গল্পের শেষ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
ফুটফুটির ঘরের দিকে যেতে যেতে রাজা অনেক সময় শোনেন সেই পাখি আর তাঁর ছোটো রানির বাক্যালাপ, কিছুই বুঝতে পারেন না। রাজা যে সব সময় প্রাসাদেই বসে থাকেন, তা নয়। মাঝে-মাঝে তিনি নগর পরিভ্রমণে যান ছদ্মবেশে। কোনওদিন ফকির-দরবেশ সাজেন, কোনওদিন স্ত্রীলোক। নগর ছাড়িয়ে পল্লীগ্রামেও চলে যান, শুনতে পান মানুষের ঝগড়াঝাঁটি, কান্নাকাটি।
এ সবও যেন পাখির ভাষার মতন, কিছুই তাঁর বোধগম্য হয় না। একদিন একজন নবীন কবিকে ধরে আনা হল, তার নাম সুজয়। এর আগে কয়েকবার তাকে অনুরোধ করা হয়েছিল, সে আসতে চায়নি। কবিটি বলল, মহারাজ, আপনাকে কাঁদাবার মতন কোনও গল্প-কবিতা আমার জানা নেই। তাই আমি এতদিন আসিনি।
তবে, আমি একজনের জীবনী লিখছি, সেটা শেষ হলে আপনাকে শোনাবার ইচ্ছে আছে। রাজা জিগ্যেস করল, কার জীবনী? সুজয় বলল, আপনার। রাজা ভুরু কুঁচকে, চিবুকে হাত ঘষতে-ঘষতে বলল, আমার? তুমি আমার জীবনের কতটুকু জানো? কবি বলল, আপনার জন্মকাহিনি কিংবা বাল্যজীবন সম্পর্কে কিছুই জানি না বটে, কিন্তু আমি লিখছি আপনার ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে।
আমার পরজন্ম নিয়ে? না, না, এই জন্মই। অদূর ভবিষ্যতের সব কথা।
ধরুন, শুরু হয়েছে এ-বছর থেকেই। এখনও অবশ্য পুরোটা শেষ হয়নি। যতখানি লিখেছ তাই-ই শোনাও।
কবিটি মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পাঠ করল সেই আখ্যান কাব্য। সব শুনে রাজা গম্ভীরভাবে জিগ্যেস করল, এ সবই আজগুবি কাহিনি। কবি বলল, না মহারাজ, সত্য ঘটনা অবলম্বনে। রাজা বলল, যা এখনও ঘটেনি, তা সত্য হবে কি না, তুমি জানলে কী করে? কবি বলল, রামের জন্ম না হতেই রামায়ণ লেখা হয়নি? সব ঠিক-ঠিক মিলেছিল কি না?
কবিরা এরকম পারে। রাজা বলল, আচ্ছা, পরবর্তী সাতটা দিন দেখা যাক! সেই যে একদিন ছাদে উঠে রাজা আশ্চর্যময়ীর কেশাকর্ষণ করে ঝড় থামিয়েছিল, তারপর থেকে আর একবারও ঝড় আসেনি।
বৃষ্টিময় মেঘও আসেনি। খর তপ্ত হচ্ছে বাতাস। এর মধ্যে আশ্চর্যময়ীর সঙ্গেও রাজার কোনও কথা হয়নি। এক দাসীর মুখে খবর পেয়ে রাজা দৌড়ে গেল আশ্চর্যময়ীর ঘরে। সেখানকার দৃশ্য দেখে রাজা একেবারে তাজ্জ্বব।সারা ঘর ভরতি চুল ছড়ানো। কালো মেঘের মতন পিঠ-কোমর ছড়ানো চুল ছিল আশ্চর্যময়ীর। প্রায় সব উঠে গেছে। শেষ কয়েকগাছি চুল টেনে-টেনে তুলছে আশ্চর্যময়ী। রাজা শুধু বলল, এ কী? আশ্চর্যময়ী মুখ ফেরাল।
তার নাকের নীচে গোঁফ গজিয়েছে, গালে নবীন তৃণের মতন দাড়ি।
দৃষ্টিতে লাল রঙের আভা। রাজার বুক কেঁপে উঠল। সেই কবিটি লিখেছিল না, রাজার এক রানি হঠাৎ একদিন পুরুষ হয়ে যাবে?
রানি যদি পুরুষ হয়ে যায়, সে কি হবে রাজার প্রতিদ্বন্দ্বী? দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে এসে রাজা প্রহরীদের হুকুম দিল, এ-ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখ। আর কোনওদিন খুলবে না। একটু শান্তি পাওয়ার জন্য রাজা গেল ফুটফুটির ঘরের দিকে।
পাখির খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফুটফুটি। তার দু-চোখে ঝিলমিল করছে হাসি। রাজা জিগ্যেস করল, কেমন আছিস রে ফুটফুটি? ফুটফুটি দুদিকে দুটি হাত ছড়িয়ে দিল।