১৩ই জুন, ২০১১, সকাল ১১টা “বার বার বলছি, এই নাম্বারের কোন রুম আমাদের নেই।
আর দিমিত্রি শোভন নামে কোন ভদ্রলোকও আমাদের এখানে কাজ করেন না।
আপনি ভুল জায়গায় এসেছেন” অসহিষ্ণুতা ফুটে উঠলো মারুফের কন্ঠে। রুমানার কন্ঠে আকুতি, “কিন্তু আমি ফোনে ইন্টারভিউ দিয়েছি।
এই যে দেখুন জয়েনিং লেটার। এটা তো আপনাদেরই অফিসের ঠিকানা, তাই না?” কাগজের উপরে মতিঝিলের স্বনামধন্য অফিসের ঠিকানাটি মনোগ্রাম সহকারে লেখা।
এটা যে তাদেরই অফিসিয়াল কাজে ব্যবহৃত কাগজ, তা নিয়ে মারুফেরও কোন সন্দেহ নেই। মারুফের কপালে ভাঁজ পড়ে।
সে এই অফিসে জয়েন করেছে পাঁচ মাস হলো। প্রতি মাসে কেউ না কেউ তাদের অফিসে জয়েনিং লেটার নিয়ে আসছে।
তাদেরকে ২১৩ নং রুমে দিমিত্রি শোভন সাহেবের সাথে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।
তাদের অফিসের কোন ব্যক্তিই যে কাগজ চুরি করে এই কান্ডটা ঘটাচ্ছে; সেটা পাগলেও বুঝবে।
কিন্তু মারুফের মাথায় আসে না যে এই প্রাক্টিকাল জোকটা করে মানুষকে কষ্ট দেয়ার মানে কি? রুমানার চোখে জল আসি আসি করছে।
মায়া কাড়া চেহারার তরুনীর দিকে তাকিয়ে মারুফের একটু মন নরম হলো। “দেখুন, মনে হয় আপনার সাথে কেউ মজা করেছে।
এটা আমাদের অফিসেরই কাগজ, মানছি। কিন্তু আমাদের এখন কোন টাইপিস্টের পোস্ট খালি নেই।এবং আমরা পেপারে সার্কুলারও দেইনি।
আপনি কোথা থেকে খবর পেলেন?” “আমাকে ফোন করা হয়েছিলো। আমি ডাক বাক্সের নাম্বারে সিভি পাঠাই।
এরপর ১ সপ্তাহ আগে ফোনেই আমার ইন্টারভিউ নেয়া হয়। জয়েনিং লেটার ডাকে পেয়ে তারপরে এসেছি”। রুমানা থেমে থেমে বলে। “আমি অত্যন্ত দুঃখিত ম্যাম।
কিন্তু আমাদের অফিসে ফোনে ইন্টারভিউ নেবার কোন নিয়ম নেই। আর আমরা লোক লাগলে পেপারে প্রকাশ করি। কারো বাসায় ফোন করে নয়।
আর দেখতেই পাচ্ছেন আমাদের অফিস ৬ তলা। এখানে আমরা প্রতি ফ্লোর এ,বি,সি এভাবে মার্ক করি। সুতরাং ২১৩ নং রুম থাকার প্রশ্নই ওঠে না”।
কথা শেষ করেই মারুফ তার ফাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রুমানার চোখে জল টলমল করছে।
এরকম নিষ্ঠুর মজা তার সাথে কে করতে পারে? অবসন্ন ভাবে সে সামনে আগায়। জানেও না কোনদিকে যাচ্ছে।
এখন সে কিভাবে বাসায় যাবে? চাকরি হয়েছে শুনে মা আর ছোট বোনটা কি খুশীটাই না হয়েছিলো। বাবা মারা যাবার পর থেকে তার মা সেলাইএর কাজ করে বহু কষ্টে দুই বোনকে বড় করেছে।
বাংলায় অনার্স করে সে প্রায় ১ বছর ধরে চাকরীর চেষ্টা করছে; হয়নি। অযাচিতভাবে এই খবর আসায় তার মা আনন্দে কাল মিষ্টি কিনে এনেছিলো।
এখন সে কোন মুখে বাসায় যাবে? চারপাশে সবাই ব্যস্ত ভাবে ফাইল আর কাগজের স্তুপে মাথা ডুবিয়ে বসে আছে। তার কষ্টে কারো কিচ্ছু যায় আসে না।
তৃষ্ণায় তার গলা শুকিয়ে কাঠ। করিডোরের শেষ প্রান্তে একটা ফিল্টার দেখা যাচ্ছে।
রুমানা অবসন্ন ভাবে তার দিকে এগিয়ে যায়। পানির গ্লাস ঠোঁটে ছোঁয়ায় সে। শীতল পানি তির তির করে গলা বেয়ে নেমে পুরো শরীরে শীতলতার আবেশ ছড়িয়ে দেয়।
ডানে তাকিয়েই রুমানা অবাক হয়ে যায়। পিতলের ঝকঝকে প্লেটে কালো রঙ দিয়ে লেখা, রুম নং ২১৩।
পানি নেয়ার সময়ও তো আশে পাশে কোন দরজা ছিলো না। নাকি সে খেয়াল করেনি? আনন্দে তার বুক কাঁপতে থাকে।
সামনের লোকটি মিথ্যুক ছাড়া কিছু না। কেন মিথ্যে বলবে? নির্ঘাত তার পরিচিত কেউ এই চাকরীর জন্য আবেদন করেছে।
আশে পাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না; এমনকি দরজার সামনে কোন পিয়নও নেই। রুমানা একটু অস্বস্তিবোধ করতে থাকে।
বড় স্যারের রুমে কি খবর না পাঠিয়ে ঢোকা ঠিক হবে? দ্বিধা দ্বন্দে শেষ পর্যন্ত রুমানা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
সাবেকী আমলের ভারী কাঠের নকশা করা দরজা। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে কালো রঙ দিয়ে আঁকা খুবই হিজিবিজি ধরনের নকশা।
রুমানার প্রাচীন ভাষা নিয়ে প্রচুর আগ্রহ। দরজায় হাত বুলিয়ে তার মনে হতে লাগলো এটা হায়ারোগ্লিফিক লেখা।
বুক ভরে শ্বাস নিয়ে সে নক করে। একবার, দুইবার। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার।
ভেতর থেকে ভারী কন্ঠ ভেসে আসে, “কে?” “মে আই কাম ইন স্যার?” বহুবার প্রাকটিস করা লাইনটি চমৎকার আত্মবিশ্বাসের স্বরে বলে রুমানা।
ভেতর থেকে নীচু স্বরের হাসি শোনা যায়। “ইয়েস, ইয়েস”। হাসিটার মাঝে কি আছে রুমানা জানে না, তবে তার গা শিউরে ওঠে।
হাতল ঘুরিয়ে দরজা সামান্য ফাঁক করে সে। ভিতরে আবছা অন্ধকার। রুমানা থমকে যায়।
আলো ছাড়া কি রুমে ঢোকা ঠিক হবে? আবার ভারী স্বরে কেউ বলে, “হু আর ইউ অ্যান্ড হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট?” রুমানা দরজা ধরেই বলে, “স্যার, আমি ফেরদৌসি রুমানা।
টাইপিস্ট পদের জন্য আপনি ফোনে ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। জয়েনিং লেটার নিয়ে এসেছি”। “হুমম, কাম ইন”।
রুমানা কি করবে বুঝতে পারে না। ভারী কন্ঠ যেন তার অস্বস্তি বুঝতে পারলো। “আমার মাইগ্রেনের সমস্যা আছে।
অ্যাটাকের সময় আলো সহ্য করতে পারিনা। কিছুক্ষন ধরে আমার মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে”। এই চাকরী তার চাইই চাই।
মায়ের চোখে ছানি পড়া শুরু হয়েছে, অপারেশনের টাকাও তাদের নেই। মায়ের কথা মনে হতেই রুমানার সব দ্বিধা দূর হয়ে গেলো।
সে ভেতরে ঢুকে পড়লো। ভারী দরজা একা একাই বন্ধ হয়ে গেলো। পুরোপুরি অন্ধকার নয় রুম। এক পাশে ভীষন ম্রিয়মান একটি টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে।
আবছা আলোতে রুমানা বুঝলো ঘর কেন এত অন্ধকার। বিশ্রী রকমের কালো রঙ দিয়ে ঘরে রঙ করা।
অথবা সেটি অন্য কোন গাঢ় রঙ; এই আলোতে কালো মনে হচ্ছে। টেবিলে স্তুপিকৃত বই; তার ওপর রাশি রাশি ধূলা।
দেয়ালের দিকে মুখ করে রাখা চেয়ারের গায়ে এলিয়ে একজন মানুষ বসে আছে। আবছা আলোতেও ল্যাম্পের উপরে মাকড়সার জাল স্পস্ট।
এরকম নোংরা পুরানো ঘরে কেউ কাজ করতে পারে? রুমানা নাক কুঁচকায়। ইঁদুর মরেছে নাকি? এরকম বিশ্রী পচা গন্ধ কেন রুমে? হ্যাঁ, ইঁদুরই।
কিচ কিচ শব্দ হচ্ছে কোথা থেকে যেন। নাকে ওরনা চাপা দেয় সে। ডান পাশে তাকিয়ে রুমানা ভীষন চমকে ওঠে।
তিনটা চোখ তাকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করছে। অনেক কষ্টে চিৎকারটাকে সে চেপে রাখে। একটা মুখোস।
তবে পৃথিবীতে যে এরকম ভীতিকর ভয়ংকর মুখোসের কোন নির্মাতা থাকতে পারে, সেটাই তার ধারণাতে ছিলো না।
একটা পশুর মুখোস; বাঁকানো শিং, সিংহের কেশরের মত কেশর আছে। আবার মানুষের মত থুতনিতে দাঁড়িও আছে।
কপালের তৃতীয় চোখ কি দিয়ে বানানো কে জানে, মনে হচ্ছে ধক ধক করে জ্বলছে।
রুমানার মনে হতে থাকে মুখোসটা জ্যন্ত। “স্যার?” রুমানা ভীত কন্ঠে বলে। কোন উত্তর নেই।
“স্যার, আমি জয়েনিং লেটারটা কোথায় জমা দেব? আর আমার কাজটা কি হবে স্যার?” অদ্ভুত রকমের নিরবতা। রুমানা দুই পা এগোয়। গন্ধটা আর সহ্য হচ্ছে না।
কিচ কিচ শব্দটাও বেড়েই চলেছে। বের হয়ে যাবে নাকি? ছোটবোন টার কথা কানে ভেসে এলো, “বুবু, আমাকে কিন্তু এই ঈদে একটা জামা কিনে দিস।
মাত্র দুইটা জামাই রোজ কলেজে পড়ে যাই। সবাই কেমন করে তাকায়”। “স্যার? শুনতে পাচ্ছেন?” নিস্তব্ধতা আর সহ্য করা যাচ্ছে না। এগিয়ে গিয়ে রুমানা চেয়ার ঘোরায়।
কয়েক মূহুর্তের নিরবতা। এরপর ভয়ংকর চিৎকার করে রুমানা পিছিয়ে যায়। কিসে পা পড়ে সে বলতে পারবে না, এক রাশ বই আর আবর্জনার উপরে সে আছড়ে পড়ে।
রুমানা চিৎকার করতেই থাকে। সামনের চেয়ারে একটা মেয়ের মৃতদেহ বসে আছে। চোখ দুইটা খোলা।
রুমানার দিকে স্থির দৃষ্টিতে যেন তাকিয়ে আছে। মাংস পচে গলে জায়গায় জায়গায় খসে পড়েছে।
মাথার লম্বা চুল আর কাপড় ছাড়া বোঝার উপায় নেই যে সে নারী না পুরুষ।
পাশের ফাইল রাখার শেলফটা ধরে রুমানা উঠতে যায়, হাতে শক্ত স্যাঁতস্যাঁতে কি যেন লাগে।
তাকিয়ে দেখে সে বুক শেলফ ভেবে ধরে আছে একটা কঙ্কালের বাহু। সব দাঁত বের করে কংকাল হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছে।
রুমানা পিছনে তাকায়। একটা না, অনেক কংকাল। সবাই স্থির ভাবে রুমানার দিকে তাকিয়ে আছে। রুমানার মাথা কাজ করে না।
চিৎকার করতে করতে কোন রকমে কঙ্কাল গুলিকে লাথি মেরে সরিয়ে দরজার দিকে ছুটে যায়। কিন্তু দরজা কোথায়? চারিদিকে শুধু কালো রঙের দেয়াল।
রুমানা চিৎকার করে দেয়াল হাতড়াতে থাকে। এই তো, একটু আগে এখানে একটা দরজা ছিলো।
এখন কোথায় গেল? বদ্ধ ঘরে মাংস পচা বিশ্রী গন্ধে রুমানার শ্বাস বন্ধ হয়ে যায় প্রায়। হঠাৎ কিচ কিচ শব্দ বন্ধ হয়ে যায়।
সামনের ভারী কাঠের ডিজাইন করা আয়নার দিকে তাকিয়ে রুমানা দেখে পিছের দেয়ালের মুখোসের মুখে ভয়ংকর হাসি ফুটে উঠছে।
জিহবা লকলক করছে, তৃতীয় নয়ন ভীষন ক্ষুধা আর লালসার উল্লাসে উল্লসিত। রুমানা চোখ বন্ধ করে।
১৩ই জুলাই, ২০১১, সকাল ১১টা ডেস্কের সামনে অধীর আগ্রহে মিঃ মারুফের জন্য অপেক্ষা করছে আভা।
বহু আকাংখিত চাকরীটি অবশেষে সে পেয়েছে। ২১৩ নং রুমটি এখন খুঁজে পেলেই হয়। (সংগৃহীত)