শাহারবনু’র গল্প-১

বাবা-মায়ের আদরের মণি শাহরবনু দেখতে দেখতে সাত বছরে পড়লো। বাবা মেয়েকে নারী শিক্ষকের কাছে পাঠিয়ে দিলো পড়ালেখা শেখার জন্য। এই নারী শিক্ষকের তৎকালীন পরিভাষা ছিল মোল্লাবাজি। মোল্লাবাজির ছাত্ররা তাকে যে ধরনেরই উপহার দিতো শাহরবনু’র উপহারটা হতো একবারেই ভিন্নরকমের এবং উন্নত।শিক্ষকের মনে কৌতূহল জাগলো। কৌশলে শাহরবনু’র কাছ থেকে কথা বের করার চেষ্টা করলো তার বাবার অবস্থা কেমন, কী কাজ করে ইত্যাদি। শাহরবনু বুঝে উঠতে পারে নি তার শিক্ষক মোল্লাবাজি মনে মনে কী ছক কেটে রেখেছে সেজন্য সরলভাবে সে তার জীবনের সবকিছুই মোল্লাবাজিকে বলে দিলো।
  মোল্লাবাজি তো শাহরবনু’র কথা শুনে বুঝতে পেরেছে যে তার বাবা অঢেল টাকা-পয়সার মালিক। তাদের জীবনে কোনো কিছুর কমতি নেই। মোল্লাবাজি মনে মনে ফন্দি আঁটলো এবং সেদিন থেকে শাহরবনুকে আরো কাছে টানার চেষ্টা করলো। তাকে এতো বেশি আদর যত্ন করতে শুরু করলো যেন ‘মায়ের চেয়ে খালারই দরদ বেশি’। শাহরবনুও আদরযত্নে একেবারে মোল্লাবাজিতে অন্ধ হয়ে গেল। মোল্লাবাজি যদি বলতো ‘দই তো কালো’ সে প্রশ্নহীনভাবে তাই মেনে নিতো। এভাবে কাটতে লাগলো দিনের পর রাত, সপ্তার পর মাস। একদিন মোল্লাবাজি শাহরবনু’কে একটা বাটি দিয়ে বললো: এই বাটিটা তোমার মা কে দেবে এবং আমার সালাম জানাবে। তারপর বলবে বাটিটা যেন সির্কা দিয়ে ভরে স্কুলে পাঠায়।
  আবার বলেও দিয়েছে যখন তার মা গুদামঘরে যাবে সিরকা আনতে শাহরবনুও যেন তার পিছনে পিছনে যায় এবং বলে যে মোল্লাবাজি সাত বছরের সিরকা নিতে বলেছে। কোনোভাবেই যেন মাটির সপ্তম জার ছাড়া অন্য কোনো জার থেকে সিরকা না নেয়। ফলে এক এক করে সপ্তম জারের কাছে গিয়ে মুখ খুলে যখন সিরকা নিতে জারের ভেতরে মাথা দিয়ে কুঁজো হবে তার মা, তখন যেন মায়ের দু’পা উপরে তুলে জারের ভেতরে ফেলে দেয় এবং জারের মুখটা বন্ধ করে দেয়। শাহরবনু তো একদম অক্ষরে অক্ষরে মোল্লাবাজি’র কথা অনুসরণ করে মাকে জারের ভেতর ফেলে দিয়ে মুখ আটকে দেয়। এদিকে রাতের বেলা বাবা ঘরে ফিরে যখন দেখলো তার স্ত্রী ঘরে নেই শাহরবনুকে জিজ্ঞেস করলো: তুমি একা কেন, তোমার মামনি কোথায়? শাহরবনু বললো: জানি না। স্কুল থেকে বাসায় ফিরে মাকে দেখি নি।   পরদিন শাহরবনু যথারীতি স্কুলে গিয়ে যা যা সে করেছে মোল্লাবাজিকে সবকিছু খুলে বললো। মোল্লাবাজি সব কথা শুনে খুশি হয়ে গেল এবং শাহরবনুকে জড়িয়ে ধরে তার মাথার ওপর হাত বুলিয়ে দিয়ে কপালে চুমু খেলো। কিছুদিন পর মোল্লাবাজি এক মুঠো খকশির দিলো শাহরবনুর হাতে। খকশির হলো কাউনের মতো ছোটো ছোটো দানা। কাঁঠালি রঙের ওই দানা দিয়ে শরবৎ তৈরি করা হয়। শুকনো ওই দানা শাহরবনুকে দিয়ে মোল্লাবাজি বললো: বাসায় ফিরে এই খকশির তোমার মাথায় ঢালবে। যখন তোমার বাবা বাসায় ফিরবে তখন কাবাব তৈরি করার মানগাল বা কয়লার আগুন ভর্তি চার কোণা পাত্রের ওপর চুল ঝাড়বে যাতে খকশির কয়লার আগুনে পুড়ে টুস টাস শব্দ হয়।
বাবা যখন জিজ্ঞেস করবে কীসের শব্দ হচ্ছে?  তখন যেন বলে: ‘তার মাথায় প্রচুর উকুন জন্মেছে। তাকে তো দেখার কেউ নেই। কে তার বিছানাপাতি পরিষ্কার করবে, কে তাকে গোসল করাবে। আমার তো মা নেই। যদি মা থাকতো তাহলে কি তার এই দশা হতো’! এই বলে শাহরবনু কেঁদে দেয়। শাহরবনু কেঁদে ফেলায় তার বাবা তার মাথায় হাত বুলাতে গেলে শাহরবনু বলে: ‘তুমি আরেকটা বিয়ে করো। তাহলে নতুন মা আমাকে আদর যত্ন করবে, আমার ঘর পরিচ্ছন্ন রাখবে, আমাকে গোসল করাবে, সাজাবে গুছাবে, আর কোনো সমস্যা থাকবে না’। বাবা জিজ্ঞেস করে: আবার কাকে বিয়ে করতে যাবো!   শাহারবনু মোল্লাবাজির শিখিয়ে দেওয়া কথাগুলো ফরফর করে বলে দিলো: ‘বাবা তুমি কিছু কলিজা কিনে আনো। ওই কলিজা বাড়ির গেইটে ঝুলিয়ে রাখবে। যেই মহিলা প্রথম আসবে এবং যার মাথা ওই কলিজায় লাগবে ঠিক তাকেই তুমি বিয়ে করবে’। বাবা মেয়ের কথা মেনে নিয়ে ঠিক তাই করলো। পরদিন সকালে বাজারে গিয়ে কলিজা কিনে এনে দরোজায় ঝুলিয়ে রাখলো।   এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল মোল্লাবাজি। প্রতি মুহূর্তেই সে কান খাড়া করে রাখছিল কী হয় না হয়। হঠাৎ করেই সে আবির্ভূত হলো এবং খোঁজখবর নেওয়ার অজুহাতে বাসায় ঢুকতে চাইলো।
কিন্তু বাসায় ঢোকার সময়ই সে বলতে লাগলো: ‘ওহ হো! মাথাটা আমার ব্যথা করছে। কী ঝুলিয়ে রেখেছো দরোজায় মাথায় লেগে আমার জামা-কাপড় সব রক্তে ভরে গেছে’। মোল্লাবাজির সরব কথাবার্তা শুনে শাহরবনুর বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে মূল গেইটে গিয়ে মহিলার কাছে ক্ষমা চাইলো এবং কলিজা ঝুলিয়ে রাখার নেপথ্য ঘটনা খুলে বললো। মোল্লাবাজি ঘটনা শুনে বিয়েতে রাজি হয়ে গেল এবং শাহরবনুর বাবা মোল্লাবাজিকে নিয়ে গেল কাজির কাছে। আকদ করে মোল্লাবাজির হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেল।

শাহ্‌রবনু’র গল্প -২

ইউসুফ ও জুলেখা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *