শিকারি ও ফাঁদ

রংধনু আসরের শিশুকিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? তোমরা নিশ্চয়ই এমন কিছু লোককে দেখেছো যারা প্রতারণা ও ধোঁকাবাজির মাধ্যমে অন্যকে ঠকিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করে। এসব লোক নিজেদের খুব বুদ্ধিমান বলে মনে করে। কিন্তু পবিত্র কোরআনে এদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, “তারা আল্লাহ ও ঈমানদারদেরকে ধোঁকা দিতে অথচ তারা বুঝতে পারে না যে, তারা নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে ধোঁকা দেয় না।”

কপটতাকে একটি আত্মিক রোগ হিসেবে আখ্যায়িত করে আমিরুল মোমেনীন হযরত আলী (আ.) বলেছেন,”কপটতাপূর্ণ লোকদের ব্যাপারে সতর্ক হও। কেননা তারা ভুলপথে পরিচালিত। তারা বিভ্রান্ত,তাদের অন্তর রুগ্ন এবং তাদের চেহারা অপবিত্র।”

 

ইমাম আলী (আ.) আরো বলেছেন,”কপট লোক নিজের তোষামোদকারী এবং অন্যের বদনামকারী।” তবে, কেবল মানুষই নয়, পশু-পাখির মধ্যেও প্রতারণা, কপটতা ও জুলুম নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। রংধনু  আসরে আমরা এ সম্পর্কেই একটি গল্প প্রচার করেছি। গল্পটি নেয়া হয়েছে   মাওলানা রুমীর মসনবী থেকে।

 

অনুষ্ঠানটি শোনার জন্য নিচের প্লেয়ারে ক্লিক করুন

 

অনেক দিন আগের কথা। একদিন এক শিকারী পাখি শিকারের জন্য এক বনে গেল। এদিক সেদিক ঘোরাফেরা করে শেষে এক জঙ্গলে শিকারের জন্য তার জাল পাতলো। জালের নিচে কিছু গম ও শস্যদানা ছড়িয়ে এবং নিজের গায়ে লতাপাতা জড়িয়ে সে একটি ঝোপের আড়ালে চুপটি করে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর একটি পাখি দুর থেকে উড়ে এসে- শিকারী যেখানে বসে ছিল- সেখানে এসে নামল। এরপর শস্যের দানা খোঁজা শুরু করলো। পাখিটি যখন শিকারীর একেবারে কাছে পৌঁছে গেল তখন শিকারীর ভীষণ হাঁচি পেল। হাঁচি থামানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ হলো এবং বিকট শব্দে তা বেরিয়ে গেল। হাঁচির শব্দ শুনে পাখিটি ভালভাবে তাকিয়ে দেখতে পেল যে, একটা লোক সারা গায়ে লতাপাতা জড়িয়ে ঝোপের আড়ালে বসে আছে।  লোকটিকে দেখে পাখিটি বললো : এই যে ভাই, তুমি কে ? সারা শরীরে লতাপাতা জড়িয়ে এখানে বসে কি করছো ?

শিকারী : আমি একজন সুফী দরবেশ। ইবাদাত-বন্দেগী করেই আমার দিন কাটে। দুনিয়াদারী ছেড়ে বনবাসী হয়েছি। এখানে বসেছি একটু নিরিবিল ধ্যান করবো বলে। কিন্তু তোমার কারণে মনে হয় তাও সম্ভব হবে না।

পাখি: আমি যদি তোমাকে কষ্ট দিয়ে থাকি তাহলে মাফ চাইছি। কিন্তু তুমি আমাকে বলো যে, বনবাদাড়ে ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থেকে ইবাদত-বন্দেগী করার নির্দেশ তুমি কোথায় পেয়েছে? তুমি কি জানো না সংসারধর্ম ত্যাগ করে  বৈরাগী হওয়া ভাল না ! তুমি কি শুননি-

“মানুষের খেদমত ছাড়া নেই কোন ইবাদত

তসবিহ, জায়নামাজ ও জোব্বায় নেই পথ।”

 

শিকারী :  তোমার কথা শুনে বুঝা যাচ্ছে, তুমি একটি সহজ সরল সাদাসিধে পাখি, মানুষ জাতিকে এখনো চিনতে পারো নি। তবে শুনে রাখ, দুনিয়ার মানুষ খুবই খারাপ, তারা কাউকেই শান্তিতে থাকতে দেয় না। তারা মিথ্যা বলে, ফাঁকি দেয়, অন্যকে ঠকায়। এছাড়া একজন আরেকজনের ওপর জুলুম করে। কিন্তু আমার অন্তরটা খুবই নরম। তাই এসব অনাচার সহ্য করতে না পেরে এই বনে আশ্রয় নিয়েছি।

পাখি : দুনিয়ার বেশীরভাগ মানুষই যে খারাপ, একথা তুমি ঠিকই বলেছো। কিন্তু তোমার দেখাদেখি সবাই  যদি বনবাসী হয় তাহলে তো দুনিয়ার কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাবে! তাছাড়া দুনিয়ার সকল নবী-রাসূল, অলি-আউলিয়া, জ্ঞানী-গুনি ও ভাল লোকেরা সবাই এই খারাপ মানুষদের সাথেই জীবন-যাপন করেছেন: তাদের সুখে সুখী এবং তাদের দুঃখে দুঃখী হয়েছেন। আমার তো মনে হয় দুনিয়া ছেড়ে একা একা নিজের চিন্তায় মশগুল হওয়া স্বার্থপরতা ছাড়া আর  কিছুই নয়।

শিকারী :   আমাকে তুমি স্বার্থপর বল আর যা-ই বলো তোমার কোন উপদেশ আমি মেনে নিতে পারছি না। আর আমি ঐ সংসারে আর ফিরে যেতেও চাই না। তুমি দয়া করে আমাকে একা থাকতে দাও।

পাখি : ঠিকাছে তুমি যখন কোন যুক্তি মানবে না তাহলে থাকো তোমার ইবাদত-বন্দেগী নিয়ে। তবে মনে রেখ, বৈরাগ্যবাদকে ইসলাম সমর্থন করে না।

 

 

এ কথা বলেই পাখিটি নিজের পথ ধরলো। কিন্তু কয়েক কদম যেতে না যেতেই দেখতে পেল বেশ কিঝু গম ও শস্যদানা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। এগুলোর উপর একটি জাল। পাখিটি মনে মনে ভাবলো, বনের ভেতর তো কোনসময় একটি গমও পাওয়া যায় না। কিন্তু এখানে এতো দানা এলো কোত্থেকে !

এসব  ভাবার পরও পাখিটি গম খাবার জন্য পা বাড়ালো না। তার মনে পড়লে দরবেশরূপী শিকারীর কথা। গম  খেতে গেলে লোকটি যদি বাধা দেয়! তাই সে ফিরে এসে শিকারীকে জিজ্ঞেস করলো :

পাখি: আচ্ছা দরবেশ সাব, এই গমগুলো কি তোমার ?

শিকারী: না, না, ওসব আমার হবে কেন? আমার কোন সহায় সম্বল নেই। তবে আমি যতদুর জানি ওগুলো দু’টি এতিম শিশুর সম্পদ। তুমি ওসবে মোটেও মুখ দিও না। তবে কেউ যদি খুবই অভাবী হয় কিংবা ক্ষুধায় জ্বালায় মরে যাবার মত হয় তাহলে এগুলো খেতে পারে। যাকগে বাপু এসব নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই।

পাখি : ভাগ্যের নির্মম পরিহাস,আমি আসলেই খুব অভাবী। ক্ষুধার জ্বালায় একেবারে মরে যাচ্ছি। আমার মত ক্ষুধার্তের জন্য মরা লাশ খাওয়াও বৈধ বলে আমি মনে করি।

শিকারী :  আমি বাপু এসব কিছু বুঝি না। তুমি তোমার অবস্থা ভাল জানো। তবে কথা হলো, প্রকৃত অভাবী না হলে এসব খাওয়া তোমার জন্য গুনাহ হবে। আর অভাবী হলে তুমি নিশ্চিন্তে এগুলো খেতে পারে। তোমাকে তো আর কেউ বাধা দিচ্ছে না।

 

শিকারীর কথা শুনে পাখিটি কিছুক্ষণ চিন্তা করলো। এরপর এগিয়ে গেল সামনে এবং খাওয়া শুরু করলো। কিন্তু  পয়লা দানা মুখে দেবার পরই সে দেখতে পেল তার পা দু’টি জালের সাথে আটকে গেছে ; জাল থেকে বেরিয়ে আসার কোন পথই নেই। পাখিটি এবার বুঝতে পারলো যে, শিকারী তাকে ফাঁকি দেয়ার জন্যই দরবেশ সাজার ভান করেছে।  এদিকে শিকারী যখন দেখলো যে, পাখিটি জালে আটকা পড়েছে তখন সে লতাপাতার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো এবং পাখিটিকে ধরার জন্য হাত বাড়ালো। এ সময় পাখিটি বলল :

 

পাখি : কী যে ভুল করেছি তা এতোক্ষণে বুঝতে পারছি।  একজন  ভণ্ড দরবেশ, লোকদেখানো সুফি  ও প্রতারকের কথায় বিশ্বাস করার মাশুল এখন আমাকে দিতে হচ্ছে।

 

শিকারী :  আমাকে ভণ্ড বল কিংবা  যাই বলো তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। তবে আমি আমার  সাধনার পুরষ্কার পেয়ে গেছি। এখন তুমি গম খাও আর আমি খাবো তোমাকে। তবে একটা কথা মনে রেখ, তোমার লোভই তোমাকে প্রতারণা করেছে।

পাখি : আমাকে লোভী বলছো তুমি?  আরে আমি তো অভাবে পড়ে গম খেতে গেছি। আমি দোষ করেছি এ কথা তোমার মত ভন্ড ছাড়া আর কেউ বলবে?

দরবেশ : তোমার চিন্তা করা উচিত ছিল যেখানে গম আছে সেখানে যমও আছে। তুমি নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছো-এখন আর কিছুই করার নেই।   #

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!