লোভী জেলে

এক গ্রামে দুই বন্ধু বাস করত। রফিক আর রমিজ ছিল ওদের নাম। রফিক ছিল ফেরিওয়ালা। নিজ হাতে কুলা-ডুলা বানিয়ে বিক্রি করত সে। আর রমিজ মাছ বিক্রি করে সংসার চালাত। দু’জনকেই কঠোর পরিশ্রম করে সংসার চালাতে হতো। তবে তা নিয়ে দু’জনার মনোভাব ছিল দু’রকম। রফিক ভাবত, আল্লাহ ওকে যা দিচ্ছেন, বেঁচে থাকার জন্য তা-ই যথেষ্ট। আর রমিজ ভাবত, সে যা রোজাগার করছে, সংসার চালানোর পক্ষে তা খুবই সামান্য। আল্লাহ ইচ্ছা করলেই রমিজের রোজগার বাড়িয়ে দিতে পারেন। কিন্তু তিনি তা করছেন না। সুখে-দুঃখে দুই বন্ধুর দিন কেটে যাচ্ছিল।

কিন্তু পর পর দুই বছর সে এলাকায় বৃষ্টি হলো না। মাটি ফেটে চৌচির হলো। ক্ষেতের ফসল মরে গেল। দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ল এলাকাজুড়ে। নদীর পানিও শুকিয়ে গেল। ফলে রমিজের মাছ ধরার উপায় রইল না। তবে রফিক দূর থেকে দূরে ঘুরে তার কুলা-ডুলা বিক্রি করে চলল। তাতে তার রোজগার ভালোই হতে লাগল। রফিক যখন জানতে পারল রমিজের দিন কষ্টে কাটছে, তখন সে রমিজের সংসারের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিলো। ফলে রমিজের সমস্যা দূর হলো।

রমিজের একটা ছাগল ছিল। ঘাস খাওয়ার জন্য রমিজ ছাগলটাকে পাহাড়ে নিয়ে যেত। এক দিন পাহাড়ের সামনে ছাগলটাকে ছেড়ে দিয়ে রমিজ ঘুমিয়ে পড়ল। আর যখন ঘুম ভাঙল তখন ছাগলটাকে কোথাও দেখতে পেল না। রমিজ তাই ছাগল খুঁজতে পাহাড়ে গেল। এ পাহাড় সে পাহাড় খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ সে এক গুহার ভেতর তার ছাগলটাকে দেখতে পেল। রমিজ দেখল, এক দরবেশ চোখ বুজে ধ্যান করছেন আর ছাগলটা তার পাশে বসে আছে। রমিজ ভাবল, সে চুপচাপ ছাগলটাকে নিয়ে বেরিয়ে যাবে।

কিন্তু ছাগলের গায়ে হাত দেয়ার সাথে সাথে ওটা এমন জোরে ডেকে উঠল যে, সেই ডাক শুনে দরবেশের ধ্যান ভেঙে গেল। দরবেশ দেখলেন, এক লোক অসহায়ভাবে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দরবেশ জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে? তোমাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। রমিজ নিজের নাম আর সমস্যার কথা দরবেশকে খুলে বলল। সে কথা শুনে দরবেশ বললেন, দুর্ভিক্ষ যেভাবে জেঁকে বসেছে, রফিকের মতো বন্ধুর সাহায্য না পেলে সংসার চালাতে তোমার কষ্ট হতো।

রমিজ বলল, আপিন যা ভাবছেন তা ঠিক নয়। রফিক আমাকে সামান্যই সাহায্য করছে। আমার যদি সামর্থ্য থাকত, তবে আমি রফিককে আরো বেশি সাহায্য করতাম। কিন্তু আল্লাহ আমাকে সে সামর্থ্য দেননি। দরবেশ বললেন, ইনশা আল্লাহ্ তোমার সেই সামর্থ্য হবে। আমি তোমাদের দুই বন্ধুর আয় রোজগার বাড়িয়ে দেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করব।

দরবেশের কথা রমিজের পছন্দ হলো না। রমিজ বলল, রফিক তো ভালোই রোজগার করছে। আপনি শুধু আমার জন্য দোয়া করুন। দরবেশ বললেন, আমি যদি দু’জনের জন্য দোয়া করি, তাতে তোমার সমস্যা কোথায়? তুমি আপত্তি করছ কেন? এ তো মহা অন্যায়! রমিজ বলল, অন্যায় হলে আর আপত্তি করব না। তবে অন্তত এমন দোয়া করবেন, রফিকের ভাগ্যে যা ঘটবে, আমার ভাগ্যে যেন তার দ্বিগুণ ঘটে।

দরবেশ বললেন, এমন একপেশে অনুরোধ কারো জন্য কখনো মঙ্গল ডেকে আনে না। তবু তোমার অনুরোধ মেনে নিচ্ছি। রফিকের জীবনে ভালো-মন্দ যা ঘটবে, তোমার জীবনে তা দ্বিগুণ হয়ে দেখা দেবে। যাও বাবা, এবার নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি যাও। দরবেশের দোয়া আর আল্লাহর ইচ্ছায় পরের দিন থেকেই সে এলাকায় বৃষ্টি শুরু হলো। পানির ছোঁয়া পেয়ে মাটি উর্বর হয়ে উঠল। নদী ভরপুর হলো।

সেই নদীতে রমিজ মাছ ধরায় মন দিলো আর প্রচুর রোজগার করে চলল। রফিকের রোজগারও আগের চেয়ে ভালো হতে লাগল। রমিজ কখনো অন্যের ভালো সইতে পারত না। রফিকের রোজগার যে আগের চেয়ে ভালো হচ্ছে, এ ব্যাপারটিও সে মেনে নিতে পারল না। সে ভাবল, দরবেশকে খুঁজে পেয়েছি আমি। আমাদের অভাবের কথা জানিয়েছি আমি। আমার কথা শুনে তিনি অনুগ্রহ করে দোয়া করেছেন। অথচ আমার সাথে সাথে রফিকও তার ফল ভোগ করছে! এটা মেনে নেয়া যায় না।

আমি দরবেশকে বলব এর একটা বিহিত করতে। সত্যি সত্যিই পরদিন রমিজ দরবেশের কাছে গেল। আর তাকে বলল, আয়-রোজগার বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে রফিক অহঙ্কারী হয়ে উঠেছে। তাই এমন দোয়া করুন, রফিকের রোজগার যেন অর্ধেকে নেমে আসে। রমিজের কথা শুনে দরবেশ বললেন, রফিক যদি কোনো অন্যায় করে থাকে, তবে তার বিচার করবেন আল্লাহ। তুমি বলছ রফিকের রোজগার অর্ধেকে নামিয়ে আনার জন্য দোয়া করতে। কিন্তু তা যদি করা হয় তাতে তো তোমার কোনো লাভ হবে না! বরং তোমার জন্য তা ক্ষতিই ডেকে আনবে।

দরবেশের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে রমিজ জবাব দিলো, আমার কী হবে না হবে তা পরে দেখা যাবে। আপনি অনুগ্রহ করে এমন দোয়া করুন, এখন রফিক যা রোজগার করছে, তার রোজগার যেন এর অর্ধেকে নেমে আসে। দরবেশ খুব দুঃখ পেলেন রমিজের মনোভাবের পরিচয় পেয়ে। ম্লান হেসে তিনি বললেন, অদ্ভুত মানুষ তুমি। অন্যের ক্ষতি করার জন্য নিজের ক্ষতি করতেও তুমি পিছপা নও। ঠিক আছে, যা চাইছ তা-ই হবে। এবার বাড়ি যাও।

দরবেশ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রফিকের রোজগার অর্ধেক হয়ে যাবে, সেই আনন্দে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে রমিজ গুহা থেকে বের হয়ে এলো। সে সোজা চলে গেল মাছ ধরতে। অনেক মাছ ধরলও সে। কিন্তু সে দিন রমিজ সব মাছ বিক্রি করতে পারল না। পর দিনও অনেক মাছ অবিক্রীত থেকে গেল। তার পরের দিনও একই অবস্থা হলো। অবিক্রীত মাছ পচে দুর্গন্ধ ছড়াতে লাগল। ফলে গ্রামবাসী রমিজের ওপর ক্ষেপে গেল।

এভাবে রমিজের রোজগারও কমে আসতে লাগল। আর প্রতিবেশীরাও তার ওপর বিরক্ত হয়ে উঠল। রমিজের মতো রফিকের রোজগারও আগের তুলনায় কমে এলো। কিন্তু তা নিয়ে রফিক চিন্তিত ছিল না। কারণ সে ভাবত, তার মতো সাধারণ মানুষকে আল্লাহ যে দুই বেলা খেতে দিচ্ছেন, তাই যথেষ্ট।

কয়েক দিন পর রমিজের জীবনে নতুন সমস্যা দেখা দিলো। সে গ্রামে দু’জন যুবক বেকার ছিল। সে সময় তাদেরাও মাছ ধরার কাজে নেমে পড়ল। তারা ছিল কর্মঠ আর সাহসী। আর তাদের ব্যবহারও ছিল অমায়িক। তাই ক্রেতারা রমিজকে রেখে যুবকদের প্রতি আকৃষ্ট হলো। এভাবে রমিজের রোজগার বন্ধ হয়ে গেল। মাছ বিক্রি করা যখন অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল তখন রমিজের মনের কোণে দরবেশের ছবি ভেসে উঠল। রমিজ ভাবল, তাই তো! আমার জন্য তো দরবেশই রয়েছেন। তিনিই সব সমস্যার সমাধান করে দেবেন।

পরদিন রমিজ দরবেশের সাথে দেখা করতে গেল। কিন্তু গুহার ভেতর সে দরবেশকে দেখতে পেল না। কারণ অনেক আগেই তিনি গুহা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গিয়েছিলেন। দরবেশকে দেখতে না পেয়ে রমিজ দুই চোখে অন্ধকার দেখল। বুক ভেঙে কান্না এলো তার। অনেকটা সময় ধরে কাঁদল রমিজ। তারপর বাড়ি ফিরে এলো। রাতে দরবেশকে স্বপ্নে দেখল রমিজ। সেই স্বপ্নে দরবেশ বললেন, তুমি এক নিকৃষ্ট মানুষ। তুমি শুধু লোভীই নও, অকৃতজ্ঞও। তাই আল্লাহ তোমাকে শিক্ষা দিয়েছেন।

রমিজ বলল, দরবেশ বাবা! আমার রোজগার একেবারে বন্ধ হয়ে গেল কেন? দরবেশ বললেন, তা হয়েছে তোমারই কারণে। তুমি চেয়েছিলে রফিকের জীবনে যা ঘটবে, তোমার জীবনে যেন তা দ্বিগুণ হয়ে ঘটে। তাই তো ঘটেছে। রফিকের রোজগার অর্ধেকে নেমে গেছে আর তোমার রোজগার তার দ্বিগুণ নেমে শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়িয়েছে। এভাবেই লোভীদের আল্লাহ তায়ালা শায়েস্তা করেন। তুমি নিজেই নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেছ।

সত্যিই তাই। যারা উপকারী বন্ধুর ক্ষতি কামনা করে, শেষ পর্যন্ত তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

মসজিদে যেরারের ঘটনা

উমর (রাঃ) এর ভাতা বৃদ্ধির চেষ্টা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *