শঙ্খবাস

চারিদিকে তাকালে ঘোরলাগা অন্ধকারে দৃষ্টি সওয়াতে সময় দিতে হয় । এমন আবছা অন্ধকারেই রোজ জাল নিয়ে বেড়িয়ে যায় কালাম । উঠোনে রাতেই পানি উঠিয়ে রাখে জরি । সুপারি গাছের পাতা দিয়ে যত্ন করে ঢেকে রেখে পাশে বদনাটা রাখতেও কখনও ভুল হয় না তার । এত সকালে উঠে লোকটা কাজে যায় , ভাবতেই খুব খারাপ লাগে তার । অনেক সময়ই চেষ্টা করে স্বামীর হাতের বন্ধন মুক্ত হয়ে তারজন্য ধুঁয়াউঠা গরম ভাত রান্না করে দিতে । রোজ কড়কড়ে ঠাণ্ডা ভাত দিতে কাঁহাতক ভালো লাগে । কিন্তু কালাম, মাছের চালচলনের ঠিকুজী জানে , জরি কোন ছার ! তাকে এড়িয়ে বিছানা থেকে উঠার সাধ্যি আর হয়ে উঠে না । তাই রোজ ঐ মুড়ি হয়ে উঠা ঠাণ্ডা ভাত আর বাসী সালুন দিয়ে যখন খায় কালাম, কি এক মায়ায় চোখ ভিজে উঠে জরির । আহারে লোকটা কত পরিশ্রমই না করে ? এই যে যাবে কখন ফিরবে কে জানে? আর জরি কি না এখন কাথা গায় দিয়ে ঘুমুবে, যখন ইচ্ছে তখন উঠতে পারে ঘুম থেকে। কেও কিচ্ছু বলার নেই । দুপুরে নিজের জন্য গরম ভাত রান্না করতে কি যেন এক অপরাধবোধে ভোগে সে , যদিও জানে এর কোনও মানে নেই । সব জেলে বউদেরই এই একই জীবন ।

মাঝে মাঝে বড় বলতে ইচ্ছে করে জরির “ আমাগো তো তেমুন দরকার নাই , এক্তু বেলা করে গেলে কি হয় ?” কথা টা গলা পার হয়ে ঠোঁট পর্যন্ত এসেও থেমে যায় , লজ্জাটা উৎরিয়ে আর বলা হয়ে উঠে না । জরি জানে সে কালামের আদরের বউ , এই ধরনের কথা বলে কালামের মনের আয়নায়, সে নিজেকে বেহায়া হিসেবে দেখতে চায় না । কিন্তু ঐ যে ঠাণ্ডা ভাত ? এতদিন হয়ে গেল , কেন যে এখনও সে মেনে নিতে পারে না । স্বামীকে ধোঁয়া উঠা গরম ভাত না খাওয়াতে পারার সমস্ত দায়ভার যেন তার ।

মা হারা জরির সাত বছরের ছোট হাতটি ধরে বাবা যখন মামা বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল তখন ও বুঝে নি জরি, তার আর বাবা বাড়ি রইল না । ফেলে আসা খেলনা , সখী আর সাধের বেড়াল পুসি র শোকে ওর কান্নার ঢেউ যখন বাধভাংগা, মামা বাধ্য হয়ে নিয়ে গিয়েছিলো তাকে পলাশডাঙ্গায় । বাড়িতে ঢুকে উঠোনে সাজানো তিনকোণা করে কাটা রঙিন পতাকার ঝালর দেখে যতটা অবাক হয়েছিল সে , তারচেয়ে বেশি অবাক হয়েছিল মায়ের বেনারসি গায়ে দেয়া অপরিচিত মানুষটিকে দেখে । মা কতবার তাকে শাড়িটি পরিয়ে কোলে নিয়ে ঘুরেছে , আর বলেছে “আমার জরি , লাল পরী !” সেই শাড়ি অন্য একজন পরে মার বিছানা আলো করে বসে আছে কেন ? শাড়ি রহস্য বুঝতে তার সময় লেগেছিল আরও কিছু দিন । আর শাড়ির মাহাত্ব বুঝে ছিল আবার মামা বাড়িতে ফিরে যেতে বাধ্য হয়ে ।

বাবার দ্বিতীয় বিয়ে পরবর্তী জীবন ও মামির বাড়িতে পরগাছার জীবন তাকে সাত থেকে সতের তে পৌঁছে দিয়েছিলো । তাই চালচুলোহীন কালামের হাতে মামা যখন তাকে সমর্পণ করে দিলেন , জরি তার নিয়তির পরিবর্তনে খুশিই হয়ে ছিল । মহাজনের কাছ থেকে ভাড়ায় জাল নিয়ে মাছ ধরার কাজ কালামের । সম্পদ বলতে ছিল ভাঙ্গা বসত বাড়ি আর প্রায় যায় যায় বৃদ্ধা মা । সুন্দরী জরির সাথে বেদম অমানানসই কালামকে তার সব সম্পত্তি (!) সহই মেনে নিয়েছিল জরি । তাই সময় লাগেনি শাশুড়ি সমেত স্বামী সংসার কে আপন করে নিতে ।

সেই শাশুড়ি ও গেল বছরের আগের বছর খরার সময় তিন দিনের নোটিশে পাট উঠালেন । ।যতদিন শাশুড়ি ছিল ভালই কাটত সময় ।শাশুড়ির মৃত্যুর পর আরেকটা শুন্যতা নগ্ন হয়ে ধরা পরে, পাচ বছরের সংসার জীবনে সন্তানের অভাব । স্বামী বাইরে চলে গেলে বড্ড একা হয়ে যায় জরি । আশে পাশে পড়শি বাড়িও নেই । আর গেলেও শান্তি পায় না সে , জানে সে চলে আসার পরই শুরু হবে তার আটখুড়া জীবন নিয়ে মুখরোচক গল্প। দু চারটা হাতের কাজ শেষ হয়ে গেলে অসহ্য অফুরন্ত সময় । বড়ি দেয়া , আচার দেয়া , ঘুঁটে বানানো এসব করে সময় কাটাতে কাটাতে মাঝে মাঝে উদাস লাগে তার । দক্ষিন খিরকি পথে নদীটার দিকে নির্নিমেষ চেয়ে চেয়েই সময় কাটে । শীত আসছে গুটি গুটি । সারাটা নদী যেন পচা ডোবা হওয়ার জন্য অস্থির হয়ে আছে ।ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত শ্যাওলা আর আগাছা নিয়ে নদী যেন তলিয়ে যাচ্ছে ।

কালাম বাড়িত আছ নাহি ? বাইরে হানিফের গলা শোনে জরি । কালামের ল্যাঙটাকালের বন্ধু , মাঝে মাঝেই আসে । কাপড় ঠিক করে উঠে দাওয়ার কাছে যায় জরি। হানিফ তাকে দেখামাত্রই কান পর্যন্ত লম্বা একটা হাসি দেয় ।

ও ভাবী কি করেন? খবর কি? কালাম বাইত আছে না? আইজ ত থাকনের কতা ।

মাথা নেড়ে উত্তর দেয় জরি , আড়ষ্টতা কাটাতে শাড়ির আঁচল প্যাচাতে থাকে আঙ্গুলে । হানিফ কে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কখনও জরি । না খারাপ কিছু করেনি কখনও তবে মেয়েরা স্বভাবজাত ভাবেই পুরুষের দৃষ্টি বোঝে ,তাই কিছুটা অস্বস্তি লাগে ।

ও ভাবী দেওরারে শরবত খাও্যাইন দেহি । হাইট্যা কাহিল হয়া গেছি ।

বলে হানিফ বসে যায় দাওয়ায় । গায়ের জামাটা খুলে নিজেকে বাতাস করতে থাকে । সেদিক থেকে তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নেয় জরি । বলতে বাধা নেই বেশ শিহরিত হয়েই । হাড় জিরজিরে কালামের শরীরের সাথে সুদর্শন হানিফের সুঠাম গড়নের পার্থক্য বোঝার জন্য খুব একটা অভিজ্ঞ চোখের প্রয়োজন হয় না ।

জরির হাত থেকে শরবত ভরতি ঘোলাটে গ্লাসটি নিতে নিতে হানিফ ইশারায় জরিকে বসতে বলে । যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে বসে জরি । আলাপে গল্পে হানিফ একটু একটু করে জরির পাশে সরে আসে । একসময় বলি বলি করে বলে ,

“ ভাবী আমার মনে কয় কালাম রে ডাকতর দেহান দরকার ?”

ক্যান? আঁতকে উঠে জরির সমস্ত পৃথিবী ।

ওমা! আইজও তোমরার পুলাপুরি কিছু হইলো না । দেহনা কালাম কিমুন চিমটা হুগ্না রুইগ্যা ।

থেমে যাওয়া শ্বাস আস্তে ধীরে ছাড়ে জরি ।কিছু না বলে আবার আঙ্গুলে জড়াতে থাকে আঁচল । এ কথা সেকথার পর উঠে যায় হানিফ । জরি আনমনে আবার সরু হতে থাকা নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে ।

রাতে পরিশ্রান্ত স্বামীর পাশে উৎসুক জরি ঝিঁঝিঁর ডাকের সাথে তাল মিলিয়ে কালামের কানে কানে বলে “ চল না, শহরে গিয়া ডাক্তার দেহায়া আই ?

সচকিত কালাম বলে উঠে “ক্যান ?দাক্তর দেহামু ক্যান?

জরি আরও নিবিড় হয়ে আসে ।কিছু বলতে পারে না । শুধু বুক থেকে কি যেন একটা বস্তু দলা পাকিয়ে উঠে কণ্ঠরোধ করে দেয় । জরি শুধু তার সারাটি বুক জুড়ে একটি কচি শরীরের পরশ পেতে চায় ।

কালামেরও সাধ হয় টলমলে পায়ে বুকে আছড়ে পরুক একটি ছোট্ট কোমল দেহ ।কিন্তু , কাউকে কিছু বলতে পারে না । একটা পাপবোধ নিজের অক্ষমতাকে জাগিয়ে তোলে ।বিয়ের মাস ছয়েক আগে প্রচণ্ড খরায় কাজ কাম বন্ধ হয়ে যায় । ক্রমাগত উপোসি বেলা কাটানো বৃদ্ধ বাবা সেদিন আর কথা বলতেও পারছিলেন না । কালাম তার ক্ষুধার শীর্ণ শরীরটি বয়ে নিয়ে শহরে গিয়েছিলো কাজের আশায় । পায়নি । শেষমেষ দালালের খপ্পরে পরে ভ্যাসেকটমী করে ৩০০ টাকা আর একটি লুঙ্গি নিয়ে বাড়ি ফেরে , যদিও ততক্ষনে বাবা থালাভরতি গরম ভাতের মোহ কাটিয়ে
সব পাওয়ার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন ।

জরির মুখের দিকে তাই তাকানোর সাহস হয় না কালামের , জরির মত মেয়ে বউ হিসেবে পাওয়া তার সাতজনমের ভাগ্যি । স্নেহ ভালবাসা বঞ্চিত এই মেয়েটির সমস্ত পৃথিবী জুড়ে যে সে , তা বুঝতে একটুকুও অসুবিধা হয় না কালামের । আর তাই পারেনা সত্যটি খুলে বলতে । দেবতার আসন স্খলন কোন পুরুষই বা চায় ?

হানিফ আসে প্রায়ই । একথা সেকথার ফাঁকে জানিয়ে যায় উত্তরপাড়ার সুবল মাইতি আবার বউ আনছে ঘরে , বংশরক্ষা করতে , তার আগের বউ ফাঁস দিয়েছে গতকাল রাতে । শুনে চমকে উঠে জরি। নিমা বউদির মুখখানা ভেসে উঠে , কি সুন্দর হাসিমুখ বউদির , কপালের লাল টিপখানা জ্বলজ্বল করত । হঠাৎ কেমন শীতশীত লাগে জরির , যদি কালাম আবার বিয়ে করে ? যদিও ফেমিলি প্লানিং আপা কইছে জরির শারীরিক কোন সমস্যা নাই । তবুও তার সন্তান নাই এটা ত সত্যি । কালাম মুখে কিছু বলে না ঠিক কিন্তু তার মনের অশান্তিটা ঠিকই টের পায় জরি । একদিন যদি ধৈর্য হারায় ? কি হবে জরির তখন? কোথায় যাবে সে? আবার যেন সে ফিরে যায় সাত বছর বয়সে দেখা লাল বেনারসির ইতিহাসে ।

তার টলে যাওয়া শরীরটার আসন্ন পতন আটকানোর বৃথা চেষ্টা করতে করতে হানিফের উৎকীর্ণ কণ্ঠ শুনতে পায় সে । ও ভাবি কি হইল ? কি হইল আপ্নের? জরি কিছু বলতে পারে না শুধু ঘোর লাগা দৃষ্টি তে তাকিয়ে থাকে । নদীটা কি তলিয়েই যাচ্ছে ? সামান্য শ্যাওলা কাদার কি এত ক্ষমতা ?
রাতে স্বামীর বুকে জড়িয়ে থেকে একটা অনিশ্চয়তার দোলায় দোলে জরি । সারারাত এপাশ ওপাশ করে । ভোর রাতে দামাল নদীর স্বপ্নে ঘুম ভাঙ্গে তার । মনস্থির করে , চোখের সামনে নদীর মৃত্যু দেখবে না সে ।

সময় গড়িয়ে যায় গুটি গুটি । শীত খরা পার করে বরষা আসে । শীর্ণ নদী তে আবার বান ডাকে । কালামের ধরে আনা মাছের গায়ে রঙের ছোঁয়া ধরে ।

বাইরে দামাল হাওয়া । থেমে থেমে চলছে বিদ্দুতের আস্ফালন । জরির ছোট্ট ঘরটি যেন উড়ে যাবে ।নিবিড় আবেশে কালামের বুকে আশ্রয় নিয়ে জরি কানে কানে বলে
“এই তুমি না বাবা হইবা”

ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হয় ।কালামের বুকের ভেতর সবকিছু যেন দুমড়ে মুচড়ে যায় । জ্বালা করে উঠে চোখ । আলগা হয়ে আসে হাতের বাঁধন । রাতের নিকষ কালো আধারে এক ঝলক সাদা আলোতে জরির চোখে মুখে মাখা পরিতৃপ্তি র কোমলতায় কালামের সম্বিৎ ফেরে , সে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে জরি কে । ঝড় উঠেছে উঠুক না, থেমেও যাবে , এ তাদের বহু যত্নে গড়া সংসার, কোন ঝড়ের সাধ্যিই নেই ভাঙ্গার । এই ঝড়ের জন্য তারা কেউ দায়ী নয় ।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!