শহীদ ইয়াহইয়া (আঃ)

তাঁর জন্ম আল্লাহর একটি নিদর্শন

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সমস্ত ক্ষমতার উৎস ও মালিক। এই পৃথিবীর সব তাঁর সৃষ্ট প্রাকৃতিক নিয়মে চলে। সব কিছুই তাঁর বেধে দেয়া নিয়ম ও বিধানের অধীন। কোনো কিছুতে তাঁর বেধে দেয়া নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটলে তা হয়ে যায় ধ্বংস। তাঁর বেধে দেয়া সুনির্দিষ্ট নিয়মেই জন্ম হয় সব মানুষের। নিয়ম যেহেতু তিনিই তৈরি করেছেন, তাই নিয়মের ব্যতিক্রম কিছু করলে তিনিই করতে পারেন, আর কেউ নয়। কখনো কখনো তিনি মানুষ সৃষ্টির ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যতিক্রম কিছু করেছেন। বাবা মা ছাড়াই সৃষ্টি করেছেন আদম ও হাওয়াকে। বাবা ছাড়া শুধু মা থেকেই সৃষ্টি করেছেন হযরত ঈসা (আঃ) কে। আবার প্রায় শতায়ু বৃদ্ধ পিতা ইবরাহীম এবং অনুরুপ বৃদ্ধা-বন্ধ্যা মাতা হযরত সারাহকে দান করেছেন পুত্র ইসহাককে। এই একইরকম ঘটনা ঘটেছে হযরত ইয়াহিয়ার ক্ষেত্রে। প্রায় শতায়ু বৃদ্ধ পিতা হযরত যাকারিয়া এবং অনুরুপ বৃদ্ধা-বন্ধ্যা মাতার ঘরে জন্ম নিয়েছেন হযরত ইয়াহিয়া (আঃ)।

আপনারা হয়তো যাকারিয়ার জীবনীতে দেখেছেন, তাঁর কোন সন্তান ছিল না। বৃদ্ধ বয়সে বন্ধ্যা স্ত্রীর ঘরে তিনি আল্লাহর কাছে আল্লাহর পছন্দনীয় সন্তান প্রার্থনা করেন। মহান আল্লাহ তাঁর দোয়া কিবুল করে বলেন, তুমি সন্তান পাবে। আল্লাহ তাঁকে সুসুংবাদ দেন এভাবে –

“যাকারিয়া যখন মেহরাবে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করতেছিলো তখন ফেরেস্তারা তাঁকে ডেকে বললো – আল্লাহ আপনাকে ইয়াহিয়ার সুসংবাদ দিচ্ছেন। সে (অর্থাৎ ঈসা আঃ) আল্লাহর একটি হুকুমকে সত্যায়িত করবে। সে হবে একজন নেতা, সততার প্রতীক এবং একজন সংস্কারক নবী।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৩৯)

সূরা মরিয়মে বলা হয়েছে – “হে যাকারিয়া, তোমার প্রার্থনার প্রেক্ষিতে আমি তোমাকে একটি পুত্রের সুসংবাদ দিচ্ছি। তাঁর নাম হবে ইয়াহিয়া। এ নামে কোন লোক আমি এর আগে সৃষ্টি করিনি।” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ৭)

সূরা আল আম্বিয়াতে বলা হয়েছে –

“আমি তাঁর দোয়া কবুল করেছি আর তাঁকে ইয়াহিয়াকে দান করেছি আর এজন্যে তাঁর স্ত্রীকে যোগ্য করে দিয়েছিলাম গর্ভ ধারন করার জন্যে। কারন তারা কল্যাণের কাজে আপ্রান চেষ্টা করতো, ভয় আর আশা নিয়ে আমাকে ডাকতো এবং আমার প্রতি ছিলো তারা অবনত। ” (সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৯০)

এভাবেই মহান আল্লাহ তাঁর বিশেষ কুদরতে বৃদ্ধ পিতা মাতার ঘরে জন্মের ব্যবস্থা করেন হযরত ইয়াহিয়ার। আল কুরআন থেকে আমরা একথাও জানতে পারলাম যে, ইয়াহিয়া নামটি সরাসরি আল্লাহর দেয়া নাম। মহান আল্লাহই পিতা যাকারিয়াকে নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর পুত্রের নাম যেন ইয়াহিয়া রাখা হয়।

 

ইয়াহিয়া ও ঈসা

হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) হযরত ঈসা (আঃ) এর তিন বা ছয় মাসের বড়। তারা ছিলেন নিকটাত্মীয় এবং পরস্পরের বন্ধু। তারা একজন আরেকজনকে ভাই বলে সম্বোধন করতেন। বয়স ত্রিশ বছর হবার পূর্বেই আল্লাহ তায়ালা হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) কে নবুয়্যত দান করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী, সত্তপন্থী, আল্লাহভীরু এবং পবিত্র জীবনের অধিকারী। হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) ছিলেন হযরত ঈসা (আঃ) এর সত্যায়নকারী। হযরত ঈসা ছিলেন আল্লাহর বিশেষ নির্দেশ (কালেমা)। আল্লাহর নির্দেশে পিতা ছাড়াই তাঁর জন্ম হয়। লোকেরা তাঁর ব্যাপারে বিভিন্ন মোট প্রকাশ করতে থাকে। হযরত ইয়াহিয়া আল্লাহর পক্ষ থেকে ঈসার বিষয়ে সত্য তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি ঘোষণা করেন আল্লাহর নির্দেশে বিনা বাপেই ঈসার জন্ম হয়েছে। তিনি আল্লাহর দাস ও রাসুল। আপনারা ঈসাকে আল্লাহর রাসুল হিসেবে গ্রহন করুন এবং তাঁর আনুগত্য করুন।

 

পাঁচটি কাজের নির্দেশ

হযরত ইয়াহিয়া ছোট বেলা থেকেই সব সময় আল্লাহর ভয়ে আল্লাহর ইবাদাতে মশগুল থাকতেন। আল্লাহর প্রতি বিনয়, আনুগত্য ও ইবাদাতের মাধ্যমে নিজের আত্মাকে অনেক উন্নত করেন। এরি মধ্যে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে নির্দেশ দেন-

“হে ইয়াহিয়া, আল্লাহর কিতাবকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরো। ” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ১২)

এখানে আল্লাহর কিতাব বলতে তাওরাতকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা হযরত ইয়াহিয়াকে তাওরাতের বিধান কায়েম করতে এবং মানুষকে এ কিতাবের বিধান মতো জীবন যাপন করবার আহবান জানাতে নির্দেশ দেন।

তিরমিযি, ইবনে মাযাহ ও মুসনাদে আহমাদে হারেস আশয়ারী থেকে বর্ণিত একটি হাদিস থেকে জানা যায়, আল্লাহ তায়ালা হযরত ইয়াহিয়াকে হুকুম দিয়েছিলেন মানুষকে বিশেষভাবে পাঁচটি কাজের নির্দেশ দিতে। এ হাদিসে আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সঃ) বলেন –

“আল্লাহ তায়ালা ইয়াহিয়া ইবনে যাকারিয়াকে বিশেষভাবে পাঁচটি কাজের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এই পাঁচটি কাজ যেন তিনি নিজে করেন এবং বনী ইসরাইলকে করবার নির্দেশ দেন। কোন কারনে বনী ইসরাইলকে এই পাঁচটি কাজের নির্দেশ দিতে তাঁর বিলম্ব হয়। ফলে হযরত ঈসা তাঁকে বললেন – আল্লাহ পাক আপনাকে পাঁচটি কাজ করতে এবং বনী ইসরাইলকে করবার জন্যে নির্দেশ দিতে বলেছেন। সে নির্দেশ কি আপনি তাঁদের পৌছাবেন না আমি পৌছাবো? ইয়াহিয়া বললেন- হে ভাই, আমার আশংকা হয়, আপনি যদি আমার আগে পৌঁছান তাহলে আল্লাহ আমাকে শাস্তি দেবেন বা জমিনের নীচে ধসিয়ে দেবেন।

অতপর তিনি বনী ইসরাইলকে বাইতুল মাকদাসে সমবেত করলেন। মানুষে মসজিদ পূর্ণ হয়ে গেলো। তখন তিনি মসজিদের মিম্বরে উঠলেন। আল্লাহর প্রশংসা ও গুনাবলী করলেন এবং বললেন – হে জনগন, আল্লাহ আমাকে পাঁচটি কাজের নির্দেশ দিয়েছেন যেনো আমি নিজে সেগুলো পালন করি এবং তোমাদেরকেও সেগুলো পালন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। শুনো সেগুলো হলো –

১। তোমরা শুধুমাত্র আল্লাহর আনুগত্য এবং দাসত্ব করবে। তাঁর সাথে কাউকেও শরীক করবেনা।

২। তোমাদের তিনি নির্দেশ দিয়েছেন সালাত কায়েম করতে।

৩। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন সিয়াম পালন করতে।

৪। তিনি তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন দান করতে।

৫। তিনি তোমাদের আরো নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর স্মরণে তোমাদের জবানকে সিক্ত রাখতে। (এতোটুকু বলার পরে আমাদের প্রিয় নবী সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলেন) আমিও তোমাদের পাঁচটি কাজের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছি। এই পাঁচটি কাজের নির্দেশ আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। সেগুলো হলো –

১। সব সময় জামায়াত বদ্ধ থাকবে।

২। নেতার নির্দেশ স্রবণ করবে।

৩। নেতার নির্দেশ পালন করবে।

৪। হিজরত করবে (অর্থাৎ মন্দ কাজ ত্যাগ করবে বা এমন আবাসভূমি ত্যাগ করবে যেখানে বসে আল্লাহর হুকুম পালন করা সম্ভব নয়)।

৫। আল্লাহর পথে যিহাদ করবে। (অতপর তিনি বলেন) সাবধান, যে ব্যাক্তি জামায়াত থেকে এক বিঘত সরে যাবে, সে মূলত নিজের গলা থেকে ইসলামের রশিই খুলে ফেলবে। তবে পুনরায় জামায়াতে ফিরে আসলে ভিন্ন কথা।” (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযি, ইবনে মাজাহ)

বেশ হয়েছে, হযরত ইয়াহিয়ার পাঁচটি নির্দেশের সাথে আমরা আমাদের প্রিয় নবীর আরো পাঁচটি নির্দেশও পেয়ে গেলাম। আসলে হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) অত্যন্ত মানব দরদী নবী। আল কুরআনে তাঁর একটি মহৎ গেনের কথা উল্লেখ করে মহান আল্লাহ বলেন –

“আমি নিজের পক্ষ থেকে তাঁকে দান করেছি হৃদয়ের কোমলতা।” (আল কুরআন ১৯ ; ২৩)

 

দাওয়াত দান, পাপ কাজে বাধাদান ও শাহাদাৎ

হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) বনী ইসরাইলকে শিরক, বিদআত ও যাবতীয় মন্দ কাজ ত্যাগ করার দাওয়াত দিতে থাকেন। তাঁদেরকে শুধু এক আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য করতে এবং সততার সাথে চলতে আহবান জানাতে থাকেন। তিনি ট্রান্স জর্ডান এলাকায় তাঁর দাওয়াতী কাজ সম্প্রসারন করেন। মানুষকে তিনি পাপ কাজ থেকে তওবা করাতেন এবং যারা তওবা করতেন তাঁদেরকে ব্যাপটাইজ বা গোসল করাতেন। সেজন্যে তিনি ব্যাপটিষ্ট ইয়াহিয়া নামে পরিচিতি লাভ করেন। হযরত ইয়াহিয়ার সময় ইহুদীদের শাসক ছিলো হিরোদ এন্টিপাস। হিরোদ ইহুদী সমাজে রোমীয় নগ্ন সভ্যতার সয়লাব বিয়ে দেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে যিনা, ব্যাভিচার, নগ্নতা, বেহায়াপনতা ও চরিত্রহীনতার প্রসার ঘটানো হতে থাকে। হিরোদ নিজেই ব্যাভিচার ও পাপাচারে লিপ্ত হয়। হযরত ইয়াহিয়া তাঁর অনৈতিক পাপাচারের প্রতিবাদ করতে থাকেন। হিরোদ নিজের অবস্থা বেগতিক দেখে হযরত ইয়াহিয়াকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে ফেলে রাখে। চরিত্রহীনরা দেখলো, হযরত ইয়াহিয়া মানুষের মাঝে সৎকর্ম ও পবিত্র জীবন যাপনের যে চেতনা সৃষ্টি করেছেন, তাঁর ফলে মানুষ তাঁদের চরমভাবে ঘৃণা করছে। তাঁদের বিরুদ্ধে বেড়েই চলেছে মানুষের ক্ষোভ। কারন মানুষ দেখলো, আল্লাহর নবীকে আটকে রাখা হয়েছে কারাগারে আর পাপিষ্ঠদের লালন করছে সরকার। এমতাবস্থায় শাসক হিরোদ তাঁর এক পালিত নর্তকীর আবদারে হত্যা করলো আল্লাহর নবী হযরত ইয়াহিয়া –কে। তাঁর মস্তক দ্বিখণ্ডিত করে উপহার দিলো নর্তকীকে। এভাবেই বনী ইসরাইলের বদবখত লোকেরা একের পর এক আল্লাহর নবীকে হত্যা করে। এদের সম্পর্কেই আল কুরআনে বলা হয়েছে –

“যারা আল্লাহর আয়াতকে অস্বীকার করে, অন্যায়ভাবে হত্যা করে আল্লাহর নবীদেরকে আর ঐ সব লোকদেরকে যারা ন্যায় ও সুবিচারের নির্দেশ দেয়, এসব অপরাধীদেরকে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ২১)

 

আমাদের নবীর সাথে সাক্ষাত

আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এর যখন মে’রাজ হয়, তখন তাঁর সাথে হযরত ইয়াহিয়ার সাক্ষাত হয়। হযরত জিবরীলের সাথে প্রিয় নবী আকাশ পেরিয়ে উপরে উঠছিলেন।

তিনি বলেন –

“অতপর যখন দ্বিতীয় আকাশে পৌঁছলাম দেখলাম, সেখানে ইয়াহিয়া ও ঈসা। তারা দু’জন পরস্পর খালাতো ভাই। জিবরীল আমাকে বললেন – এরা ইয়াহিয়া ও ঈসা এদের সালাম করুন। আমি তাঁদের সালাম করলাম। তারা সালামের জবাব দিয়ে বললেন- মারহাবা-স্বাগতম হে আমাদের মহান ভাই ও মহান নবী।” (সহীহ বুখারী)

 

আল কুরআনে হযরত ইয়াহিয়া

আল কুরআনে হযরত ইয়াহিয়ার নাম উল্লেখ হয়েছে পাঁচবার। যেসব আয়াতে উল্লাখ হয়েছে সেগুলো হল- সূরা আলে ইমরান ; ৩৯। সূরা আল আনয়াম ; ৮৫। সূরা মরিয়ম ; ৭, ১২। সূরা আল আম্বিয়া ; ৯০। কুরআন মাজীদে হযরত ইয়াহিয়ার মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে-

“আমি শৈশবেই তাঁকে প্রজ্ঞা দান করেছি এবং দান করেছি নিজের পক্ষ থেকে কোমলতা ও পবিত্রতা। সে ছিল খুবই আল্লাহভীরু আর বাবা মার অধিকারের ব্যাপারে সচেতন। সে উদ্যত ছিলনা আবার অবাধ্যও ছিলনা। তাঁর প্রতি সালাম যেদিন তাঁর জন্ম হয় যেদিন তাঁর মরন হয় এবং যেদিন উঠানো হবে তাঁকে জীবিত করে। ” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ১২-১৫)

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!