আজ রিমলি খুব খুশি, স্ফুর্তিতে ডগমগ করছে সে।
আজ বহুদিন পর মা তাকে ঝিনুকদের বাড়ি যাবার অনুমতি দিয়েছে। কেন যে মা যেতে দেয়না কে জানে? আগে তো এমন ছিলোনা, প্রায়ই সে ইচ্ছেমতো চলে যেত ঝিনুকদের বাড়ি, কতবার তো সে রাতের খাবারটা ওখানেই খেয়ে এসেছে ….কি যে হয় মাঝেমাঝে মায়ের? যাকগে আজ তো সে অনুমতি পেয়েইছে, তবে ওই মায়ের এক কথা, সূর্য ডোবার আগেই ফিরে আসতে হবে ….ধুস কিচ্ছু বোঝেনা মা!!!
আজ সে দুটো দুষ্টুমি করেছে, তার জন্য অবশ্য সে ঠাকুরের কাছে মাফও চেয়েছে। লতিকাপিসি বলেছিলো, যদি খুব দুষ্টুমি করো তো কান ধরে ঠাকুরের কাছে ক্ষমা চাইতে হয়, বলতে হয় আর কক্ষনো হবেনা…তাহলে আর দোষ হয়না। রিমলি কি বা করতো? ক্লাসে ভূগোল দিদিমনি বেছেবেছে শৈলোত্ক্ষেপ বৃষ্টিটাই ওদের বেঞ্চ কে জিজ্ঞেস করলেন, ওরতো পুরোটাই মনে ছিল শুধু শুরুটা কিছুতেই মনে পরছিলোনা, আর ও না পারলে পুরো চার বন্ধুকেইতো মাঠে কানধরে দাঁড়াতে হত….আসলে সবাইকে বাঁচাতেই অন্যায়টা সে করেছে। মঞ্জু বেঞ্চের নীচে বইটা একটুখানি খুলেছিল,ও আড়চোখে শুধু শুরুর লাইনটা দেখে নিয়েছে ….আর দিদিমনি খুব খুশিহয়ে তাকে ও অন্য সব মেয়েদের বসতে দিয়েছেন। এটা খুব বড় অন্যায় নয়, সবাই দাঁড়িয়েছিল, ও তাদের বসতে দিলো …..তবু মনটা টিফিন বেলা থেকেই খচখচ করছিল…লতিকাপিসির কথা মনে পড়ছিল …তারপর আবার ঝিনুক এলো টিফিনে, আজও সে টিফিন আনেনি…কিছুতেই তার টিফিন থেকে খেলোনা, বললো ভালোলাগছেনা . ও জিজ্ঞেস করছিল কেন রিমলি আর আসেনা? সন্ধ্যেতে তো ওরা আগে একসাথে কতদিন পড়েছে, রিমলি বলেছে সে জানেনা, তবে যদি জেম্মা মাকে গিয়ে বলে তবে মা হয়তো তাকে ছাড়তেও পারে…
ঝিনুকতো এক কথায় রাজি।
আজ বাড়ি ফিরে সে গান নিয়ে বসেছিল …কি যে একটা বাজে গান দিয়েছে বৈশালীদি…
অরূপ তোমার বাণী ….
কিযে ভালোলাগে মায়ের এসব গান !!
…কি করবে, এখন তো কিছুক্ষণ সাধতেই হবে …
যদিও কানটা খাড়া হয়ে আছে জেম্মার গলা শোনার জন্য, কিন্তু সে উপায় আছ? একটু থামলেই মায়ের তাড়া “কিরে কি হলো? থামছিস কেন বারবার?”
“মিনু এসেছিল, তোমায় ওদের বাড়ি যেতে বলেছে,” সদ্য গোছানো কাপড় তুলে রাখতে রাখতে মা কথা বলছে, ওর দিকে না তাকিয়েই, “এখন যাও, তবে সন্ধ্যের আগে চলে আসবে, আমায় যেন যেতে না হয়”।
সেই থেকে খুশি আর ধরেনা
…..মনের আনন্দে সে চলেছে ঝিনুক দের বাড়ি….
বেরোনোর মুখে বারান্দায় পিসির সাথে দেখা…’এই ধিঙ্গি মেয়ে কোথায় যাচ্ছিস?’
…ঝিনুকদের বাড়ি…’তা যাও, তবে দয়া করে রাস্তা দিয়ে হেঁটো, কদিন আগে কর জ্যাঠাইমা বলে গেছেন, যে তুমি ওনার ছেলের বাড়ির পাঁচিল টাকে চলা ফেরার রাস্তা করেছো, তোমার ভাগ্য ভালো বউদি ঘরে ছিলোনা তখন, এরপর এলে কিন্তু আমি ঠেকাবনা’।
….পিসি রেগে গেলে তুমি বলে, কিন্তু রাগ করছে কেন? একটু পাঁচিল দিয়ে হাঁটলে কি হয়?.
…’ঠিক আছে যাই?’
…’হুমমম, এই পাকাচুল তুলে দিসনি কতদিন মনে আছে?’
….’কেন দেব? তুমি আগের পয়সাতো দাওনি, আর তোমার তো পাকাচুলই নেই’
…’ওরে মেয়ে …ঠিক আছে কাল তুলে দিস দুদিনের একসাথে দেব’
মাকে বলবে না তো পয়সার কথা?”
…উফফ!!!আজকের দিনটা খুব ভালো …পরশু আলুকাবলি খাওয়া যাবে।
সে একছুটে রাস্তায় ,সামনের চারকোনা মাঠটা ঘুরে, কোণে একটা কলকে ফুলের গাছ আছে, ওর পাশের সরু রাস্তা দিয়ে একটু গেলেই ঝিনুকদের বাড়ি।
তার মুখে একটা দুষ্টু হাসি খেলছে, আজ একবার পাঁচিলে উঠতেই হবে, পাঁচিলে না উঠলে কলকেফুল পাবে কি করে?
ওই গাছটার নিছে খুব জঙ্গল, নিচের ফুলগুলো পাওয়া যায় না…চারটে কলকে ফুল নেবে, ওর মধ্যে নাকছাবি আছে, দুজনে দুটো করে পরবে, খুব সাবধানে পাপড়ি গুলো ছিঁড়লে ওই ফুলের মধ্যে একটা জিনিস থাকে, সেটা ঠিক নাক ছবির মতো দেখতে, ওরা দুটো করে পরবে , মা রা যে কেন এক নাকে পরে? দুল দু-কানে পরে আর নাকছাবির বেলায় একটা কেন? …প্রশ্নটা করতেই মা খুব হেসেছিল…যাকগে, ওরা আজ দুটোই পরবে।
শুরু হলো পাঁচিল বাওয়া ,এটাই বেশি ভালো রাস্তা, ফুল গুলো তুলেই এক লাফে রাস্তায় নেমে দৌড় দিতে হবে। রিমলি জানে না আজ জেঠু বাড়ি আছে কিনা, আগে তো থাকতোনা, ওরা পড়াশুনা করতো ঝিনুক দের বারান্দায়, আর রাতে জ্যেঠু বাড়ি আসতো, সব সময় হয় লেবুলজেন্স আনত, না হলে মৌরি লজেন্স….খুব মজা হত ওদের, জেঠু খুব ভাল গান করতে পারে….জেঠুর গলায় নজরুলগীতি শুনতে কি ভালই না লাগে, এখন অনেক দিন গান শোনেনি সে। আগের বার যখন গিয়ে ছিল, জেঠু কোণের ঘরে ঘুমোচ্ছিল, জেম্মা যেতে বারণ করেছিল, শরীর খারাপ ছিল হয়তো।
ঝিনুকদের বাড়ির আর একটা জিনিস খুব প্রিয় রিমলির, আলু -পোস্ত, তার মা তো ওটা করতেই পারে না, সাদা রং হয়, ঠিক সাদা নয় একটু হালকা গোলাপী, আর ঝোল ঝোল, পুরো ভাত-টাই ওটা দিয়ে খাওয়া যায়, জেম্মা রোজই ওটা করে, ওদের ভাত টাও অন্য রকম, একটু লালচে, আর মোটা, কিনতু খুব ভালো লাগে ওর খেতে।
ধুস! আজ সন্ধ্যের আগে ও কিছুতেই ফিরবে না, গিয়েই জেম্মা কে বলবে আজ সে ওদের বাড়ি পোস্ত ভাত খাবে। জেম্মা নিজে বললে মা আর নিয়ে যেতে পারবে না, বাড়িতে পিসি ঠিক সামলে নেবে। নিজের বুদ্ধিতে নিজেই খুশি হয়ে ওঠে সে।
এক ছুটে মেঠো রাস্তা টা পেরিয়ে সে সোজা ঝিনুক দের বট তলায়, এই বটগাছের কোলেই বাড়ি, খুব সাবধানে আজ রোয়াক এ উঠবে সে, সিঁড়ি গুলো ভেঙ্গে গিয়েছে, আগের বার পা মচকে গিয়েছিল, আজ সে সাবধানে রোয়াক এ উঠে হালকা করে ভেজানো দরজা টা ঠেলতেই হাসি মুখে ঝিনুক হাজির
…’কিরে এত দেরি কেন?’…’কলকে ফুল পাড়ছিলাম ’….’চল ভিতরে চল, মা … রিমলি এসেছে ‘।
জেম্মার গলা আসে রান্নাঘর থেকে ‘বাবা! এতদিনে মেয়ের জেম্মার কথা মনে পড়ল ?’
এই কথার কি উত্তর সে দেবে? …. সত্যি বলাই ভালো, ভাবে সে…
‘মা আসতে দেয় না যে, শুধু গান করতে বলে, বল বিকেলে গান করতে ভালো লাগে? তাও অধুনিক গান শিখতে দেবেনা, মা না খুব খারাপ, বাবা এলে বলে দেব “…’ছি ছি মা! অমন করে বলে না, তোমার আসার ইচ্ছে হলে ঝিনুক কে বোলো আমি গিয়ে তোমায় নিয়ে আসবো, মায়ের কথা শুনতে হয় যাও খেলা করো তোমরা’।
আজ দিদিমনি দিদিমনি খেলা হলো ,তারপর TV র ঘোষিকা হলো ওরা দুজনে, দর্শকদের পছন্দের গান শোনালো, দুজনে মিলে…খুব মজা, কখন সন্ধ্যে পেরিয়েছে তার খেয়ালই নেই। এখনো আসল কথাটা জেম্মা কে বলা হয়নি, সবে ভাবছে রিমলি, এবার বলবে, এমন সময় জেম্মা ঘরে ঢুকলো আঁচলে হাত মুছতে মুছতে, হলুদের ছাপ ধরা গোলাপী শাড়ি, তাতে বেগুনি পাড়, খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল আজ, কাঠের জালে রান্না করছিল বলে হয়তো….”রিমলি আজ খেয়ে যেও আমি মাকে বলে পাঠিয়েছি, মা বকবে না’। রিমলির নিজের কান কে নিজের ই বিশ্বাস হয়না, হাসি মুখে শুধু ঘাড় নাড়ে সে।
খেতে বসে রিমলি জিজ্ঞেস করে ‘জেঠু খাবে না?’..’তোমার জেঠুর একটু জ্বর হয়েছে,সাবু খেয়ে শুয়ে পড়েছে, আজ তোমার পছন্দের কচুবাটা, পোস্ত সব হয়েছে, দোলা এসে কচু দিয়ে গেল তাই ভাবলাম তোমায় ডাকি, অনেক দিন আসোনি। পরম তৃপ্তিতে রিমলি খেতে শুরু করে। জেম্মার ঝালের হাত টা একটু বেশি, তা হোক, তবু খুব ভালো।
রাত এর বেলা হ্যারিকেন হাতে জেম্মা দাঁড়িয়ে থাকে কলকে গাছটার তলায, “আবার এসো”
…ঘাড় নেড়েই সে এক ছুট লাগায় ,কিন্তু বাড়ির যত কাছে সে আসে তত গলা শুকিয়ে আসে ভয়ে, সে মা ক বলে ছিল ও বাড়িতে খেতে দিলেও খাবে না, বলবে বাড়িতে রান্না হয়ে গেছে, কিন্তু সেসব তো সে ইচ্ছে করেই বলে নি, খুব ঠাকুর কে ডাকতে থাকে…ঠাকুর পিসি যেন দরজার কাছেই থাকে।
বাড়ির দরজায় ঢুকতেই পিসির দেখা, ‘কি সময় হলো? যাও এবার ঠেলা সামলাও, রাগে গজগজ করছে। কি রে তুই? কেন কোনো কথা শুনিস না?’
…’আমি তো ….মানে জেম্মাই তো ‘…’চুপ! মুখে মুখে কথা! যা আমার ঘরে গিয়ে বস’।
যাক, তার মানে পিসি সামলে নেবে, মনে মনে খুশি হয়ে ওঠে সে।
পিসি আর মা চাপা গলায় কথা বলছে।
কি বলছে?অন্য সময় তো মা খুব চেঁচামেচি করে, আগ্রহে পিসির দরজায় কান লাগায়, মা বারান্দায় এসেছে …..
‘ও বউদি আজ আর বোকোনা। মিনু বৌদি নিজে ওকে খেতে বলেছে’
…’তুই আর ওর হয়ে কথা বলিসনা নিতু, জানিসতো ওকে, আমি বলছি শোন, ও মেয়ে না বললেও খেয়ে আসতো। আগে হলে ঠিক ছিল এখন এসব ….তুই ই বল …একে নিয়ে যে আমি কি করি ? অর্ধেক দিন ওদের রান্না হয়না, দোলা বলছিল, আজ চার মাসের উপর দাদার কারখানা বন্ধ, ঝিনুক কে শান্তির কাছে পড়তে পাঠানো বন্ধ করেছে, মিনুর দিকে চাইতে পারিনা, ওই শাড়িতে ফুল তুলে ক -পয়সা পায় বলতো?
এ মেয়ে গিয়ে ঠিক মিনুর ভাগের টাই খেয়ে এলো, আমার বাড়ির খাবার নষ্ট ,আর ওবাড়িতে কেউ আধপেটা খাবে, অথচ দ্যাখ দিতে যেতেও তো পারিনা, এখন ‘
…বউদি সবই ঠিক ,কিন্তু রিমলি এসব কি বোঝে বলো? তুমিতো ওকে বলোনি, আর ওর ছোট্ট পেটের জন্য মিনু বউদির খাওয়া বন্ধ হবেনা মনে হয়, যাকগে যা হওয়ার হয়েছে, তুমি কিছু বানিয়ে মাঝে দিয়ে এসো, আমিতো কাল এমনিই দিতাম, ওবাড়ির বাটি পড়ে আছে আমার কাছে। আর একটা কথা তোমায় বলা হয়নি, অজয় বলেছে যতদিন দাদার কারখানা না খুলছে, ঝিনুক এর জন্য যে টাকাটা শান্তি কে দেয় ওটা ও দিয়ে দেবে, সেটা কালই বলতে যাব …আর মন খারাপ কোরনা, মেয়েটাকে এই রাতে আর বকাবকি কোরোনা’।
আজ দিনটা তো ভালই যাচ্ছিল ,সব ই তার ইচ্ছেমত হচ্ছিল ,হঠাত এত খারাপ হয়ে গেল কেন?
গলার কাছে কি যেন একটা আটকে গেছে মনে হয় রিমলির ,চোখ দিয়ে জল আসতে চায়, হঠাত তার এত কান্না পেয়ে যাচ্ছে কেন? রিমলি কিছুতেই বুঝতে পারেনা সে জেম্মার খাবার টা খেয়ে নিয়েছে? এটাতো খুব অন্যায়, ঠাম্মা বলে কারো খাবার নিয়ে নেওয়া খুব খারাপ কাজ । এখন সে বুঝতে পারছে, জেঠু কেন আর গান গায় না …’হে পার্থ সারথী ‘…খুব ভালো গাইতো জেঠু । জেঠু কি আর কোনো দিন গান গাইবে না?
সে ধীরে ধীরে ঠাকুর ঘরের দিকে এগিয়ে যায়….ঠাকুরের কাছে জোড়হাতে দাঁড়িয়ে বলে …ঠাকুর জেম্মার খাবার আমি খেয়ে নিয়েছি, আর হবেনা ,তুমি জ্যেঠুর কারখানাটা খুলে দাও, জ্যেঠু যেন আবার গান গায় আগের মতন …….