গল্পের ২য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
এক দেশে এক রাজা ছিল, তার একটা চোখ পাথরের। সেই রাজার তিন রানি, একজন জাদুবিদ্যা জানে, একজন সারাদিন ঘুমোয় আর সারারাত জাগে, সবচেয়ে ছোট রানির একটাও দাঁত নেই। জন্ম থেকেই তার দাঁত ওঠেনি, তাই সে চোখ দিয়ে হাসে। যে রানি জাদু জানে, তার নাম আশ্চর্যময়ী। আর নিশাচরী রানির নাম চাঁদনি। ছোটরানির নাম ফুটফুটি, এটাই তার ভালো নাম আর ডাক নাম।
রাজার নাম রাজচন্দ্র, তাই শুধু রাজা বললেই চলে। এই রাজাটি খুব চিনেবাদাম ভালোবাসে। তাই তার রাজ পোশাকের দু-পকেট ভরতি চিনেবাদাম থাকে সবসময়। আশ্চর্যময়ী ইচ্ছেমতন ঝড়-বৃষ্টি ডেকে আনতে পারে। প্রাসাদের অলিন্দে দাঁড়িয়ে এক-এক সন্ধেবেলা সে আকাশের দিকে দু-হাত তুলে বলে, আয়-আয়।
একটু পরেই শোঁ-শোঁ শব্দ শুরু হয়। রাজার বড় দুঃখ, তার কোনও দুঃখবোধ নেই। দুঃখ কাকে বলে, তা সে জানেই না। কোনওদিন তার এক ফোঁটাও চোখের জল পড়েনি। একটা চোখ না থাকলেও কি মানুষ কাঁদে না? জন্মান্ধরাও তো কাঁদে। এই রাজা কাঁদতে শিখলই না! নিশাচরী মেজরানি রাত্তিরবেলা স্নান করতে ভালোবাসে। রাজপ্রাসাদের পেছন দিকে অনেকটা বাগান। তার পাশেই একটা ছোট নদী। নদীটি ছোট হলেও সারা বছরই ছলছল করে জলস্রোত।
রাত্তিরবেলা স্নান করলে আব্রু লাগে না। মধ্যরাত্রি পেরিয়ে গেলে ছোটো নদীটিতে নেমে চাঁদনি মনের আনন্দে সাঁতার কাটে। আসল রাজ্য শাসন করে মন্ত্রী, সেনাপতি আর কোটাল।
রাজা শুধু চিনেবাদাম খায় আর গল্প শোনে। দুঃখের গল্প। রোজই একজন দুজন লেখক-কবিকে ডেকে আনা হয়, তারা প্রাণপণে দুঃখের কাহিনি বানায়, রাজাকে কাঁদাতে পারলেই তো মিলবে প্রচুর পারিতোষিক। এখনও পর্যন্ত কেউই সক্ষম হয়নি। রাজপুত্র কিংবা রাজকন্যা কি নেই? আছে কয়েকজন, কিন্তু তারা এলেবেলে।
তারা গায়ে ফুঁ-দিয়ে বেড়ায়। বিকেলবেলা যখন কবি-লেখকরা গল্প-গাথা শোনাতে আসে, তখন আশ্চর্যময়ীকে ধারেকাছে দেখা যায় না। চাঁদনি তখন ঘুমোয়। শুধু ফুটফুটি মাঝে মাঝে এসে রাজার পাশে বসে। ফুটফুটির বয়েস মাত্র তেইশ। এই বয়েসের মেয়ে সম্পূর্ণ ফোকলা, এরকম কেউ কখনও দেখেনি।
তার হাসি-বিচ্ছুরিত চোখ দুটির জন্য তার মুখে একটা সুন্দর আভা ফুটে ওঠে, তাই তাকে বিয়ে করার জন্য অনেক হোমরাচোমরা রাজা, মহারাজা, শ্রেষ্ঠী, যোদ্ধারা উঠে পড়ে লেগেছিল। রাজা রাজচন্দ্র অনেক টাকা-পয়সা খরচ করে ফুটফুটিকে জিতে এনেছেন। কেউ একজন প্রস্তাব দিয়েছিল, ছোটরানিকে নকল দাঁত পরিয়ে দিলেই তো হয়।
আজকাল কত রকম ব্যবস্থা হয়েছে। তাই শুনে রাজা এমন চটে গেল যে তখনই সে ব্যক্তিকে পাঠিয়ে দিল নির্বাসনে। ফুটফুটিকে সঙ্গে নিয়ে গল্প শোনা মহা মুশকিলের ব্যাপার।
অতি কাঁচা দুঃখের গল্প শুনতে-শুনতে মাঝপথে তার চোখের হাসি মুছে যায়। টপ-টপ করে জল ঝরতে থাকে, তারপর সে ফুঁপিয়ে ওঠে। তা দেখে রাজার হাসি পায়।
এ-রাজা গান-বাজনা বিশেষ পছন্দ করে না। নর্তকী-বাঈজি নিয়ে রাত্রি যাপনের শখ নেই। তার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে চিনেবাদামের খোসা ভাঙার শব্দ। মুচুর-মুচ। মুচুর-মুচ। তবু এ-প্রাসাদের অন্দরে কেউ একজন লুকিয়ে-লুকিয়ে বাঁশি বাজায়।