রিসাইকেল

– “চলুন স্যার, এবার যাওয়া যাক। দেরী না করে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়াটাই ভাল।”
অনেকক্ষন ধরেই লোকটা ঘরের এককোনায় দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসছিল। এবার ভিড় ঠেলে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়ে দাঁত বের করে হেসে কথাগুলো বলল। অবাক হয়ে দেখলেন হরিচরণবাবু, এতজন লোক রয়েছে ঘরে, কিন্তু কেউই লোকটাকে খেয়াল করল না। ভালো করে আবার তাকিয়ে দেখলেন, কিন্তু চিনতে পারলেন না। এমনকি আগে কখনও দেখেছেন বলে তাও তাঁর মনে পড়ল না। কোথায় যাবার কথা বলছে লোকটা? তাঁর কোথাও যাবার কথা ছিল নাকি। কিছুই বুঝতে পারলেন না তিনি।
এমনিতেও খুব একটা বুদ্ধিমান মানুষ বলে তাঁর সুনাম কোনওকালেই ছিল না। তাছাড়া গত কয়েক মিনিট ধরে কি যে হচ্ছে কিছুই তাঁর মাথায় ঢুকছিল না। শরীরটা বেশ কিছুদিন ধরেই ভালো যাচ্ছিল না। আজ সকালে তো শ্বাসকষ্টটা বেশ বেড়েও গিয়েছিল। সাথে বুকে একটা চিনচিনে ব্যথাও করছিল। ছেলে, ছেলের বৌ তো পাশে ছিলই, অন্যান্য বেশ কিছু আত্মীয়স্বজন আর প্রতিবেশীরাও এসেছিল দেখতে। কিন্তু এই কিছুক্ষণ আগে তিনি উপলব্ধি করলেন যে বুকের ব্যথাটা হঠাৎ করে সেরে গেছে। শ্বাসকষ্টটাও আর নেই। শরীরটা বেশ হালকা ফুরফুরে লাগছে। সুস্থ হয়ে গেছেন এই ভেবে বেশ খুশী হয়ে উঠে বসে দুদিকে হাত ছড়িয়ে আরাম করে আড়মোড়াও ভাঙ্গলেন। তখনই নজরে পড়ল একদম তাঁর মতই দেখতে কে যেন একটা বিছানায় শুয়ে আছে। হতভম্ব হয়ে ভাবছেন কি হল ব্যাপারটা এমন সময় ঘরের সবাই হঠাৎ একসঙ্গে তারস্বরে মড়াকান্না জুড়ে দিল। কিছু বুঝতে পারছিলেন না তিনি। কিন্তু একটা সন্দেহ তাঁর মনে খচখচ করছিল। ঠিক তখনই লোকটা কাছে এসে তাঁকে কথাগুলো বলল।
তাঁকে চুপ করে থাকতে দেখে লোকটা আবার বলল, “কি হল? সেই কতক্ষণ ধরে বসে আছি। খাবি খেতে খেতেই পাক্কা দশ মিনিট কাবার করে দিলেন। এবার চলুন! অনেকটা রাস্তা যেতে হবে।”
তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় যাব?”
লোকটা আরও অবাক হল, “অ্যাইদ্দ্যাখো! বাবু বুঝতেই পারছে না কোথায় যাবে? আরে মশাই, এখানে তো আপনার ছুটি হয়ে গেল, এবার চলুন হেডআপিসে। সেখানে মেলা কাজ পড়ে আছে। এখানে বসে বসে ফালতু টাইমপাস করলে চলবে?”
এবার তিনি বুঝলেন তার মানে যে সন্দেহটা এতক্ষণ তাঁর মনে দানা পাকাচ্ছিল সেটাই ঠিক। তিনি মারা গেছেন।
প্রথমটায় একটা শক্ পেলেন। এই পৃথিবীতে তাঁর সময় ফুরিয়েছে বলে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু হঠাৎ করে তিনি উপলব্ধি করলেন যে এই ঘরে উপস্থিত সবার মনের কথা তিনি বুঝতে পারছেন। যেমন তাঁর ছেলে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলছিল, – “বাবা! আমাদের একলা ফেলে চলে গেলে! তোমাকে ছেড়ে এখন আমরা কি করে থাকব?” কিন্তু সেই আবার মনে মনে ভাবছিল, – “ভালই হল! এখন আর কোনও বাধা রইল না। এবার এই পুরনো বাড়ীটা প্রোমোটারকে বিক্রি করে মুফতে দুখানা ফ্ল্যাট বাগানো যাবে। সাথে মোটা টাকাও পকেটে আসবে।” ছেলের বউ হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, – “বাবা, আপনি আমাদের একটু সেবা করার পর্যন্ত সুযোগ দিলেন না। এত তাড়াতাড়ি চলে গেলেন।” অথচ ভিতরে ভিতরে ভাবছিল, – “বাপরে বাপ। এত দিন বুড়োর সেবা করতে করতে হাড় মাস কালি হয়ে গেছিল। এবার একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচা যাবে।” তাঁর ছোটবেলার বন্ধু গোপাল নাক দিয়ে ফোঁৎ ফোঁৎ করে শব্দ করতে করতে পাশের লোকটাকে বলছিল, – “জানেন, বড় ভালোমানুষ ছিল আমার বন্ধুটা! আমি পাপী তাপী মানুষ। তাছাড়া ওর থেকে বছর দুয়েকের বড়ই হব। আমাকে না নিয়ে ভগবান কেন যে ওকে আগে নিয়ে নিল?” কিন্তু আশ্চর্য! হরিচরণবাবু স্পষ্ট বুঝতে পারলেন মনে মনে সে ভাবছে, – “হতভাগা হরি। দিব্যি দেখি টেঁসে গেলি। বেশ এতদিন তোর ঘাড় ভেঙ্গে চা বিড়ি সিগারেট খাওয়া যেত। এখন থেকে ট্যাঁকের কড়ি খসাতে হবে।”
এই সব দেখে শুনে মনটা তাঁর বিতৃষ্ণায় ভরে গেল। ভাবলেন, থাক! মরে গিয়ে ভালই হয়েছে। এবার নিশ্চয়ই স্বর্গে গিয়ে তাঁর স্ত্রী কুমুদিনীর সাথে আবার তাঁর দেখা হবে। এই ভেবে তাঁর মনটা আবার খুশী হয়ে গেল। হরিচরণবাবু ধরে নিলেন এই লোকটা যমদূত টুত জাতীয় কিছু একটা হবে। তাঁকে স্বর্গে নিয়ে যেতে এসেছে। যদিও যমদূতসুলভ কিছু পোশাকআশাক এর গায়ে দেখতে পেলেন না। আকাশী রঙের উর্দি জাতীয় কিছু একটা পরা। লোকটা আবার তাড়া দিল, – “এই যে স্যার! আর দেরি করলে কিন্তু আমাকে আবার ঝাড় খেতে হবে। চলুন চলুন, আর দেরী করাটা ঠিক হবে না।” তাড়াহুড়োর চোটে হরিচরণবাবু আর কিছু ভাবার সময় পেলেন না। বেরিয়ে পড়লেন লোকটার সাথে।
লোকটা বাইরে এসে একটা ঢাউস মত একটা কিছুতে বসে তাঁকে বলল, – “বসে পড়ুন। অনেক দূর যেতে হবে।” তিনি কথা না বাড়িয়ে লোকটার পাশে বসতেই লোকটা সেটা চালু করল আর দেখতে দেখতে জিনিষটা সোঁ সোঁ করে ওপরে উঠতে লাগল। হরিচরণবাবু জীবনে কোনওদিন এরোপ্লেনে চাপেননি। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন ঘরবাড়ি গাছপালা নদনদী সব নীচে রেখে লোকটা তাঁকে নিয়ে এই পৃথিবী ছাড়িয়ে আকাশের দিকে রওয়ানা দিল।
বেশ কিছুক্ষণ চলার পর লোকটা শূন্যে এক জায়গায় এসে গাড়ীটা থামিয়ে বলল, – “নেমে পড়ুন, আমরা এসে গেছি।” হরিচরণবাবু অবাক হয়ে দেখলেন আকাশের মধ্যে মস্ত একটা বাড়ীর সামনে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। লোকটার কথামত দরজা দিয়ে ঢুকে দেখলেন বিশাল বড় একটা হলঘর। সেখানে গিজগিজ করছে নানা ধরনের লোক। পুরুষ, মহিলা, ছোট, বড়, বেঁটে, মোটা, দেশী, বিদেশী একসাথে এত বিভিন্ন ধরনের লোক একজায়গায় তিনি আগে কখনও দেখেননি। তাঁর বিস্ময় কাটতে না কাটতেই আরেকজন আকাশী উর্দি পড়া লোক এসে তাঁকে একটা লাইনে দাঁড় করিয়ে দিল। তিনি একটু ইতস্তত করে সামনের লোকটাকে জিজ্ঞেস করলেন যে এটা কোন জায়গা। কিন্তু সামনের লোকটা তাঁর প্রশ্নের উত্তরে অজানা কোনও ভাষায় কি যে বলল তিনি তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলেন না। একটু পরে আরেকজন উর্দিধারীকে দেখতে পেয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, – “আচ্ছা দাদা, এটা কি স্বর্গ?” উর্দিধারী একটু হেসে জবাব দিল, – “হ্যাঁ, সেরকমই বলতে পারেন।” শুনে তিনি একটু নিশ্চিন্ত বোধ করলেন। তাহলে ঠিক জায়গাতেই এসে পড়েছেন।
কিছুক্ষণ লাইনে দাঁড়ানোর পর তাঁর ডাক পড়ল একটা ঘরে। সেখানে একটি উর্দিধারী তরুণী তাঁর নাম ধাম জন্মস্থান ইত্যাদি জানতে চাইল। তাঁর সম্বন্ধে সমস্ত তথ্য জেনে একটা ল্যাপটপে কিসব খুটখুট করে তাঁর গলায় একটা ফিতেয় বাঁধা কার্ড ঝুলিয়ে দিয়ে বলল, – “ধরুন। এটা আপনার বায়োমেট্রিক কার্ড। এতে আপনার যাবতীয় ডেটা ফিড করা আছে। এটা সবসময় নিজের সাথে রাখবেন। দেখবেন, হারায় না যাতে।” তিনি দেখলেন কার্ডটাতে তাঁর নাম, ঠিকানা, জন্মদিন, মৃত্যুদিন এই সমস্ত তথ্য ছাপান আছে। এছাড়াও সোল আইডি, ম্যানুফ্যাকচার পার্ট নাম্বার ইত্যাদি আরও কিসব জানি রয়েছে। তিনি কিছু না বুঝলেও কার্ডটা নিয়ে বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে ঘাড় নাড়লেন। তরুণীটি তখন বলল, – “এবার সোজা এই দরজা দিয়ে বাইরে চলে যান। নেক্সট রুমে আপনার অ্যাপ্রাইসাল হবে।”
হরিচরণবাবু বাইরে এসে দেখলেন সেখানেও এক মস্ত লাইন। লোকেদের চেঁচামেচিতে কান পাতা দায়। হাজার হাজার লোক তাদের বিভিন্ন মাতৃভাষায় কথা বলছে। একজন লালমুখো সাহেব ইংরেজিতে গাঁক গাঁক করে কি সব বলতে বলতে চলে গেল। পৃথিবীর সব ভাষা একসঙ্গে মিশে একটা জগাখিচুড়ি হট্টগোল সৃষ্টি করেছে। সবাই এখানে ভীষণ ব্যস্ত। দম ফেলার ফুরসৎ নেই কারোর। সব মিলিয়ে তাঁর বেশ ভয় ভয় করছিল। অ্যাপ্রাইসালটা আবার কি বস্তু রে বাবা? খায় না মাথায় দেয়। তিনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না কি করবেন।
এমন সময় একজন উর্দিধারীকে দেখে খুব চেনা চেনা লাগল। একটু ভাবতেই চিনতে পারলেন অমলেন্দুবাবুকে। সেই বেঁচে থাকাকালীন সকালবেলা পাড়ার মাঠে প্রাতঃভ্রমণে যেতেন, তখন কোলকাতার এক নামী স্কুলের হেডমাস্টার অমলেন্দুবাবুর সাথে পরিচয় হয়েছিল। কিন্তু অমলেন্দুবাবু তো মারা গেছেন বছর দুই হয়ে গেল। সেই অমলেন্দুবাবুকে এখানে দেখে তিনি খুব আশ্চর্য হয়ে গেলেন। কাছে আসতেই তিনি ভয়ে ভয়ে ডেকে বসলেন অমলেন্দুবাবুকে। অমলেন্দুবাবুও তাঁকে অল্প চেষ্টাতেই চিনতে পারলেন। হরিচরণবাবু এতক্ষণে একজন চেনা মানুষকে দেখতে পেয়ে খুব খুশী হলেন। অমলেন্দুবাবুকে জানালেন যে তিনি এখন কোথায় আছেন, কি করছেন কিছুই তিনি বুঝতে পারছেন না। সব শুনে অমলেন্দুবাবু বললেন, – “দাঁড়ান, আপনাকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছি। আপনার তো রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেছে দেখছি। এখনও অ্যাপ্রাইসালের ডাক আসতে ঢের দেরী। আসুন আমার সাথে।” বলে হরিচরণবাবুকে নিয়ে পাশে একটা খালি ঘরে এসে বসলেন। তারপরে স্কুলে পড়ানোর ঢঙে বললেন, – “দেখুন, গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কি বলেছিলেন? আত্মা অবিনশ্বর। তাই না? মানুষ মরে গেলেও আত্মার মৃত্যু হয় না। আমাদের এই সেন্টারে সেই আত্মাগুলোকে রিসাইকেল করা হয়। কিছু বুঝলেন?”
হরিচরণবাবু কিছু না বুঝেই মাথা নাড়লেন, – “হ্যাঁ! বুঝেছি।”
কিন্তু এতদিনের পড়ানোর অভিজ্ঞতা থেকে অমলেন্দুবাবু সেটা ধরে ফেললেন, – “কিস্যু বোঝেননি। আসলে কি জানেন তো, একটা আত্মা ম্যানুফ্যাকচার করতে অনেক খরচা পড়ে। এখন যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে, তাতে এত আত্মার সাপ্লাই দেওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে। সেই জন্যে ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আত্মাগুলোকে রিসাইকেল করতে হয় মানে আবার নতুন করে ব্যবহার করতে হয়। এক একটা আত্মাকে তাই আজকাল অনেকগুলো অ্যাসাইনমেন্ট কমপ্লিট করতে হয়।”
– “অ্যাসাইনমেন্ট মানে?”
– “হুমম! অ্যাসাইনমেন্ট মানে ধরে নিন একটা জন্ম। একবার যখন একটা আত্মা একটা দেহে ঢুকে জন্ম নেয়, সেটাকে একটা অ্যাসাইনমেন্ট বলা হয়। মৃত্যু হলে সেই অ্যাসাইনমেন্ট শেষ হয়েছে বলে ধরা হয়।”
– “ও বাবা! তাই নাকি?”
– “হ্যাঁ! এবার দেখা গেছে যে একটা আত্মা গড়ে দশটা থেকে বারোটা অ্যাসাইনমেন্ট পুরো করতে পারে। তারপরে সেই আত্মাটার এফিসিয়েন্সি বা কর্মক্ষমতা কমে যায়। তখন সেই আত্মাটাকে রিটায়ারমেন্টে পাঠানো হয়। এবার বুঝলেন?”
– “আচ্ছা, তার মানে এই জায়গাটাই কি স্বর্গ?”
– “আরে না না। স্বর্গ, হেভেন, জন্নত এইসব তো মানুষের সৃষ্টি। আত্মার কোনও ধর্ম হয় নাকি? হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান এইসব হ’ল নশ্বর দেহের ধর্ম। মৃত্যুর পর দেহের সাথে সাথে মানুষের ধর্মেরও বিনাশ হয়। এই জায়গাটা হ’ল সোল রিসাইক্লিং সেন্টার। মৃত্যুর পরে সব আত্মা এখানে আসে। তাদের আগের অ্যাসাইনমেন্টের ভ্যালুয়েশন হয়। তারপরে নতুন অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়। বোঝা গেল?”
হরিচরণবাবুর মাথায় এত কিছু ঢুকছিল না। তাও তিনি বললেন, – “আচ্ছা আচ্ছা, এইবার বুঝেছি”। অমলেন্দুবাবু তখন খুশী হয়ে বললেন, – “বাঃ, ভেরী গুড! চলুন এবার! আপনার অ্যাপ্রাইসালের সময় হল বলে।”
– “আচ্ছা, অ্যাপ্রাইসালের ব্যাপারটা কি?”
– “অ্যাপ্রাইসাল হল আগের অ্যাসাইনমেন্টে আপনার পারফর্মেন্সের বিচার করা এবং সেই অনুযায়ী আপনার পরবর্তী অ্যাসাইনমেন্ট ঠিক করা। পারফর্মেন্স ভাল হলে পরের অ্যাসাইনমেন্টে আপনার পোস্টিং ভাল জায়গায় হবে মানে ভাল পরিবারে ভাল পরিবেশে আপনার জন্ম হবে। আর খারাপ হলে…”
– “নরক?”
– “এই তো! আবার সেই স্বর্গ নরকের চক্করে আটকে পড়লেন? আরে বাবা না, পারফর্মেন্স খারাপ হলে প্রথমে আপনাকে একটা শর্ট টার্ম ট্রেনিং দেওয়া হবে যাতে পরের অ্যাসাইনমেন্টে আপনি আরও ভাল কাজ করতে পারেন। তাছাড়া পরবর্তী অ্যাসাইনমেন্টে আপনি একটু কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হবেন। ধরে নিন, একটু নিম্নবিত্ত পরিবারে আপনার জন্ম হল। ছোটবেলাটা একটু স্ট্রাগল্ করতে হল। এই সব আর কি।”
হরিচরণবাবুর মাথা ভোঁ ভোঁ করছিল। মধ্যবিত্ত মানুষ তিনি। সারা জীবন ছোটখাট একটা অফিসে ক্লার্কের কাজ করে এসেছেন। স্বাচ্ছন্দ্য তাঁর জীবনে খুব একটা আসেনি। এসব কর্পোরেট ব্যাপার স্যাপার তাঁর বোধগম্য হচ্ছিল না। তিনি শুধু বুঝলেন তাঁর বিগত জন্মের সব পাপ পুণ্যের হিসেব নিকেশ হবে এবার। সে অবশ্য তিনি সবসময় সৎপথে থেকে এসেছেন। দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও কখনও নিজের আদর্শ থেকে বিচ্যূত হননি। বেঁচে থাকাকালীন মনে মনে তাঁর আশা ছিল মৃত্যুর পরে তাঁর ভাঁড়ারে পাপের থেকে পুণ্যের পরিমাণটাই বেশী পাওয়া যাবে। তাও এখন তাঁর বুকটা একটু দুরু দুরু করতে লাগল। পরীক্ষায় বসার আগে ক্লাসের ফার্স্ট বয়েরও কি আর টেনশন হয় না?
যাই হোক, দুজন স্যুট টাই পরা ল্যাপটপ নিয়ে বসা ফিটফাট ভদ্রলোকের সামনে তাঁর আগের জন্মের কাঁটাছেঁড়া হল। তিনি উৎকণ্ঠায় অতশত বুঝলেন না, তবে আলোচনার শেষে দুজনের মুখে হাসি দেখে আর দুএকবার গুড, ভেরী গুড ইত্যাদি শুনে বুঝলেন এ যাত্রায় তিনি উৎরে গেছেন। একটু নিশ্চিন্ত হয়ে বাইরে এসে দেখলেন অমলেন্দুবাবু তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছেন। সব শুনে অমলেন্দুবাবু বললেন, – “ভালই হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। দেখুন ভাগ্য ভাল থাকলে পরের বার অনসাইট অ্যাসাইনমেন্টও পেয়ে যেতে পারেন।”
– “তার মানে?”
– “মানে বিদেশে টিদেশে জন্ম নিতে পারেন।”
– “অ্যাঁ! বিদেশ!”, চোখ কপালে উঠে গেল হরিচরণবাবুর। – “কিন্তু আমার যে ইংরেজিটা একদম ভালো আসে না।”
– “আরে মশাই! তাতে কি এসে যায়? শিখে নেবেন।”
হরিচরণবাবু যে খুব একটা ভরসা পেলেন তা নয়। এই বয়সে আবার ইংরেজি শিখতে হবে ভেবে বুকটা দুরু দুরু করতে লাগল তাঁর। একটা কথা অনেকক্ষণ ধরে বলবেন বলে ভাবছিলেন। সাহস করে এবার বলেই ফেললেন, – “ইয়ে, বলছিলাম কি, আমার স্ত্রী, মানে কুমুদিনী, তাঁকে যদি…, মানে তিনি এখন কোথায় আছেন। তার সাথে কি একবার দেখা করা যায়?”
অমলেন্দুবাবু ভুরু কুঁচকোলেন, – “হুমম! কি নাম বললেন? কুমুদিনী! কতদিন আগে মারা গেছেন বলতে পারবেন?”
মনে মনে হিসেব করলেন হরিচরণবাবু, – “এই বছর পাঁচেক হল।”
– “বছর পাঁচেক? বাব্বা, সে তো অনেক দিন। ওঁকে তো এখন আর এখানে পাওয়াটা মুশকিল হবে। দাঁড়ান, একবার সিস্টেমে লগ ইন করে দেখি ট্রেস করা যায় নাকি।”
এই বলে তিনি হরিচরণবাবুকে নিয়ে একটা কম্প্যুটারে বসে কিছুক্ষণ বোতাম টেপাটেপি করলেন। তারপরে হাসি মুখে বললেন, – “এই তো! পেয়ে গেছি। কিন্তু যা ভেবেছি তাই। উনি তো এখন আর এখানে নেই। উনি আছেন নাইরোবিতে, পরের অ্যাসাইনমেন্টে। এখন কি আর বসে থাকার সময় আছে দাদা। যে হারে মানুষ জন্মাচ্ছে পৃথিবীতে। আত্মারা আসছে আর সটাসট্ পরের অ্যাসাইনমেন্টে বেরিয়ে যাচ্ছে। আগে এসব কাজ করতে অনেক সময় লাগত। এখন সব কম্প্যুটার এসে যাওয়ায় কাজের স্পীড অনেক বেড়ে গেছে।”
সারা জীবন অন্ধকারকে ভয় পেয়ে আসা তাঁর স্ত্রী, কুমুদিনী দেবী দিনের পর দিন সূর্যকে ছেড়ে নাই–রবিতে কি করে দিন কাটাচ্ছেন ভেবে পেলেন না হরিচরণবাবু। তাও মনের দুঃখটা চেপে বললেন, – “কিছু মনে করবেন না! মানে আপনিও তো বছর দুই হল…”
একটা আত্মপ্রসাদের হাসি হাসলেন অমলেন্দুবাবু, – “তাও আমি এখনও এখানে কি করে আছি জানতে চাইছেন, তাই তো? গুড কোয়েশ্চেন। আসলে কি জানেন, একটা আত্মার সবকটা অ্যাসাইনমেন্ট কমপ্লিট হয়ে গেলে তার কাছে দুটো অপশন দেওয়া হয়। হয় সে রিটায়ার করতে পারে। অথবা এই সেন্টারেই ইন হাউস কাজ করতে পারে। আমার বারোটা অ্যাসাইনমেন্ট হয়ে যাবার পরে সময় কাটানোর জন্যে আমি ইন হাউস জবটাই বেছে নিয়েছি। অমলেন্দু দত্তের অ্যাসাইনমেন্টাই ছিল আমার শেষ অ্যাসাইনমেন্ট। তাই এখনও আপনি আমাকে অমলেন্দু দত্তের চেহারাতেই দেখতে পাচ্ছেন।”
হরিচরণবাবুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভেবেছিলেন মৃত্যুর পরে স্বর্গে এসে কুমুদিনীর সাথে বাকি দিনগুলো কাটাবেন। কিন্তু সব গণ্ডগোল হয়ে গেল। ভাবলেন ঠিক আছে, মোটে তো বারোটা জন্ম। কয়েকটা তো নিশ্চয়ই হয়েই গেছে। বাকিগুলোও দেখতে দেখতে কেটে যাবে। তারপরেই নাহয় আবার দেখা হবে স্ত্রীর সাথে।
এমন সময় অমলেন্দুবাবু বললেন, – “নিন, এবার চলুন। এতক্ষণে আপনার মেমোরি ফরম্যাট করার সময় হয়ে গেছে নিশ্চয়ই।”
আবার নতুন হ্যাপা? হরিচরণবাবু আঁতকে উঠলেন, – “সে আবার কি?”
অমলেন্দুবাবু হাসলেন, – “আরে মশাই! আপনার এই জন্মের সব স্মৃতি মুছে দিতে হবে না। নাহলে তো পরের জন্মে নতুন স্মৃতি, পুরনো স্মৃতি সব মিলেমিশে একাকার কাণ্ড হয়ে যাবে। তাই একটা অ্যাসাইনমেন্ট শেষ হয়ে গেলে সব আত্মার আগের সমস্ত স্মৃতি মুছে ফেলা হয়। আগে ম্যানুয়ালি এই কাজ করতে হত। ধরে ধরে মাথা থেকে একটার পর একটা রেকর্ড মুছতে হত। মাঝে মাঝে একটু ভুলচুক হয়ে যেত, তখনই দু এক পিস জাতিস্মর টাতিস্মর বেরিয়ে আসত। এখন অবশ্য সব ডিজিটাল হয়ে গেছে। তাই আজকাল আর মুকুল টুকুল বা করণ অর্জুন এদের দেখা পাওয়া যায় না। বুঝলেন?”
হরিচরণবাবু যতই দেখছিলেন আর শুনছিলেন, অবাক হচ্ছিলেন। বলে ফেললেন, – “ব্যথা লাগবে না তো?”
অমলেন্দুবাবু হেসে বললেন, – “সে তো জানি না ভাই। কারণ এই প্রশ্নটা অনেকটা ‘মরে গেলে লাগবে না তো’ এই গোছের। এই অভিজ্ঞতাটা হবার পরে এটা নিয়ে আলোচনা করার মত অবস্থায় কেউ আর থাকে না।”
কথা বলতে বলতে অমলেন্দুবাবু হরিচরণবাবুকে নিয়ে একটা ঘরের সামনে এলেন। সেই ঘরের সামনেও মস্ত বড় লাইন। লাইনে হরিচরণবাবুকে দাঁড়াতে বলে অমলেন্দুবাবু ঘরের ভিতরে ঢুকে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে একগাল হাসতে হাসতে বেরিয়ে এসে বললেন, – “বলেছিলাম না। আপনার অনসাইট অ্যাসাইনমেন্ট হয়ে যাবে। হল তো হল একেবারে অ্যামেরিকা। বেস্ট অফ লাক!”
এই বলে হরিচরণবাবুর সাথে হাত মিলিয়ে তাঁকে একরাশ চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়ে অমলেন্দুবাবু বিদায় নিলেন।
সারা জীবনে হরিচরণবাবু কোলকাতার বাইরে কোনওদিন পা রাখেননি। বিদেশ বিভূঁইয়ে কাউকে চেনেন না জানেন না, কি যে করবেন একথা ভাবতে ভাবতেই তাঁর ডাক পড়ল। ঘরে ঢুকে দেখলেন একজন উর্দি পরা মাঝবয়সী মহিলা একটা চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে আছেন। মহিলার সামনে একটা কম্প্যুটার রাখা। পাশে আরেকটা কাঁচের চৌকো মত ছোট ঘর। সেখানে একটা চেয়ার। সামনে একটা বাটির মত দেখতে ধাতব টুপী জাতীয় কিছু। টুপীটা থেকে একগাদা তার বেরিয়ে আছে। মহিলা তাঁর কার্ডটা নিয়ে কম্প্যুটারে কিছু একটা দেখে বলল, – “তাড়াতাড়ি করুন, আপনাকে ডেলিভারী করার সময় হয়ে গেছে।” বলে তাঁকে ছোট ঘরটাতে ঢুকিয়ে চেয়ারটাতে বসিয়ে তাঁর মাথায় টুপীটা পরিয়ে দিল। তারপর কম্প্যুটারটাতে গিয়ে কিছু একটা বোতাম টিপে দিল। একটা তীব্র সাদা আলোর ঝলকানি। তারপরে ঝুপ করে তাঁর চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেল।
***
কেওড়াতলা মহাশ্মশানে হরিচরণবাবুর দেহটা ইলেকট্রিক চুল্লীতে ঢুকে যাবার পরে চুল্লীর দরজাটা যখন বন্ধ হয়ে গেল, ঠিক সেই সময় ওয়াশিংটন ডিসিতে হোলি ক্রস হসপিটালের মেটারনিটি বিভাগের একশ দুই নাম্বার কেবিনে মার্কিন মিলিয়নিয়ার মিঃ জোনাথন গ্যারফিল্ড এবং তাঁর স্ত্রী এলিজাবেথ ঠিক করলেন যে তাঁদের সদ্যোজাত কন্যাসন্তানটির নাম রাখবেন হ্যারিয়েট।

দুঃখিত!