শয়তানের সাথে এক রাত : স্টিফেন ভিনসেন্ট বেনেট

চুল্লির মধ্যে আগুন প্রায় নিবু নিবু। বাহিরে ভোরের বাতাস বইছিল। ঘরের ভিতর আলো ধুসর রঙ ধারণ করল যখন দানিয়েল ওয়েবস্টার তার কথা শেষ করলেন। তার কথা যেন ভেসে আসছিল নিউ হ্যাম্পশায়ার থেকে। এমন একটা স্থান হতে, ভূমির ওপর যে স্থানটাকে সবমানুষ ভালবাসে। তিনি তার একটা চিত্র আঁকলেন এবং প্রত্যেক জুরি ও জর্জকে বললেন তাদের দীর্ঘ বিস্মৃতির কথা। তিনি সবার হৃদয় স্পর্শ করতে পারলেন যা তাঁর জন্য ছিল তাঁর শক্তিমত্তার পুরষ্কার। তাঁর কণ্ঠ কারো কাছে ছিল অরণ্য ও তার রহস্যের মত আর কারো কাছে ছিল সাগর ও তার গর্জনের মত। এর মধ্যে কেউ দেখে তার জাতীর কান্না আর কেউ দেখে খুব ছোটখাট ক্ষতিকর দৃশ্য যা কখনো স্মরণ করার মত নয়। কিন্তু প্রত্যেকেই কিছু না কিছু দেখে। যখন দানিয়েল ওয়েবস্টার শেষ করলেন তখনো তিনি বুঝতে পারেননি জাবেজ স্টোনের জন্য তিনি কিছু করতে পেরেছেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তিনি একটা ভেলকি দেখিয়ে দিয়েছেন। তাদের চোখের সে উজ্জ্বলতা আর থাকল না। মুহূর্তের জন্য তারা আবার যেন মানুষ হয়ে গেল।

“আত্মপক্ষ সমর্থন শেষ” দানিয়েল বললেন। তিনি পর্বতের মত দাঁড়িয়ে থাকলেন। তাঁর কানে এখনো তাঁর কথাগুলো বেজে চলছে। তিনি ততক্ষণ পর্যন্ত যেন কিছুই শোনেননি যতক্ষণে জর্জ হেথর্ন বলল, “জুরিবর্গকে মামলার রায় বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ করছি।”
ওয়াল্টার বাটলার তার জায়গায় উঠে দাঁড়াল। তার মুখমণ্ডল অন্ধকার। তবুও গর্বের আভাস সেখানে। “জুরিবর্গ এ মামলার রায় বিবেচনা করেছেন” পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে বিদেশীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা জাবেজ স্টোনের মুক্তি প্রস্তাব করছি।”
সেই সাথে বিদেশীর মুখের হাসি উবে গেল কিন্তু ওয়াল্টার বাটলার থামেনি। “সম্ভবত এরায় প্রমাণের সাথে যথাযথ সামঞ্জস্যশীল নয় তবুও মি. ওয়েবস্টারের বাক পটুতাকে নরকবাসী সম্মান করে।”
মোরগের ডাক সকালের ধুসর আকাশটাকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিল। জর্জ ও জুরিবর্গ কামরা থেকে বের হয়ে গেল একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মত যেন তারা কখনো এখানে ছিল না। বিদেশী দানিয়েল ওয়েবস্টারের দিকে ফিরল এবং একটুকরো বিকৃত হাসি হেসে বলল, “মেজর বাটলার একজন ধৃষ্ট লোক। আমি ভাবিনি সে এতটা ধৃষ্ট হতে পারে। যাহোক, আপনার প্রতি আমার অভিনন্দন, যেরকম দু’জন ভদ্র লোকের মধ্যে হওয়া উচিৎ।”
“যদি কিছু মনে না করেন” দানিয়েল বললেন, “প্রথমত কাগজটা চাইব।” তিনি চুক্তিপত্রটা নিয়ে চার টুকরো করে ফেললেন। “আর এখন আপনাকে দরকার।” তাঁর একটা হাত ভাল্লুকের মত বিদেশীর একটা বাহুকে আঁকড়ে ধরল।
বিদেশী হাত মুচড়িয়ে ছুটতে চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। “উহ্ মি. ওয়েবস্টার ছাড়–ন। অর্থস্বল্পতা হাস্যকর। যদি আপনার সমস্যা হয় তবে ব্যয়ভার আমিই বহন করব। তাহলে আমিও গর্ববোধ করতাম।”
“অবশ্যই আপনিই বহন করবেন” দানিয়েল বললেন, “আপনি বসুন, এইমর্মে একটা প্রমাণপত্র করে দিয়ে যান যে, আর কখনো জাবেজ স্টোনকে বিরক্ত করবেন না এমনকি তার চুলটিকেও না। আর কেয়ামত পর্যন্ত অন্য কোন নিউ হ্যাম্পশায়ারকেও নয়। যে কোন নরক আমরা আমাদের রাজ্য থেকে উপড়ে ফেলে দেব। কোন বিদেশীর সাহায্য ছাড়াই আমরা তা পারব।”
“উহ্! তারা কখনো সফল হবে না। কিন্তু উহ্  আমি মেনে নিলাম।”
বিদেশী বসল এবং একটা দলিল করে দিল। কিন্তু দানিয়েল ওয়েবস্টার তার কলার ধরে রাখলেন।
“এখন আমি যেতে পারি?” লোকটি বলল নরম কণ্ঠে। দানিয়েল ওয়েবস্টার দেখে নিলেন দলিলটা যথযথ কিনা।
“যাবেন?” দানিয়েল তাকে একটা ধাক্কা দিয়ে বললেন, “আমি ভাবছি আপনার সাথে আমার কিরূপ ব্যবহার করা উচিৎ কারণ আপনি লেনদেনটা মীমাংসা করে দিলেও আমার সাথে আপনার কোন মীমাংসা হয়নি। আমি ভাবছি আপনাকে মার্শফিল্ডে নিয়ে যাব।” একটু ভেবে আবার বললেন, “সেখানে গোলিয়েথ নামের একটা মেষ আছে। গুতিয়ে লোহার দরজা ছিদ্র করতে পারে। আমি আপনাকে তার সামনে ছেড়ে দিয়ে দেখতে চাই সে আপনাকে নিয়ে কি করতে পারে।”
এরপর বিদেশী অনুনয় বিনয় শুরু করল। এতটা নরম হয়ে লোকটা অনুনয় করতে থাকল যে দানিয়েল ওয়েবস্টার সত্যিকারের একজন নরম দিলের মানুষ, শেষে তাকে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। বিদেশীকে প্রচণ্ড কৃতজ্ঞ মনে হল। বন্ধুসুলভ মনোভাব দেখিয়ে সে দানিয়েল ওয়েবস্টারের ভাগ্য গণনা করতে চাইল। তিনি রাজি হলেন যদিও এর আগে কখনো ভাগ্য গণনা করেননি।
তাঁর কাছে বিদেশীকে কিছুটা অন্যরকম মনে হল। সে গর্বিত চিত্তে দানিয়েলের হাতের রেখাগুলো দেখতে থাকল। সে অনেকগুলো লক্ষণীয় ঘটনার কথা বলল কিন্তু সবই অতীতের ঘটনা।
“সবই তো অতীতের কথা এবং সত্যই বটে। ভবিষ্যতের কথা বলুন।”
বিদেশী খুশি হয়ে পুনরায় হস্তরেখা পাঠ করতে থাকল। “ভবিষ্যত আপনি যেরূপ ভাবছেন সেরূপ নয়। কিছুটা অন্ধকার। আপনার একটা বিরাট উচ্চাকঙ্খা আছে মি. ওয়েবস্টার।”
“হ্যাঁ, আছে” দানিয়েল সহজভাবে বললেন। সবাই জানত তিনি প্রেসিডেন্ট হতে চাইতেন।
“মনে হচ্ছে আপনার আয়ত্বের ভিতরে কিন্তু অর্জন করতে পারবেন না। সবলোক তো আর প্রেসিডেন্ট হতে পারে না আর আপনিও তা এড়িয়ে যাবেন।”
“যখন আমি প্রেসিডেন্ট হতে পারব তখনও দানিয়েল ওয়েবস্টারই থাকব। বলে যান”
“আপনার দু’জন সামর্থবান সন্তান থাকবে, ছেলে।” বিদেশী বলল তার মাথা দুলিয়ে, কিন্তু দু’জনেই যুদ্ধে মারা যাবে।”
“বেঁচে থাকুক আর মারা যাক তারা সব সময়ই আমার সন্তান।”
“আপনি অনেক মহান বানী বলেছেন। এরকম আরো বলবেন।”
“আহ! বলে যান।”
“কিন্তু শেষে এ মহান বানীগুলো আপনার বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হবে। তারা আপনাকে ‘আইকেবোর্ড’ (কোথায় গর্ব) বলে ডাকবে। তারা আপনাকে আরও অন্যান্য নামেও ডাকবে। এমনকি নিউ ইংল্যান্ডের কিছু লোক বলবে, আপনি বিশ্বাস ঘাতকতা করে নিজের দেশকে বেচে দিয়েছেন। আর আপনার মৃত্যুর পর তাদের কণ্ঠ আরও শক্তিশালী হবে।”
“সুতরাং বানীটি নির্ভুল, মানুষ কি বলল সেটা কোন ব্যপার নয়” দানিয়েল বললেন। তারপর তিনি বিদেশীর দিকে তাকালেন পলকহীনভাবে।
“একটা প্রশ্ন” বললেন তিনি, “আমি সারাজীবন ইউনিয়নের জন্য লড়েছি। আমি কি তাদের বিরুদ্ধে বিজয় দেখে যেতে পারব যারা এটিকে ভাঙ্গার জন্য চেষ্টা করছে?”
“যতদিন আপনি জীবীত আছেন ততদিন নয়” বিদেশী বলল মুখটা কালো করে, “কিন্তু এটা বিজয় লাভ করবে। আপনার মৃত্যুর পর হাজার হাজার লোক এর জন্য লড়াই করবে।”
“কারণ তুমি তখন দীর্ঘস্থায়ী বন্ধি, কুচকানো গাল ভাগ্যগণনাকারী।” দানিয়েল ওয়েবস্টার উচ্চ হাসিতে ফেটে পড়লেন। বললেন, “থামো, তোমাকে আগে মূল্যায়ন করার স্থানটা ঠিক করে নেই! কারণ মাত্র তেরটি কলনী নিয়ে আমি ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করব।”
তিনি নিজের একটা পা পিছনের দিকে টেনে নিয়ে গেলেন তাকে একটা লাথি মারার জন্য। কিন্তু লোকটি তার কালেক্টিং বক্স নিয়ে উড়াল দেয়ার মত করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
“তারপর, দেখি জগে কি আছে। সারারাত কথা বলার মত শুকনা কাজ করেছি” জাবেজ স্টোনকে অচেতন অবস্থা থেকে জাগতে দেখে তিনি বললেন, “মি. স্টোন, মনে হয় নাস্তা করার মত কিছু পিঠা আছে।”

সবাই বলে যে, যখনই শয়তান মার্শফিল্ডের নিকটে আসে, সবসময় তাকে এড়িয়ে চলে। তারপর হতে আজ পর্যন্ত তাকে নিউ হ্যাম্পশায়ারের এ তল্লাটে দেখা যায়নি। অবশ্য মেসাচ্যুসেট কিংবা ভারমন্টের কথা আলাদা।

_অনুবাদ : মাহমুদ বিন হাফিজ

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!