“ ওটা তো খাঁটি লেখকের লেখা নয় । ভিস্তির জলকে ঝরনার জল বলে না । সমাজের আবর্জনা ঝাঁটাবার জন্যে কোমর বেঁধেছিলে । আন্দাজে চলে না ও কাজ । আবর্জনাও সত্য হওয়া চাই আর ঝাঁটা-গাছটাও , সঙ্গে চাই ব্যবসায়ীর হাতটা । ”
পৃথ্বীশ যখন একটা ঝকঝকে জবাবের জন্যে মনের মধ্যে হাতড়াচ্ছে এমন সময় বাঁশরি বললে , “ শোন পৃথ্বীশবাবু , যাদের চেন না , তাদের চিনতে কতক্ষণ । আমরা তোমার ওই নলিনাক্ষের দল , আমাদের অপরাধ ঢের আছে , যেমন তোমাদেরও আছে বিস্তর । ভালো করে জানা হলে মানুষকে ভালো লাগতে পারে মন্দ লাগতেও পারে , কিন্তু অদ্ভুত লাগে না । ”
“ তোমকে তো জেনেছি বাঁশি , কী রকম লাগছে তার প্রমাণ কিছু কিছু পেয়েছ বোধ করি । ”
“ আমাকে কিছু জান না তুমি । আগে চেষ্টা করো আমার চারি দিককে জানতে । ”
“ কী উপায় ?”
“ উপায় আমিই ঠিক করে দেব । ”
সেই উপায়ের প্রথম আরম্ভ আজকের এই পার্টিতে । সুষমার ছোটো বোন সুষীমা , মাথায় বেণী দোলানো , বয়েস হবে তেরো , কাঁচা মুখ , চোখে চশমা , চটপট করে চলে — পৃথ্বীশকে এসে বললে , “ চলুন খেতে । ”
পৃথ্বীশ একবার উঠি-উঠি করলে , পর মুহূর্তে চেপে বসল শক্ত হয়ে । হিসেব করে দেখলে বিশ-পঁচিশ হাত তফাতে আছে টেবিলটা , এন্ডির চাদর দুলিয়ে যেতে হবে অনেক নরনারীর চোখের সামনে দিয়ে । ফস ক’রে মিথ্যে কথা বললে , “ আমি তো এখন চা খাই নে । ”
সুষীমা ছেলেমানুষের মতো বললে , “ কেন , এই সময়েই তো সবাই চা খায় । ”
পৃথ্বীশ এই ছেলেমানুষের কাছেও সাহিত্যিকের চাল ছাড়তে পরলে না , মুখ টিপে বললে , “ এক-এক মানুষ থাকে যে সবাইয়ের মতো নয় । ”
সুষীমা কোনো তর্ক না করে আবার বেণী দুলিয়ে চটপট করে ফিরে চলে গেল ।
সুষীমার মাসি অর্চনা দূর থেকে দেখলে । বুঝলে , যত বড়ো খ্যাতি থাক্ , লোকটির সেই লজ্জা প্রবল যেটা অহংকারের যমজ ভাই । ছোটো একটি প্লেটে খাবার সাজিয়ে নিজের হাতে করে নিয়ে এল । সামনে ধরে বললে , “ খাবেন না , সেকি কথা পৃথ্বীশবাবু , কিছু খেতেই হবে । ”
অন্তর্যামী জানেন খাওয়ার প্রয়োজন জরুর হয়ে উঠেছিল । প্লেটটা পৃথ্বীশ কোলে তুলে নিলে । নিতান্ত অপর সাধরণের মতোই খাওয়া শুরু করলে । বেঞ্চির এক ধারে বসল অর্চনা । দোহারা গড়নের দেহ , হাসিখুশি ঢলঢলে মুখ । বললে , “ সেদিন আপনার ‘ বেমানান ‘ গল্পটা পড়লুম পৃথ্বীশবাবু । পড়ে এত হেসেছি কী আর বলব । ” যদি কোনোমতে সম্ভবপর [ হত ] তা হলে রাঙা হয়ে উঠত পৃথ্বীশের মুখ । কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল । একখানা কেকের উপর অত্যন্ত মনোযোগ দিলে মাথা নীচু করে ।
“ আপনি নিশ্চয়ই কাউকে লক্ষ্য করে লিখেছেন । অমন অদ্ভুত জীবের নমুনা স্বচক্ষে না-দেখলে সাহস করে লেখা যায় না । ওই যে-জায়গায় মিস্টার কিষেণ গাপটা বি.এ.ক্যান্টাব পিছন থেকে মিস লোটিকার জামার ফাঁকে নিজের আঙটি ফেলে দিয়ে খানাতল্লাশির দাবি করে হোহা বাধিয়ে দিলে । আমার বন্ধুরা সবাই পড়ে বললে , সাহিত্যে এ জায়গাটা একেবারে অতুলনীয় । আপনার লেখা ভয়ানক রিয়ালিস্টিক , পৃথ্বীশবাবু । ভয় হয় আপনার সামনে দাঁড়াতে । ”
সিঙাড়ার গ্রাসটা কোনোমতে গলাধঃকরণ করে পৃথ্বীশ বললে , “ আপনাদের দুজনের মধ্যে কে বেশি ভয়ংকর তার বিচার করুন বিধাতা পুরুষ । ”
“ না , ঠাট্টা করবেন না । আপনি ওস্তাদমানুষ , আপনার সঙ্গে ঠাট্টায় পারব না । সত্যি করে বলুন, এরা কি আপনার বন্ধু, নিশ্চয়ই এদের খুব আত্মীয়ের মতোই জানেন । ওই যে মেয়েটা , কী তার নাম , কথায় কথায় হাঁপিয়ে উঠে বলে , মাই আইজ্ ও গড্ , যে মেয়েটা লাজুক স্যাণ্ডেলের সংকোচ ভাঙাবার জন্যে নিজে মোটর হাঁকিয়ে ইচ্ছে করে গাড়ি খাদের মধ্যে ফেলেছিল । প্ল্যান করেছিল মিস্টার স্যাণ্ডেলকে দু হাতে তুলে ধরে পতিতোদ্ধার করবে — হবি তো হ , স্যাণ্ডেলের হাতে হল কম্পাউন্ড ফ্র্যাক্চার — কী ড্রামাটিক্! রিয়ালিজমের একেবারে চূড়ান্ত । ভালোবাসার এত বড়ো আধুনিক পদ্ধতি বেদব্যাসের জানা ছিল না — ভেবে দেখুন সুভদ্রার কত বড়ো চান্স মারা গেল , আর অর্জুনেরও কবজি গেল বেঁচে । ”
“ আপনিও তো কম মডার্ন নন — আমার মতো নির্লজ্জকেও লজ্জা দিতে পারেন । ”
“ কী কথা বলেন পৃথ্বীশবাবু , বিনয় করবেন না । আপনি নির্লজ্জ ? লজ্জায় গলা দিয়ে সন্দেশ চলবে না । কলমটার কথা স্বতন্ত্র । ”
পৃথ্বীশ মনে মনে বললে , “ বাস রে দেখতে এমন নিটোল কোমল , মনটা কী চমৎকার নিষ্ঠুর । বেমানানের ষোলো আনা শোধ না নিয়ে ছাড়বেন না । ”
এখনো বাঁশরির দেখা নেই । হঠাৎ পৃথ্বীশের মনে হল , হয়তো সবটাই তাকে শাস্তি দেবার ষড়যন্ত্র । রাগ হল বাঁশরির ‘পরে , মনে মনে বললে , আমারও পালা আসবে ।
এমন সময় কাছে এসে উপস্থিত রাঘুবংশিক চেহারা শালপ্রাংশুর্মহাপ্রভুজঃ সোমশংকর । গৌরবর্ণ , রোদেপুড়ে কিছু ছায়াচ্ছন্ন , ভারী মুখ , দাড়ি গোঁফ কামানো , চুড়িদার সাদা পায়জামা , চুড়িদার সাদা আচকান , মাথায় সাদা মসলিনের পাঞ্জাবি-কায়দায় পাগড়ি , পায়ে শুঁড়তোলা দিল্লির নাগরাজুতো , দেহটা যে ওজনের কন্ঠস্বরটাও তেমনি । পৃথ্বীশের বুঝতে বাকি নেই , এই লোকটাই আজকের দিনের প্রধান নায়ক । অর্চনা পরস্পরের পরিচয় উপলক্ষে বললে , “ রাজা বাহাদুর সোমশংকর রায় । ”
পৃথ্বীশের মনটা পুলকিত হয়ে উঠল। শৌখিন পার্টিতেও সাহিত্যিকের সম্মান ছাড়িয়ে উঠেছে আভিজাত্যের খেতাবকে । যেচে আসছে আলাপ করতে । এতক্ষণ সংকোচে পীড়িত পৃথ্বীশ উৎকন্ঠিত হয়ে আগমন প্রতীক্ষা করছিল বাঁশরির , ও-যে “সর্বত্র পূজ্যতে” র দলে সেইটে প্রমাণ করবার জন্যে । আর প্রয়োজন রইল না — এমন-কি , ভুলে গেল এন্ডির চাদরের কালির চিহ্ন ।
অর্চনা চলে গেল অন্য অতিথিদের সেবায় ।
সোমশংকর জিজ্ঞাসা করলে , “ বসতে পারি ?”
পৃথ্বীশ ব্যস্ত হয়ে বললে , “ নিশ্চয় । ”
রাজা বাহাদুর বললে “ আপনার কথা প্রায়ই শুনতে পাই মিস বাঁশরির কাছ থেকে । তিনি আপনার ভক্ত । ”
“ ঈর্ষা করবার মতো নয় । ওঁর ভক্তিকে অবিমিশ্র বলা যায় না । তাতে ফুল যা পাই সেটা ঝরে পড়ে , কাঁটাগুলো বরাবর থাকে বিঁধে । ”
“ আপনার একখানা বই পড়েছিলুম , মনে হচ্ছে তার নাম রক্তজবা । চমৎকার , হিরোয়িন যার নাম রাগিণী সে দেখলে স্বামীর মন আর-একজনের ‘পরে , তখন স্বামীকে মুক্তি দেবে বলে মিথ্যে চিঠি বানালে , প্রমাণ করতে চাইলে ও নিজেই ভালোবাসে প্রতিবেশী বামন দাসকে — সে জায়গাটায় লেখার কী জোর আর কী ওরিজিনাল আইডিয়া । ”
পৃথ্বীশ চমকে উঠল । এও কি শাস্তির উদ্দেশে তার প্রতি ইচ্ছাকৃত ব্যঙ্গ , না দৈবকৃত গলদ । রক্তজবা বইখানা যতীন ঘটকের । যতীন পৃথ্বীশের প্রতিযোগী , সকলেই জানে । উভয়ের উৎকর্ষ বিচার নিয়ে রুচির সংঘাত মাঝে মাঝে শোকাবহ হয়ে ওঠে এটা কি ওই সম্মুখবর্তী অতিকায় জীবের স্থূল বুদ্ধির অগোচর । রক্তজবায় স্বামীপ্রেমে বঙ্গনারীর কলঙ্ক স্বীকারের অসামান্য বিবরণে বাঙালি পাঠকের বিগলিত হৃদয় শুধু কেবল ছাপানো বইয়ের পাতাকেই বাষ্পাকৃত করেছে , তা নয় , সিনেমা থিয়েটারেও তার আর্দ্রতা প্রতি সন্ধ্যায় ব্যাপ্ত হয়ে থাকে । এই সাধারণ বাঙালি পাঠক ও দর্শকের অশিক্ষিত রুচির প্রতি যে পৃথ্বীশ অপরিসীম অবজ্ঞা অনুভব করে সেই মানুষেরই ‘পরে ভাগ্যের এই বিচার ।
একটা রূঢ় কথা ওর মুখ দিয়ে বেরচ্ছিল, এমন সময় [বাঁশরি ] অলক্ষ্য পথ দিয়ে ওদের পিছনে এসে দাঁড়ালে । ওকে দেখেই সোমশংকর চমকে দাঁড়িয়ে উঠল , লাল হয়ে উঠল তার মুখ । বাঁশরি বললে , “ শংকর , আজ আমার এখানে নেমন্তন্ন ছিল না । ধরে নিচ্ছি সেটা আমার গ্রহের ভুল নয় , গৃহকর্তাদেরই ভুল , সংশোধন করবার জন্যে এলুম । সুষমার সঙ্গে আজ তোমার এনগেজমেন্টের দিন , অথচ এ সভায় আমি নেই এ কখনো হতেই পারে না । খুশি হও-নি অনাহূত এসেছি বলে । ”
“ খুব খুশি হয়েছি সে কি বলতে হবে । ”
“ সে কথাটা ভালো ক’রে বলবার জন্যে চলো ওই ফোয়ারার ধারে ময়ূরের ঘরের কাছে । পৃথ্বীশবাবু নিশ্চয়ই প্লটের জন্য একমনে ছিপ ফেলে বসে আছেন , ওঁর ওই অবকাশটা নষ্ট করলে বঙ্গসাহিত্যের ক্ষতি হবে । দেখছ-না সর্বসাধারণ থেকে অসীম দূরে এক কোণে আছেন বসে । ”
সোমশংকরের হাতে হাত ঝুলিয়ে বাঁশরি চলে গেল ময়ূরের ঘরের দিকে । পুকুরের মাঝখানে ফোয়ারা । ঘাটের পাশে চাঁপা গাছ । গাছের তলায় ঘাসের উপর বসল দুজনে । সোমশংকর সংকোচ বোধ করলে , সবাই তাদের দূর থেকে দেখছে । কিন্তু বাঁশরির ইঙ্গিত অবহেলা করবার শক্তি নেই তার রক্তে । পুলক লাগল ওর দেহে । বাঁশরি বললে , “ সময় বেশি নেই , কাজের কথাটা এখনি সেরে ছুটি দেব । তোমার নতুন এনগেজমেন্টের রাস্তায় পুরোনো জঞ্জাল জমেছে , সেগুলো সাফ করে ফেললে পথটা পরিষ্কার হবে । এই নাও । ”
এই বলে একটা পান্নার কন্ঠী , হীরের ব্রেসলেট , একটা মুক্তো বসানো বড়ো গোল ব্রোচ ফুলকাটা রেশমের থলি থেকে বের করে সোমশংকরকে দেখিয়ে আবার থলিতে ভ’রে তার কোলের উপর ফেলে দিলে । থলিটা বাঁশরির নিজের হাতের কাজ করা । সোমশংকর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললে , “ বাঁশি , জানো আমার মুখে কথা জোগায় না । যতটুকু বলতে পারলেম না তার সব মানে নিজে বুঝে নিয়ো । ” বাঁশরি দাঁড়িয়ে উঠল । বললে , “ সব কথাই আমার জানা , মানে আমি বুঝি । এখন যাও , তোমাদের সময় হল । ”
“ যেয়ো না বাঁশি , ভুল বুঝো না আমাকে । আমার শেষ কথাটা শুনে যাও । আমি জঙ্গলের মানুষ শহরে এসে কলেজে পড়া আরম্ভের মুখে প্রথম তোমার সঙ্গে দেখা । সে দৈবের খেলা । তুমিই আমাকে মানুষ করে দিয়েছিলে । তার দাম কিছুতে শোধ হবে না । তুচ্ছ এই গয়নাগুলো । ”
“ আমার শেষ কথাটা শোনো শংকর । আমার তখন প্রথম বয়েস , তুমি এসে পড়লে সেই নতুন-জাগা অরুণ রঙের মধ্যে , ডাক দিয়ে বাইরে আনলে যাকে তাকে নাও বা না নাও , নিজে তো তাকে পেলুম । আত্মপরিচয় ঘটল , বাস । দুই পক্ষের হয়ে গেল শোধবোধ । এখন দুইজনে অঋণী হয়ে আপন-আপন পথে চললুম , আর কী চাই । ” সোমশংকর থলিটা পকেটের মধ্যে পুরে গয়নাগুলো ফেলে দিলে পুকুরে । বাঁশরি দ্রুতপদে চলে গেল যেখানে বসে আছে পৃথ্বীশ । সকলেরই লক্ষ্যগোচর ভাবে বসল তার পাশে । প্রশ্রয় পেয়ে পৃথ্বীশ একটু ঝগড়ার সুরে বললে , “ এত দেরি করে এলে যে । ”
“ প্রমাণ করবার জন্যে যে বাঘ-ভাল্লুকের মধ্যে আসো নি । সবাই বলে উপন্যাসের নতুন পথ খুলেছ নিজের জোরে , আর এখানকার এই পুতুল নাচের মেলায় পথটা বের করতে ওফিস্যাল গাইড চাই , লোকে যে হাসবে । ”
“ পথ না পাই তো অন্তর গাইডকে তো পাওয়া গেল । ” এই বলে একটু ভাবের ঝোঁক দিয়ে ওর দিকে তাকালে । এই
গল্পের তৃতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।