবে মনে হলো।পাখি দুতো শিবমের দিকে তাকিয়ে কিচ কিচ করে উঠল,লক্ষ্য করে দেখল,গাছের পাঁচ সাত হাত উপরেই পাখীর বাসা,একটা খোঁদল মত আছে,তাতে খড়কুটোয় ভর্তি।
–লকু, আয় এদিকে,পাখীর বাচ্চা পেয়েছি!শিবম বলে ওঠে।

 

লকু এগিয়ে আসে,দেখবে বলে,শালিকের বাচ্চা.এমনি সময় পাখীর মা বাবা হবে,ডেকে উঠলো ওদের ভাষায়,শিবমের মনে হলো ওদের বাচ্চার জন্য ওরা খুব দুঃখ পাচ্ছে!
শিবম বলল,ওই দেখ পাখীর ঘর,বাচ্চাটাকে ঘরে উঠিয়ে দে না!
লকুর এই সময় গাছে উঠতে ইচ্ছে হলো না,অনিচ্ছায় বলে উঠলো,আমি পারব না,তুই ওঠ,কিন্তু  সাবধান,অন্ধকার হয়ে গেছে,দেখবি গর্তে সাপ টাপ থাকতে পারে কিন্তু!

পাখীর মা বাবারা ঘন ঘন ডেকে উঠতে লাগলো,শিবম থাকতে পারলো না,বাচ্চাটাকে লকুর হাতে ধরিয়ে চড়ে গেলো গাছে.তারপর লকুর হাত থেকে বাচ্চা নিয়ে পাখীর বাসায় রাখল,আর অমনি সময় ঘ্যাঁচ করে কিছুতে কামড়ে দিলো ওকে। মনে হলো কয়েকটা ছোট ছোট দাঁত বিঁধে গেলো ওর হাতে। সামান্য লাগলো,কিন্তু প্রচন্ড ভয়ে ভয়ঙ্কর চীত্কার করে উঠলো শিবম। হাত ছেড়ে গিয়ে গাছের
নীচে এসে পড়ল।বিশেষ লাগেনি তার,কেবল ভয়ে জোরে জোরে চীত্কার করতে লাগলো।

অন্ধকারে কোথায়,কিসে কামড়ালো,ভলো ভাবে দেখা গেলো না কিছু,লকু আমের ব্যাগ ফেলে দিয়ে শিবমকে ধরে নিয়ে ছুটতে লাগলো বাড়ির দিকে। বাড়ি পৌঁছে ঘটনার কথা বলল।শিবমকে বিছানায় শুয়িয়ে দেওয়া হলো। দংশিত জাগার উপরে নিচে কাপড় দিয়ে বাঁধন দেওয়া হলো।জাগাটা থেকে অল্প অল্প রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। শিবমের মা মাসি কান্না কাটি করতে লাগলেন। শিবমের মেসো ডাক্তারের কাছে ছুটলেন,গ্রামের ওঝাকেও ডাকানো হলো।

শিবমের শরীর দুর্বল লাগছে,দংশনের জাগায় বেশ ব্যথা করছে। তবে খুব যে ব্যথা তা নয়!ওকে ভয়ে জড়সড় মনে হচ্ছে,আর হয়তো ও বাঁচবে না, ক্রমশঃ ওর মনে হতে লাগলো জ্ঞান শূন্য হয়ে যাচ্ছে।

ডাক্তার আর ওঝা এক সঙ্গে ঘরে ঢুকলেন,দু জনেই নিজের নিজের মত করে পরীক্ষা করতে লাগলযে। শিবমের ঘুম পাচ্ছে,মনে হচ্ছে ঘুমলে আর হয়তো সে কোনো দিন জাগবে না!বাড়িতে কান্না কাটির রোল পড়ে গেলো।
ডাক্তার বলে উঠলেন,বিষধর সাপ না।
ওঝা একই মত জানালেন।
দংশনের জাগা থেকে রক্ত বের হচ্ছিল,আর দংশিত জাগায় স্পষ্ট চারটে দাঁতের দাগ,ডাক্তার বাবু আর ওঝা এক মত হলেন,বিষধর সাপের কামড়ে দুটো দাগের দাগ থাকে,আর ক্ষত বেয়ে রক্ত পড়তে থাকে না। শিবমের দেহে চারটা দাঁতের দাগ,রক্তও অনেক গড়িয়ে পড়েছে। তা ছাড়া তার নাড়ির গতি,রক্ত চাপ সবই ছিলো স্বাভাবিক। শিবম এতটা সময় অজ্ঞানের ঘোরে ছিলো,বস্তুতঃ মনের দুর্বলতা ওকে জ্ঞান শূন্য করে রেখেছিল। ওর কানে যখন ডাক্তার বাবুর আর ওঝার কথা গেলো,ধীরে ধীরে ও স্বাভাবিক হয়ে এলো।

মা বাবা উত্কন্ঠায়,কান্না জড়িত গলায় ডেকে উঠলেন,শিবম,বাবা,এখন কেমন লাগছে?
শিবম তখন অনেক স্বাভাবিক হয়ে এসেছে–ও জবাব দিলো না কিছু,কিন্তু ওর মুখে ছড়িয়ে গেলো হালকা হাসির রেখা.
সে হাসির রেখা দেখে সবার সঙ্গে লকু,পল্টু,খেদুর মুখেও হাসি ফুটল।

 

 

দুঃখিত!