রাজুর দিকে তাকায় রূপেন, তাকাতেও হয়না, ঠোঁটও না, গোটা মুখ বা হাতের তো প্রশ্নই ওঠেনা, চোখের পাতাটুকু ধীরে নামিয়ে নেওয়ার ভঙ্গীটুকুই বোধহয়, এটুকুই পর্যাপ্ত হয়। রাজু এগোতে শুরু করে, সন্তর্পণে, যত্পরোনাস্তি সন্তর্পণে। এই গোটা প্রাসাদ-আবাসের প্রতিটি জীবন্ত প্রাণী, এমনকি হয়তো বনশাই করা পাম বা তাদের মহার্ঘ সুইস কার্বনের পাত্রগুলো অব্দি জানে, নিঃশব্দে, সন্তর্পণে, বালির উপর বিড়াল হাঁটার মত করে চলো। তোমার তরফ থেকে একটা এলোমেলো আনপ্রেডিক্টেবল নিঃশ্বাসও মুহূর্তে তোমায় নির্মূল খতম খাল্লাস কাপুট করে দেবে।
দিনের এই শিফটে কারবাইনগুলো যাদের হাতে, তারাও জানে, রূপেনের কোনো বিপদের আভাসটুকুও থাকুক আর না-থাকুক, বিন্দুমাত্র কোনো ছন্দপতনেই গুলি তাকে চালাতেই হবে। এটা আবার তার নিজের তরফে জৈবনিক বাধ্যতা। নিজের চতুর্দিকে এই বাধ্যতার নেটওয়ার্কটা নিয়ে একটা বিরক্তিমিশ্রিত মজা পায় রূপেন, কিন্তু বোঝে যে কিছু করার নেই, খুব জরুরি এটা। তার ছোটবেলায়, আন্ডারওয়ার্ল্ডের সেই পৌরাণিক যুগেও এসব ছিল, তবে কি জীবনটাও তো ভারি বদলে গেছে মধ্যের বছরগুলোয়। এই বাধ্যতার আবহে কাজের প্রস্তুতিটা খুব ভালো হয় — একাগ্রতা, টেনশন নিতে পারার সামর্থ। মাঝেমধ্যে খুব উল্টোপাল্টা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক কোনো খুনোখুনিতে হেসেও ফেলে রূপেন, কখনো দু:খও পায়।
রাজুও যেন লক্ষ্য করে নিল, রূপেনের দৃষ্টিতে কোনো বদল এসেছিল। বা হয়ত সত্যিই এসেছিল কোনো দুর্লক্ষ্য আনুবীক্ষণিক সংস্থানগত বদল, জীবজগতের বিবর্তনের পথ বেয়ে আমাদের অচেতন এখনো তাকে বোঝে, সচেতন আর চিনতে পারে না। চিœআর্পিত থেমে গেল রাজু, বুকের ওঠানামাটাও বন্ধ আছে তার। কে জানে কেন, হয়তো সত্যিই কিছু বোঝাতে, বা, বোঝে কিনা এটা পরখ করতে, পরখ তো তাকে করে চলতেই হয়, চলতেই হয়, ইউ ক্যান নেভার বি টুউ কশাস, চোখের পাতা একটু নামিয়ে আনে রূপেন। চোখের মাঝামাঝি অব্দি। ইচ্ছিত হোক, বা অনিচ্ছিত, সিগনাল পেতে কোনো ভুল হয় না রাজুর, বুক পেট তলপেট নামিয়ে আনে মেঝেতে, তারপর একটু একটু করে, ধীরে, নিস্পন্দ জোঁকের গতিতে, বা, ঋজুরেখ কেঁচোর গতিতে, এগোতে থাকে তার আরব্ধের দিকে, রূপেনের দিকে। মেরুদণ্ডী বলে রাজুকে এখন মনেই হয় না।
সমস্ত ব্যায়াম যোগ প্রাণায়াম ইত্যাদি হয়ে যাওয়ার পর, ব্রেকফাস্টের পর, কাজ শুরুর আগে, ডাক্তারের আদেশেই, এই সময়টা পরিকল্পিত ভাবেই, একটু ফাঁকা রাখা আছে। কিন্তু সেই সময়টুকুকে নিতে পারে না রূপেন, খুব অসুবিধে হয় তার। ভীষণ ফাঁকা লাগে, শূন্য লাগে। মনে হতে থাকে, কিছু তো আর করার নেই তার। আসলে সমস্ত শত্রু শেষ হয়ে গিয়েই সমস্যাটা হয়েছে তার। শত্রু হওয়ার মত জোরালো যারা আছে তার পৃথিবীতে, তারা সবাই তার বন্ধু। মন্ত্রী, পুলিশ, মিলিটারির অফিসার, সাংবাদিক, ফিল্ম-ডিরেক্টর,আন্ডারওয়ার্ল্ডের অন্য ডনেরা — রূপেনের জানা পৃথিবীর গুরুত্ত্বপূর্ণ সব, সমস্ত মানুষই তার মিত্র এখন।
মাঝে মাঝে শত্রু বানানোর খেলা করেও দেখেছে রূপেন। জমে না, টিক করে না। শোয়াশুয়ি বা যৌনতাটা কোনো ব্যাপার না, কিন্তু রিতুকে তো সত্যিই সে প্রোটেক্ট করতে চায়, রিতুর কোনো কষ্ট হলে সে অস্থির হয়ে ওঠে। সেই রিতুকে, নিজের দৃষ্টির ভিতরে, ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় হোক, বা সামনাসামনি, রেপ করিয়ে দেখেছে, অন্য নানা কিছু করিয়ে দেখেছে, কষ্টটার জন্যে কষ্ট হয়, কিন্তু রাগ হয় না। শত্রু বানানোর খেলাটা জমে না। লোকটাকে মেরে দিলেই, ব্যাস গোল্লা, খেল খতম, মজা কই, শত্রু বানানোর মজা, লড়াইয়ের মজা?
এই রাজুদের প্ল্যানটাও কী নষ্ট হয়ে যাবে? মাফিয়া ডন রূপেন হয়ে ওঠার এই এতগুলো বছরে, যত যত লোক তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, ষড়যন্ত্র করেছে, তারা প্রত্যেকেই এখন পরাজিত। মোট ছজন। অন্যরা তুলে আনার প্রক্রিয়াতেই লোপাট হয়ে গেছে — তাদের জন্যে খারাপ লাগে রূপেনের, হয়তো তাদের ভিতর থেকে বেরোতে পারত তেমন সত্যিকারের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী। এই ছজনকে এখন ছাড়া আছে তার এই প্রাসাদে, এমনিতে কোনো আলাদা পাহারা নেই এদের কারোর উপর, কিন্তু রূপেনের চেয়েও ভালো করে জানে রূপেনের এই প্রাক্তন প্রতিদ্বন্দ্বীরা, রূপেনের সাম্রাজ্য ছেড়ে পালানো কত শক্ত। আর পালাতে গেলেই, রূপেন এদের ধরবে আর মারবে। বা মারার চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু। পালাবি কেন, রূপেন প্রায়ই বলে, চক্রান্ত কর, আমায় মেরে ফেল, তখন এই গোটাটাই তোর।
রাজু, একসময় একা হাতে, বন্দুক না, শব্দ হবে, ছুরি দিয়ে একতাল লোককে নি:শব্দে মেরে, প্রায় রূপেন অব্দি পৌঁছে গেছিল, রূপেনের চোখের পাতার কমান্ড মেনে একলপ্তে অনেকটা পিছিয়ে যায়। এসব অপদার্থদের আর ভালো লাগছে না রূপেনের।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।