রূপাঞ্জলের গল্প– আনোয়ারা আলম

বহু বছর আগে দূরের এক ভিন দেশে, সুখী এক পরিবার বসবাস করতো। দেশটা যেমন সুন্দর, ওদের ছোট্ট বাড়িটাও ছিল পরিপাটি। ছিমছাম, আনন্দ ও শান্তিতে ভরপুর, অভাব ছিল না কোন কিছুর। তবে ওদের মনে একটা কষ্ট ছিল।
“আহা! আমাদের সংসারে যদি একটা শিশু থাকতো, তাহলে আদরে ও যত্নে তাকে বড় করে তুলতে পারতাম।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুজনে প্রায় কথাটি বলতো।
তাদের ছোট বাড়ির পাশে ছিল এক পুরনো জমিদার ভবন। বিশাল ভবনটির সামনে চমৎকার এক বাগান, নানা বর্ণের ও রংয়ের বিভিন্ন রকমের ফুল একদিকে, অপর পাশে সব্‌জী বাগান। লোকজন বলতো- ওখানে নাকি এক দুষ্টু ডাইনি বুড়ি থাকে। একদিন-অলস দুপুরে ঐ পরিবারের স্ত্রী লোকটি আপন মনে ঐ বাগান দেখছিলো। হঠাৎ চোখে পড়ল-সতেজ ও সবুজ রংয়ের লেটুস পাতাগুলো বাতাসে দুলছে আর ওকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
এরপর থেকেই কি যে হলো-কিছুই ভাল লাগে না, কাজ করতে ইচ্ছা হয় না, ঘুম হয় না, মনের মাঝে যেন সারাক্ষণ কেবলি টসটসে লেটুস পাতার জন্য এক ধরনের হাহাকার। শেষ পর্যন্ত স্বামীকে বলে-“কেন যেন এত অস্থির লাগছে! আচ্ছা! তুমি দেয়ালের ওপার থেকে অন্ততঃ একটি লেটুস পাতা আমার জন্য এনে দিতে পারবে? নয়তো-বোধ হয় বাঁচবো না।”
দুষ্ট ডাইনির কথা ভেবে লোকটি কোন ভাবেই রাজি হচ্ছিল না। কারণ সে তো জানে ঐ বাড়িতে এক ডাইনি বুড়ি থাকে। কিন্তু যতই সময় গড়ায়, ততই তার স্ত্রী যেন আরো অস্থির, কেবলি লেটুস পাতার জন্য তার আকুলতা। একটা সময়ে সে অসুস্থ হয়ে একেবারে বিছানায়। মনে হল সে যেন আর বাঁচবে না। নিরুপায় হয়ে ঐ লোকটি গভীর নিশুতি রাতে, দেয়াল টপকে যেই বাগানে পা রেখেছে, অমনি রাতের নির্জনতা ভেঙে, হাঁড় কাঁপানো তীক্ষ্ম ও খনখনে গলায় এক চিৎকার, ভয়ে প্রায় বেহুঁশ হয়ে যাবার মত, থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে তাকিয়ে দেখে, ওর সামনে ভয়ংকর চেহারা সেই ডাইনি বুড়ি। কুকুরের মত ঘেউ ঘেউ শব্দে প্রচণ্ড গর্জনে বলল-“এত বড় সাহস তোমার? অনুমতি ছাড়া আমার বাগানে ঢুকেছো?”
লোকটি এবারে হাত জোড় করে করুণভাবে মিনতি করলো “আমার স্ত্রী খুউব অসুস্থ। অন্ততঃ একটা হলেও লেটুস পাতা যে আমাকে পেতে হবে। নয়তো সে মারা যাবে।”
ডাইনি এবার যেন কিছুটা নরম কণ্ঠে “ঠিক আছে, কিছু পাতা তুমি নিতে পার। তবে একটা শর্তে।”
“কি শর্ত বলুন! যা বলবেন, তাই আমি মেনে নেবো।”
তোমাদের প্রথম সন্তান জন্ম নেবার সাথে সাথে, আমাকে দিয়ে দিতে হবে। কি রাজী?”
লোকটি তখন এমনিতেই ভয়ে আধমরা, সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে বললো “আপনি যা বলেছেন তাই হবে।”
এরপরে এক মুঠো লেটুস পাতা নিয়ে খুউব তাড়াতাড়ি, যেন এক দৌড়ে বাড়িতে চলে এল। আর তাজা-সবুজ লেটুস পাতা হাতে নিয়ে স্ত্রীর সে কি আনন্দ! মনে খুশিতে দিন কয়েক পরে এবারে সুস্থ, আগের মত হাসি খুশি ও প্রাণবন্ত। এই ঘটনার কয়েক মাস পরে-ওদের এতদিনের চাওয়া পূরণ করে জন্ম নিল, ঘর আলো করা ফুটফুটে কন্যা শিশু। দু’জনে মিলে শিশুটিকে জড়িয়ে ধরে যখন আদর করছে-তখনি খন খন কণ্ঠে সেই ডাইনি বুড়ির আগমন।
“আমাকে কথা দেওয়ার বিষয় কি ভুলে গেছ?” লোকটিকে প্রশ্ন করলো অনেকটা চীৎকার করে। কি আর করা! ওরা যে অসহায়। নয়তো বুকের ধনকে কি কেউ দিতে চায়? অতএব, মনের সব কষ্ট, পেয়ে হারানোর বেদনা-পাথর চাপা দিয়ে ডাইনির কোলে আদরের সন্তানকে দিয়ে দিতে বাধ্য হলো। ডাইনিতো ভীষণ খুশি এত সুন্দর একটা শিশু! ওর নাম রাখলো রূপাঞ্জল-আর বেশ যত্নে-আদরের ওকে লালন পালন করতে লাগল। যত বড় হতে থাকে আহা! দিনে দিনে রূপাঞ্জল যেন আরো রূপময়ী, মায়াবতী- দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়, আদর করতে ইচ্ছে করে। ডাইনির মনে তো ভারী এক আশংকা। এত সুন্দর মেয়েটাকে যেই দেখবে, ওকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। তাই সবার চোখের আড়াল করার জন্য ওকে নিয়ে চলে গেল- গভীর জঙ্গলের এক অনেক উঁচু দুর্গে। দুর্গটির চারদিকে কেবলি দেয়াল। আসা যাওয়ার দরজা নেই, উপরে ওঠার কোন সিঁড়ি নেই- কেবলি একেবারে উঁচুতে ছোট্ট একটি জানালা। আর এই দুর্গেই রূপাঞ্জলকে অনেকটা বন্দি করে রাখার মতো আটকে রাখলো। রূপাঞ্জল বড় হতে থাকে একাকী- খেলার বা কথা বলার কোন সংগী নেই। নিজের সাথে কথা বলা, ডাইনি বুড়ির আনা খেলনা নিয়ে সময় কাটানো, অথবা আনমনে গান করা। এভাবেই যেন এক বিষন্ন সময়ে দিন কাটে রাত আসে। মাঝে মধ্যে ডাইনি বুড়ি ওকে দেখতে আসে। রূপাঞ্জলের চুল খুব সুন্দর, ঝলমলে সোনালী রংয়ের, সূর্যের আলোতে ঝিকমিক করে জ্বলতে থাকে। অনেক লম্বা! একেবারে মাথা থেকে পা পর্যন্ত চুলগুলো মোটা এক বিনুনীতে সব সময় বাধা থাকে। ডাইনি এসে নীচ থেকে ডাকতে থাকে।
“রূপাঞ্জল, রূপাঞ্জল-
তোমার বেনীটা নামিয়ে দাও।”
এরপর ওই বেনী ধরে, হাঁফাতে-হাঁফাতে ধীরে ধীরে ওপরে উঠে, ছোট্ট জানালা দিয়ে টুক করে ঢুকে যায় দুর্গের ভেতরে।
একদিন, একাকি রূপাঞ্জল, নিজের মনে গান গাইছে মধুর সুরে। দুর্গের ছোট্ট জানালা দিয়ে সেই সুরের মূর্ছনায় জঙ্গলের চারিপাশে যেন তার অপূর্ব রেশ ছড়িয়ে পড়েছে। আর ঐ সময়ে দুর্গের পাশ দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিল সেই দেশের রাজপুত্র। তার কানে এল অপরূপ মাধুরী মাখানো সুরের মোহনীয় পরশ। মুগ্ধ আবেশে-রাজপুত্র অমনি দাঁড়িয়ে গেল।
“এত সুন্দর কণ্ঠের গান-আমিতো এর আগে কখনো শুনিনি”। নিজেকে বলল আপনমনে। “এই গান কে গাইছে, খুঁজে বের না করা পর্যন্ত, আমি এখান থেকে যাবো না।
এই ভেবে রাজপুত্র নিজেকে এক পাশে লুকিয়ে, চুপিসারে দেখলো, দূর্গের ওপরে এক ডাইনি বুড়ির ওপরে ওঠার রহস্য। ঐ দিন বিকেলে, ডাইনি চলে যাওয়ার পরে রাজপুত্র ডাকলো-
‘রূপাঞ্জল, রূপাঞ্জল,
তোমার চুলটা নামিয়ে দাও।’
রূপাঞ্জল তো অবাক! একেবারে অচেনা এক কণ্ঠ! জানালা দিয়ে দেখে ‘ওমা! কি সুদর্শন এক রাজপুত্র! নীচে দাঁড়িয়ে ওর নাম ধরে ডাকছে। কি আনন্দ! তাড়াতাড়ি ওর সুদীর্ঘ বেনীটা নামিয়ে দিতেই উঠে এল রাজপুত্র এবং একেবারে ওর কাছে। এতটা বছর পরে ওর কাছাকাছি বয়সের এক রাজপুত্রকে পেয়ে, ওর গল্প আর শেষ হয় না। এতদিন এতটা সময় ওযে কাউকে পায়নি- যার সাথে গল্প করা যায়, মনের কথা বলা যায়! আর রাজপুত্র! সে তো আগেই গানের সুরে মুগ্ধ হয়েছিল। এখন রূপাঞ্জলের হৃদয় চমকানো সৌন্দর্যে সে যেন অভিভূত! এত রূপবতী মেয়ে, এভাবে বন্দি হয়ে আছে এতটা বছর! ওকে সে এই জেলখানা থেকে মুক্ত করে বের করে আনবে-এই শপথে বললো-‘রূপাঞ্জল! আগামীকাল রাতে তোমাকে আমি এই জেলখানা থেকে মুক্ত করে নিয়ে যাবো। আর মাত্র একটা দিন অপেক্ষা করো।’
পরের দিন ডাইনি এসে দেখে, এ যেন আগের রূপাঞ্জল নয়। গম্ভীর কি যেন ভাবছে, ভাল করে কথাই বলছে না। আশ্চর্য! এতটা বছর পরে কি হলো ওর? এক ধরনের আশংকা নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো- ‘রূপাঞ্জল! তোমার কি হয়েছে? কি ভাবছ তুমি? আজকে তোমাকে অচেনা লাগছে?’ রূপাঞ্জল-এতদিন যে মেয়েটি ডাইনিকে ছাড়া আর কাউকে দেখেনি, জন্মের পরই মা বাবার আদর থেকে আলাদা হয়ে গেছে। পৃথিবীর কোন জটিলতা যাকে স্পর্শ করেনি, সহজ-সরল রূপাঞ্জল, তাই তার জীবনে ঘটে যাওয়া সত্যি ঘটনার কথা ডাইনিকে জানিয়ে বললো- ‘আমি আর এখানে থাকবো না। এই বন্দি জীবনে থাকতে আর ভালো লাগছে না। রাজপুত্রের সাথে চলে যাবো। ও আমাকে নিতে আসবে কাল রাতে।’ ডাইনি বুড়ি সব শুনে প্রথমে একেবারে হতভম্ব ও স্তব্ধ। পরমুহূর্তে একেবারে ক্ষিপ্ত এবং অগ্নিমূর্তি ধারণে, চীৎকার করে বলতে লাগলো- ‘শয়তান মেয়ে! দুধ দিয়ে এতদিন কালসাপ পুষেছি? এভাবে আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা! তোর এতবড় দুঃসাহসের শাস্তি দেখ কিভাবে দিচ্ছি।’ প্রচণ্ড রাগে প্রায় পাগলের মতো সাথে সাথে নিয়ে এল ধারালো এক কাঁচি। এরপরেই রূপাঞ্জলের মোটা বেনুনির গোড়ালীতে ঘ্যাচাং করে পুরোটাই কেটে বেনীরটা ফেলে দিল মেজেতে। তারপর রূপাঞ্জলকে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে গেল বহু দূরের এক মরুভূমিতে এবং ওখানে একা ওকে ফেলে রেখে ফিরে এল। বেচারী রূপাঞ্জল নিজের বোকামীর জন্যেই এত বড় শাস্তি এতদিন দুর্গে ছিল বন্দি- আর এখন ধূ ধূ মরুভূমিতে, জনশূন্য খা খা প্রান্তরে, একাকি কাঁদতে লাগলো, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।
দূর্গে ফিরে ডাইনি এবারে রাজপুত্রের অপেক্ষায়। যথারীতি ঠিক সময়ে রাজপুত্রের ডাক এল-
‘রূপাঞ্জল-রূপাঞ্জল-
তোমার চুলটা নামিয়ে দাও।’
ডাইনি আগে থেকেই বেনুনির গোড়াটা লোহার হুকের সাথে আটকে রেখেছিল। এবার ডাক শুনেই রাজপুত্রের জন্য যেন সোনার পাত্র স্বরূপ বিনুনিটা টুপ করে ছুড়ে দিল। অধীর আগ্রহে রাজপুত্র বিনুনি ধরে উপরে উঠেই একেবারে অগ্নিমূর্তির মতো ডাইনির মুখোমুখি। জানালা দিয়ে ঢোকা আর হলো না, তার আগ মুহূর্তেই ডাইনিটা রাজপুত্রকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল সুউচ্চ দূর্গ থেকে। সাথে সাথে রাজপুত্র নিজেকে সামলে নেবার সময়ই পেল না-বরং অতি উঁচু জায়গা থেকে ঝপাং করে পড়ে গেল কাঁটা গাছের ঘন ঝোপের ভেতর। আর কাঁটাগুলো ওকে ক্ষত বিক্ষত করে দিয়ে ঢুকে গেল রাজপুত্রের দুই চোখে এবং এরপর থেকে ওর জীবনে নেমে এল ঘন ঘোর অন্ধকার। আর দুই চোখের আলোই নিভে গেল চিরতরের জন্য।
এরপরেও অন্ধ আলোহীন রাজপুত্র লাঠি হাতে ঘুরে বেড়াতে লাগলো জঙ্গলে-প্রান্তরে, নানা স্থানে এবং বছরের পর বছর। একদিন এক শূন্য মরুভূমির কাছাকাছি, তার কানে এল সেই সুমধুর কণ্ঠের গানের সুর।
‘কে ওখানে? কে গাইছে? এতো আমার রূপাঞ্জল ছাড়া আর কেউই হতে পারে না।’ রূপাঞ্জল! রূপাঞ্জল! চিৎকার করে ডাকতে লাগলো রাজপুত্র।
এদিকে রূপাঞ্জলও দেখলো রাজপুত্রকে, যদিও সে চোখে দেখতে পাচ্ছে না-কিন্তু লাঠি হাতে এগিয়ে আসছে এদিকেই হ্যাঁ। ওর দিকেই তো আসছে।
রূপাঞ্জলও এবারে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গেল রাজপুত্রের দিকে। আর ওর চোখের পানি যেন বৃষ্টির মত ঝরে পড়লো রাজপুত্রের আলোহীন চোখের ওপর এবং কেটে যেতে লাগলো সব অন্ধকার। কি অবাক কাণ্ড! রাজপুত্র যে দেখতে পাচ্ছে। এই তো এই যে রূপাঞ্জল! অপরূপ সৌন্দর্যের অসাধারণ মায়াবতী-রূপাঞ্জল।’
রাজপুত্র ওকে নিয়ে ফিরে এল রাজপ্রাসাদে। সেখানে রাজা ও রাণী। যারা এতদিন তাদের রাজপুত্রকে হারিয়ে প্রায় পাগলের মত ফিরে পেল আদরের সন্তানকে। আর যার সাথে পরীর মতো অপরূপ সুন্দরী এক মেয়ে। অতঃপর রাজপুত্র এবং রূপাঞ্জলের বিয়ে হল দারুণ জাঁকজমকের সাথে। শৈশব থেকে এক ডাইনি বুড়ির বন্দি হয়ে থাকা অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি পেল রূপাঞ্জলের জীবন। সুখে শান্তিতে ভালবাসা ও আনন্দে রাজপ্রাসাদে রাজপুত্রের সাথে এক পরিপূর্ণ ও দীর্ঘ জীবন শুরু হলো রূপাঞ্জলের।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!