শয়তান

আজ আমি একটা ভয়াবহ কাজ করতে যাচ্ছি। লিখতে বসেছি যখন, বলেই ফেলি। ভয়াবহ কাজটা হল, খুন। আজ আমি একটা খুন করতে যাচ্ছি।

এই মুহূর্তে আমি অন্ধকার ঘরটার দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। ঘরটার মাঝামাঝি একটা খাট। বেশ চওড়া। সেই খাটের উপর একজন মানুষ শুয়ে আছে। ডিমলাইটের আলোয় দেখা যাচ্ছে, মানুষটার দু হাত ভাঁজ হয়ে আঙ্গুলগুলো মুখের কাছাকাছি চলে এসেছে। দু হাঁটুও ভাঁজ হয়ে একেবারে বুকের কাছে চলে এসেছে। মানুষটার শীত লাগছে কি? হতে পারে।

আমি অপলক তাকিয়ে আছি। আমার বারবার মনে পড়ছে কালো পোশাক পরিহিত অদ্ভুত অবয়বটার কথা, “আমাকে চূড়ান্তভাবে সন্তুষ্ট করতে হলে তোকে বড় একটা আত্মত্যাগ করতে হবে। অনেক বড় আত্মত্যাগ”।

আমার মাথার মধ্যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। যে পথ আমি বেছে নিয়েছি তা থেকে পালাবার কোন উপায় নেই। এখন আমি দুটো কাজ করতে পারি। এক, কালো পোশাকের অবয়বকে সন্তুষ্ট করতে পারি। দুই…আসলে দুই কোন অপশন নয়। আসলে এখান থেকে পালানোর কোন উপায় নেই। পালানোর চেষ্টার আরেক নাম মৃত্যু।

আমি দুই হাতের আঙ্গুলগুলো পরস্পরের মাঝে ঢুকিয়ে মট মট করে ফুটিয়ে নিলাম। বিড় বিড় করে প্রার্থনার মত করে বললাম, “আমাকে সাহায্য কর প্রভু শয়তান! আমাকে সাহায্য কর প্রভু শয়তান! আমাকে সাহায্য কর প্রভু শয়তান!”

ব্যাপারটার শুরু হয়েছিল প্রায় দুই মাস আগে।

***

অবয়বটাকে আমি প্রথম যেদিন দেখি সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। আমার স্পষ্ট মনে আছে, কারণ সপ্তাহের এই একটা দিনই আমি একটু ড্রিংক করি। এমনিতে বেশি খাই না, মোটামুটি সুস্থভাবেই ফিরে আসতে পারি বাসায়, কিন্তু সেদিন একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছিলাম। ফলে যা হবার তাই হয়েছিল, আমার বউ আফসানা চেঁচামেচি করে বাসা মাথায় তুলেছিল, ওকে থামাতে আমি ওর মাথা ধরে সজোরে বিছানায় গায়ে ঠুকে দিয়েছিলাম। এক ধাক্কাতেই আফসানা ঠাণ্ডা, অজ্ঞান হয় নি, কিন্তু আর কোন কথাও বলে নি। ওর মাথাটা ঠুকে দেবার পরপরই আমার মনের মধে এক আদিম উল্লাস হয়, এবং আমার মনে হতে থাকে কে যেন পিছন থেকে আমায় দেখছে। কৌতূহল নিবারণের উদ্দেশ্যে আমি চট করে পিছনে তাকাই। তখনই প্রথম দেখি, একটা কালো পোশাক পরা অবয়ব যেন আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।

চমকে উঠি। প্রচণ্ড ভয়ে প্রাণটা একেবারে গলার কাছে উঠে আসে। শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। ভাবনার দুয়ার রুদ্ধ হয়ে যায়। আমি চোখের পলক ফেলি। খুলে দেখি, নেই। কেউ নেই।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। মনকে বোঝাই, ড্রাঙ্ক অবস্থায় চোখের ভুল টাইপ কিছু একটা হয়তো ছিল এটা। অথবা কাজের চাপ। বলা বাহুল্য, দুয়েকদিনের মধ্যে আমি ব্যাপারটা আনন্দের সাথেই ভুলে যাই।

দ্বিতীয়বার আমি তাকে দেখি অফিস চলাকালীন সময়। ফাইল আটকে দেনদরবার করছিলাম, ভেবেছিলাম কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার তুলতে পারব। লোকটা মোচড়ামুচড়ি করতে করতে হুট করে আমায় জানাল অত টাকা দেবার সামর্থ্য তার নেই, তবে তার স্ত্রী নাকি খুব ভালো গাইতে জানে, কোন একটা শুভদিন দেখে লোকটা আমাকে তার বাসায় দাওয়াত দিতে চায়। গানের ব্যাপারে একেবারে অনাগ্রহী এই আমি তুড়ি মেরে প্রস্তাবটা উড়িয়ে দেবার ঠিক আগ মুহূর্তে সে চোখ টিপে জানাল, তার স্ত্রীর বয়স নাকি মাত্র পঁচিশ। ব্যস, চোখ টেপার যথার্থ মর্মার্থ আমার মর্মে ঢুকে একেবারে চেয়ার পেতে বসে গেল এবং আমি আমার মনের মধ্যে পরিচিত আদিম উল্লাসটা টের পেলাম। এবং, তারপরই ঘটল ব্যাপারটা। দরজার দিকে তাকিয়েই দেখি কালো পোশাক পরা অবয়বটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আবারও ঠিক আগের মতই অবস্থা হল আমার। ভয়ে গলা শুকিয়ে এল। মনে হল গলায় কিছু একটা বিঁধে আছে। মনে হল, আমি শ্বাস ফেলতে ভুলে গেছি। মনে হল, আমি মারা যাচ্ছি।

সম্ভবত চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গিয়েছিলাম। একসময় ফেললাম। চোখ খুলেই দেখি, নেই। সে নেই।

এবার তো আমি ড্রাঙ্ক ছিলাম না! তাহলে? আমি মনকে বোঝাই, হয়তো কাজের চাপে উল্টাপাল্টা জিনিস দেখছি। রেস্ট নিলেই হয়তো ঠিক হয়ে যাবে।

তৃতীয়বারের বার অবয়বটাকে আরও একটু বেশি সময় ধরে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। তবে এটাকে সৌভাগ্য নাকি দুর্ভাগ্য বলা উচিৎ আমি ঠিক জানি না। আমার পাঁচ মাস বয়সী একমাত্র পুত্র শামস যখন আমার কোলের উপর পায়খানা করে দিয়েছিল তখন আমার মন এমনিতেই অনেক খারাপ ছিল। মন খারাপ যোগ মেজাজ খারাপ আসলে খুব ভয়ঙ্কর কিছু। সুতরাং যা হওয়া উচিৎ ছিল সেটাই হল, আমি শামসকে প্রচণ্ড জোরে একটা চড় মেরে বসলাম। শামস ট্যাঁ করে কেঁদে উঠল। আমার মনে সেই আদিম ও জান্তব ধরণের উল্লাসটা ফিরে এল এবং আফসানা এসে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে না থামানো পর্যন্ত আমি শামসকে একের পর এক থাপ্পড় মারতেই থাকলাম। আফসানা হঠাৎ কোথা থেকে উড়ে এসে আমার হাত থেকে শামসকে উদ্ধার করল, আর ঠিক তখনই দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি কালো অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে। গত দুবারের অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি চোখের পলক ফেললেই সে চলে যাবে, সুতরাং আমি অন্য কিছু না ভেবে সেটাই করলাম। আমি চোখ বুজে আবার খুললাম। আবার বুজলাম। আবার খুললাম। হঠাৎ দেখি, সে চলে গেছে।

খুব চিন্তিত হয়ে পড়লাম। একই কালো অবয়বকে আমি তিনবার দেখলাম। তিনটা ভিন্ন অবস্থায়। ড্রাঙ্ক অবস্থার উপর দোষ দেয়া যাচ্ছে না। একইভাবে কাজের চাপের উপরেও আঙ্গুল তোলা যাচ্ছে না।

তাহলে এর ব্যাখ্যা কি? হ্যালুসিনেশন?

তার মানে কি? আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি?

আমার প্রশ্নের উত্তর অবশেষে একদিন পেলাম আমি। সেদিনের কথা আমি কোনদিনও ভুলব না।

***

আমার নতুন বস একজন হারামি। হারামি মানে রিয়েল হারামি। হারামির বাচ্চা হারামি। সম্প্রতি সে খুব বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। আমাকেই কেন যেন টার্গেট করেছে সে। গোপনে আমাকে নিয়ে যত নালিশ অভিযোগ সব খতিয়ে দেখছে সে। তার সাথে তাল দিয়ে অফিসে আমার যত শত্রু সব ঘোঁট পাকিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। যেন আমাকে বাঁশ দেবার মধ্যেই তাদের জীবনের পরম শান্তি নিহিত।

আমি প্ল্যান করলাম, হারামির বাচ্চাগুলোকে একটা শিক্ষা দিতে হবে। উচিৎ শিক্ষা। তবে সবার আগে শিক্ষা দিতে হবে এই শালাকে। অতঃপর আমি একটা কোকের বোতল কিনলাম। বাথরুমে গেলাম। বোতলের মুখ খুললাম। কয়েক ঢোক নিজে খেয়ে নিলাম। তারপর প্যান্টের চেন খুললাম। তারপর একটা কাজ করলাম। কি করলাম সেটা আর বলতে চাচ্ছি না। কাজ সেরে টিস্যু পেপার দিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে প্যান্টের চেন আটকে সোজা বসের রুমে গিয়ে বললাম, বস, কেবল খবর পেলাম আমার ছেলে প্রথম কথা বলেছে। তার মুখ দিয়ে বের হওয়া প্রথম কথাটা ছিল “বাবা”। এই আনন্দে সেলিব্রেট করার সিদ্ধান্ত নিলাম। এই কোকটা আপনার জন্য।

বস কেমন লোভাতুর দৃষ্টি হেনে কোকের বোতলের দিকে তাকিয়ে রইল। দশ মনি ওজনের লোকটার প্রিয়তম খাদ্য কোক। কথিত আছে প্রতিদিন দুই লিটার কোক না খেলে তার আত্মা তৃপ্ত হয় না। কোকটা হাতে নিয়ে লোকটা বলল, আপনার ছেলের নাম কি যেন?

শামস। মানে সূর্য। ওর মা রেখেছে নামটা।

আচ্ছা আপনি যান। থ্যাঙ্কস।

আমি চলে এলাম। নিজের রুমে ফিরে এসে চেয়ারে গা টা এলিয়ে দিতে যাব, ঠিক তখনই ভয়ের একটা শীতল স্রোত পা হতে মাথা পর্যন্ত খেলে গেল আমার।

আমার চেয়ারেই বসে আছে কালো অবয়বটা।

***

অবয়বটার একটা বর্ণনা দেয়া যাক। তার মুখের কোন অংশ দেখা যায় না। মুখের দিকে তাকালে মনে হয় অন্ধকার। মুখের সামনে দিয়ে কাপড়ের একটা অংশ ঝুলিয়ে দেয়া। অদ্ভুত লম্বা সে। মনে হয় আরেকটু হলেই ছাদ স্পর্শ করবে। গায়ের কাপড়ের রংটাও ঠিক কালো নয়। কেমন যেন ঘোর হয় ঐ কাপড়ের দিকে তাকালে। “ঘোরলাগা কালো” হতে পারে এই রঙ এর সঠিক বর্ণনা।

ঠিক আগের মতই অনুভূতি হচ্ছিল আমার। ঠিক কেমন যেন গলায় কিছু আটকে থাকার অনুভূতি। সময় থমকে যাবার অনুভূতি। কিন্তু অভিজ্ঞতা আমার কানে ফিসফিস করে বলল, চোখ মুদে আবার খোল। ও চলে যাবে।

আমি চোখ মুদলাম। খুললাম। মুদলাম। খুললাম। মুদলাম। খুললাম। কাজ হল না। কালো অবয়ব বসেই রইল। শেষবার চোখ মুদে পাঁচ সেকেন্ড থাকার পরে চোখ খুলেই হঠাৎ করে আঁতকে উঠলাম। ভয়াবহ চিৎকার বের হয়ে আমার কণ্ঠস্বর হতে।

কালো অবয়বটা আর চেয়ারে বসে নেই।

সে দাঁড়িয়ে আছে একেবারে আমার সামনে!

একেবারে আমার গা ঘেঁষে!

খুব বাজে, বোটকা একটা গন্ধ পেতে শুরু করলাম আমি। মনের মধ্যে সারা জীবনে পাওয়া সমস্ত দুঃখ হঠাৎ স্রোতের মত বয়ে যেতে শুরু করল। হঠাৎ করেই বেঁচে থাকার সমস্ত ইচ্ছা বিলুপ্ত হয়ে গেল আমার। হঠাৎ করে মনে হতে লাগল, জগতে ভালো বলে কিছু নেই। মনে হল, জগতটা শুধু মন্দের জন্য, মৃত্যুর জন্য। মনে হল, এখনই মারা গেলে ভালো হত। এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আর কোন ইচ্ছা আর আমার অবশিষ্ট নেই।

পিছিয়ে যেতে চেষ্টা করলাম। পারলাম না। পা দুটো কে যেন আঠার মত মেঝের সাথে লাগিয়ে দিয়েছে। অনেক চেষ্টা করলাম, পারলাম না। চিৎকার করার চেষ্টা করলাম, গলা দিয়ে আর শব্দ বের হল না। হঠাৎ করে আমি আবিষ্কার করলাম, আমি শরীরের একটা পেশীও নাড়াতে পারছি না। এমনকি শ্বাসও নিতে পারছি না। আমি মারা যাচ্ছি। তিলে তিলে মারা যাচ্ছি। আমার শরীর মারা যাচ্ছে। আমার মন মারা যাচ্ছে।

চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছিল আমার। জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে কার কথা চিন্তা করছিলাম আমি? আমার বউয়ের কথা? ছেলের কথা? আসলেই, কাউকে তো কখনও মন দিয়ে ভালবাসি নি আমি! বউকে মানুষ হিসেবে দেখি নি, বাতাসে ভাসমান দুটো স্তন আর একটা জরায়ু আর একটা যোনী দেখতে পেয়েছি যতবার ওর দিকে তাকিয়েছি। ছেলেকে মানুষ হিসেবে দেখি নি, ভুলে নিঃসৃত এক ফোঁটা থকথকে বীর্য হিসেবে দেখেছি ওকে যতবার তাকিয়েছি। আসলে, পৃথিবীর কাউকেই সেভাবে ভালবাসি নি আমি। তাই মৃত্যুর আগে কার কথা চিন্তা করতে করতে মারা যাব সেটা মনে হয় আমার দূষিত মস্তিষ্ক নিজেও বুঝতে পারে নি।

যখন ভাবছি এটাই আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত, ঠিক তখনই কালো অবয়বটা বলে উঠল, তোর কাজকর্মে আমি সন্তুষ্ট।

আমি হঠাৎ করে আবিষ্কার করলাম, আমি আবার শ্বাস নিতে পারছি। শুধু তাই নয়, মুখের পেশি আর জিহবাও নাড়াতে পারছি আমি। তাহলে নিশ্চয়ই কথাও বলতে পারব!

কে আপনি?

আমি? হঠাৎ খনখনে গলার হা হা হাসি আমার কান দিয়ে বাহিত হয়ে শরীরের প্রতিটি কোষে ছড়িয়ে পড়ল যেন, আমি শয়তান।

শয়তান!

হ্যাঁ, আমি শয়তান। তোর কাজকর্মে আমি সন্তুষ্ট। তুইই আমার প্রকৃত পূজারি।

আমার মস্তিষ্ক তখন আবার কাজ করতে শুরু করেছে, মানে, আপনি ইবলিশ শয়তান?

না। তবে আমাকে তার একটা অংশ বলতে পারিস। ইবলিশ শয়তানের কাজের ক্ষেত্র বিশাল। আমার কাজের ক্ষেত্র সীমিত।

মানে?

মানে, ইবলিশ শয়তানের কাজ হল পৃথিবীর সবাইকে দিয়ে খারাপ কাজ করানো। আর আমার কাজ হল শুধু তোকে দিয়ে খারাপ কাজ করানো।

বলেন কি!

হ্যাঁ। আমি তোর মনের শয়তান। প্রমাণ চাস? দেখে নে।

কালো অবয়বের মুখের উপর থেকে কাপড় হঠাৎ করে খসে পড়ল। আমি ভয়ে শিউরে উঠলাম। দগদগে, পোড়া, কালো একটা মুখ। ভয়ংকর হলুদ চোখ। এমন কুৎসিত মুখ এ জীবনে দেখব কল্পনাও করি নি। প্রাণের বিন্দুমাত্র চিহ্ন ঐ মুখে নেই। তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হল হারিয়ে যাচ্ছি কোথাও। মনে হল, আমি আর বেঁচে নেই। ঐ চোখ আমার জীবনীশক্তি তিলে তিলে শুষে নিচ্ছে।

চিনতে পারছিস?

আমি আরও ভালো করে তাকালাম। চেনা চেনা লাগছে কি? দগদগে, পোড়া, কালো একটা মুখ। কোথাও দেখেছি এই মুখ? কোথায় দেখেছি? এত চেনা চেনা লাগছে কেন মুখটাকে?

চিনতে পেরেছিস?

তারপর হঠাৎ করেই আমার পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গেল। আমি মুখটাকে চিনতে পারলাম। আমার গলা দিয়ে সুতীব্র চিৎকার বের হয়ে এল, নাআআআআ!!!

আমি চিনতে পেরেছি। আমি চিনতে পেরেছি ঐ মুখকে। আসলে, এই মুখকে না চেনার কোন কারণই নেই আমার। এটা সেই মুখ, যেটা আমি ছোটবেলা থেকে প্রতিদিন দেখে আসছি।

আয়নায়।

ওটা আমার মুখ।

ওটা আমার মুখ!

নাআআআআ!!!

শয়তান, অথবা দগদগে পোড়া মুখের অধিকারী আমি, আমাকে জিজ্ঞেস করলাম, বিশ্বাস হল?

ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললাম, হল।

তোর কাজকর্মে আমি সন্তুষ্ট। সবাই কমবেশি শয়তানের পূজা করে, কিন্তু তাকে সন্তুষ্ট করতে পারে কয়জন? তুই পেরেছিস। এজন্য আমি তোকে অনেক বড় পুরষ্কার দেব।

কি পুরষ্কার?

নিমিষেই মানুষকে বশ করার শক্তি দেব তোকে আমি। তোর কথা শুনলে বা চেহারা দেখলেই যেন যে কেউ তোর বশ হয়ে যায়। শয়তানের সর্বোচ্চ শক্তির একটা অংশ তোকে দেব আমি।

আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না, তাই?

হ্যাঁ। তবে তার বিনিময়ে তোকে একটা কাজ করতে হবে।

কি কাজ?

আত্মত্যাগ। আমাকে চূড়ান্তভাবে সন্তুষ্ট করতে হলে তোকে বড় একটা আত্মত্যাগ করতে হবে। অনেক বড় আত্মত্যাগ।

কি আত্মত্যাগ?

ভয়ঙ্কর অবয়বটা, অথবা ‘আমার’ দৃষ্টি একেবারে আমার কর্নিয়া, অ্যাকুয়াস হিউমার, লেন্স, ভিট্রিয়াস হিউমার, রেটিনা, অপটিক নার্ভ সব ছাড়িয়ে একেবারে মস্তিষ্কটাকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিল যেন, যার শরীরে তোর রক্ত বইছে তাকে খুন করতে হবে। ঘোর অমাবস্যার রাতে। কাজটা করার আগে প্রভু শয়তানের নাম উচ্চারণ করতে হবে তিনবার।

আমি ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলাম। শয়তান বলে উঠল, কি? পারবি না?

জড়ানো গলায় শুধালাম, যদি না পারি?

প্রচণ্ড হুংকারে আকাশ বাতাস ভেঙ্গে পড়ল যেন, তবে তোর জন্য অপেক্ষা করছে ভয়াবহ মৃত্যু!!!

***

শামসের দিকে সন্তর্পণে এগিয়ে যাচ্ছি আমি। ছেলেটা গুটিশুটি মেরে ঘুমাচ্ছে। ঘুমাক, প্রাণ ভরে ঘুমাক। এটাই হবে ওর জীবনের শেষ ঘুম।

আমার চোখে আদিম আনন্দ আগুনের শিখার মত নাচানাচি করছে। একই সাথে মনের মধ্যে ঝড় বইছে উত্তেজনার।

আজকের পর থেকে আমি সব মানুষকে বশ করার ভয়ঙ্কর ক্ষমতাটি আয়ত্ত্ব করে ফেলব। আমাকে আর বসের সামনে মাথা নিচু করে কুকুরের মত চলাফেরা করতে হবে না, ড্রিংক করে বউয়ের কাছে ধরা খেয়ে সোফার উপর মশার কামড় খেতে খেতে ঘুমাতে হবে না, এমনকি বাড়ি গাড়ি টাকা পয়সা মেয়ে কোন কিছুর অভাব আর কখনও আমায় স্পর্শ করতে পারবে না।

আমি হব সারা পৃথিবীর রাজা!

আমাকে কেউ কখনও আর দুঃখ দিতে পারবে না! কেউ কষ্ট দিতে পারবে না! আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারব! কেউ আমাকে আর কোন কাজে বাঁধা দিতে পারবে না!

আমি ধীরে ধীরে শামসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।

ওকে কিভাবে মারব ঠিক করে ফেলেছি। গলা চেপে ধরে। ছটফট করতে করতে আমার সন্তান আমার চোখের সামনে মারা যাবে। মৃত্যুর আগে সে আমারই হাসিমুখ দেখবে। এমন সৌভাগ্য কজনের হয়? আমার চোখের সামনেই লাল হয়ে যাবে তার চোখ মুখ। ছটফট করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করবে সে, কিন্তু ছয় সাত মাসের বাচ্চার সমস্ত চেষ্টা আমার বছর চল্লিশের অভিজ্ঞ পেশিবহুল বাহুদ্বয়ের শক্তির কাছে পরাজিত হবে। তারপর আমি পাব প্রতিশ্রুত মহাশক্তি। থানা পুলিশ হতে পারে, কিন্তু আমাকে কেউ ঘাঁটাতে সাহস পাবে না। কারণ আমার চোখের দিকে তাকালেই সবাই সম্মোহিত হয়ে যাবে, আমাকে খুনের অপরাধে অ্যারেস্ট করার আগেই পুলিশের মস্তিষ্ক আমার দুর্বার সম্মোহনে আচ্ছন্ন হয়ে অকেজো বিকল হয়ে যাবে!

আমি এগিয়ে যাচ্ছি। আমার নিঃশ্বাস শামসের ঘাড়ের উপর পড়ছে। চোখের কোণ দিয়ে দেখছি, কেউ দাঁড়িয়ে আছে। কেউ হাসছে।

শয়তান হাসছে!

আমি হাসছি!

নাউ ইজ দ্যা টাইম!

আমি সজোরে আমার হাত শামসের ঘাড় বরাবর নামিয়ে আনলাম।

***

‘চপাশ’ শব্দটা শুনে জেগে গেল আফসানা, কি করছ?

মুখটা কদবেল করে বললাম, মশা মারলাম। ছেলেটার ঘাড়ে একটা মশা বসে ছিল।

কয়েল বন্ধ হয়ে গেছে ধরাও নি কেন? যাও ধরাও।

আচ্ছা।

আড়চোখে তাকালাম। কালো কোন অবয়বকে দেখা যাচ্ছে না। মানুষকে বশ করার শক্তি যে পেয়েছি সেটাও মনে হচ্ছে না। আফসানা যেভাবে ক্যাটম্যাট করে কথা বলছে!

শক্তি আসলেই আছে কি না পরীক্ষা করার জন্য আফসানার দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। আফসানা টের পেয়েই বলল, কুত্তা, তুই আমাকে ছুবি না। যা ভাগ।

আমি আফসানার ঘন কালো গভীর মাইনাস সাড়ে তিন পাওয়ারের চোখের দিকে তাকালাম। আফসানা বলল, কাছে ঘেঁষলে কিন্তু লাথি খাবি মাইন্ড ইট!

বিরস বদনে সোফায় এসে শুয়ে পড়লাম। আর কোনদিন শয়তানকে দেখি নি। আমার গল্পটা এখানেই শেষ।

***

শরীরের বিভিন্ন জায়গায় মশার কামড়ের দাগে চুলকাতে চুলকাতে মিরাজ আহমেদ ভ্রূ কুঁচকে তার সামনে বসা মানুষটির দিকে তাকিয়ে আছেন। তার আগেই ধারণা ছিল মানুষটা কল্পনাপ্রবণ, কিন্তু সেটার মাত্রা সম্মন্ধে তার কোন সম্যক ধারণা ছিল না। আজ হল।

কি ভয়ানক গাঁজাখুরি একটা গল্প ফেঁদে বসেছে মানুষটা! কেউ কখনও শয়তানকে দেখেছে নাকি? মানুষটা দেখলে তো আরও অনেকেই দেখত, পেপার পত্রিকায় নিশ্চয়ই নিউজ হত। তা তো হয় নি। বোঝাই যাচ্ছে যত্তোসব ফাউল গাঁজাখুরি! ধেত!

মিরাজ আহমেদের দিকে ডায়াবেটিক বিস্কিটের প্লেটটা বাড়িয়ে দিয়ে সালেহ তিয়াস বললেন, আমার গল্পটা বিশ্বাস হয়?

মিরাজ আহমেদ বিস্কিট না নিয়ে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়েই রইলেন।

আপনাকে আর দোষ দিয়ে কি হবে ভাই। আপনি তো প্রথম না। এই গল্প কতজনের কাছে করেছি, কেউ বিশ্বাস করে নি। যাকগে, তাতে আমার কিছু আসে যায় না। নতুন কারো সাথে পরিচিত হলে গল্পটা বলার জন্য প্রাণ আইঢাই করে। আপনার সাথে দেখা হবার পরেও করছিল, এখন প্রাণটা তৃপ্ত হল।

মিরাজ আহমেদ চুপচাপ বিস্কিটের প্লেটটা সাবাড় করে দিলেন। তারপর হুট করে বললেন, তার মানে আপনি ছেলেকে মারতে গিয়ে একটা মশা মেরেছিলেন?

হ্যাঁ।

কেন?

কারণ, শয়তান বলেছিল যে আমার রক্ত যার শরীরে বইছে তাকে মারতে। এখন আমার রক্ত বইছে আমার ছেলের শরীরে, আর তার রক্ত বইছে মশার শরীরে, তার মানে আমার রক্ত বইছে মশার শরীরে, তাই না? এইটা হঠাৎ মাথায় এল, মেরে দিলাম একটা মশা।

কিন্তু মশাটা মারার পরেও আপনি শয়তানের প্রতিশ্রুত ক্ষমতা পেলেন না, তাই তো?

ঠিক তাই।

মিরাজ আহমেদ বিড়বিড় করে বললেন, যত্তোসব গাঁজাখুরি!

কি বললেন?

বলেছি, শয়তানের খেতা পুরি। আচ্ছা, আজ উঠি। চা বিস্কিটের জন্য ধন্যবাদ।

আর আড্ডার জন্য?

আড্ডা আর হল কই? আপনার গল্প শুনেই তো সময় কেটে গেল। মাথাটা এখনও ঘুরছে। যাই বাসায় গিয়ে নাতিটাকে একটু ইংরেজি পড়াই।

আসুন। আবার আসবেন।

মিরাজ আহমেদ তার নতুন প্রতিবেশী সালেহ তিয়াসের বাসা থেকে বের হয়ে আসলেন। পাগল একটা লোক। কি একটা গাঁজাখুরি কাহিনী শোনাল! উফ!

মিরাজ আহমেদ বাসায় ফিরতেই তার দৌহিত্র তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অয়নের বয়স মাত্র সাত। সে ক্লাস টু তে পড়ে।

অয়ন তার দাদুকে খুব ভালোবাসে। দাদু পড়াতে বসলে সে অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে।

নাতিকে পড়াতে পড়াতেই মিরাজ আহমেদের মনের কোণে কি যেন খচখচ করতে শুরু করল। তিনি কিছুতেই বুঝতে পারলেন না কি এই খচখচানির কারণ। খচখচানির কারণে তিনি পড়ানোতে মনোযোগই দিতে পারলেন না। অয়নও বুঝল ব্যাপারটা।

পড়ানো শেষ হল। পুত্রবধূ টেবিলে তার জন্য খাবার গুছিয়ে দিল। মিরাজ আহমেদের মনের খচখচানিটা বাড়তেই লাগল। মনের সুখে খেতেও পারলেন না তিনি। টিভি খুলেও শান্তি পেলেন না। কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারলেন না তিনি। কেন খচখচ করছে মনের ভিতরটা? কি মনে পড়ছে না তার? কি ধরতে পারেন নি তিনি?

মনে দুঃখ নিয়ে শুতে গেলেন মিরাজ আহমেদ। হঠাৎ একটা মশা কামড়াল তার ঘাড়ের উপর। চপাশ করে মশাটাকে পরপারে পাঠিয়ে দেবার সাথে সাথে তিনি ধরতে পারলেন বিষয়টা। ভয়ে তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল ঠিক কোন ফুটো করতে থাকা ড্রিল মেশিনের মত।

সালেহ তিয়াসের বাসায় যতক্ষণ ছিলেন, ততক্ষণ মিরাজ আহমেদকে কমপক্ষে সাতটা মশা কামড়েছিল। গল্প শুনতে শুনতে সবকয়কেই চপাশ করে পরপারে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।

সালেহ তিয়াসকে বারবার বলা সত্ত্বেও কোন কয়েলের ব্যবস্থা হয় নি।

হবেই বা কেন?

হঠাৎ তড়াক করে বিছানায় উঠে বসলেন মিরাজ আহমেদ।

ভয়ের ঠাণ্ডা স্রোত এবার জমে বরফ হয়ে গেল যেন সত্যটা আবিষ্কার করে।

কয়েলের দরকার না হওয়াই স্বাভাবিক।

সালেহ তিয়াসকে তো মশাই কামড়ায় না!

***

মিরাজ আহমেদ চলে যেতেই ড্রয়ার থেমে ODOMOS লেখা একটা অয়েন্টমেন্ট বের করলেন সালেহ তিয়াস। এইটা গায়ে মাখলে মশা কামড়ায় না। এই আইডিয়াটা তিনি ছেলেবেলায় সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদার কোন একটা গল্প পড়ে পেয়েছিলেন।

মুচকি হাসলেন তিনি। ডায়রির পাতায় ছোট্ট করে লিখে রাখলেন, বলদ নাম্বার ১৩৩…মিরাজ আহমেদ!

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!