
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সমাজের ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু, সাদা-কালো সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখতেন। সকল মানুষের কল্যাণে তিনি নিরলসভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। শিশুদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার ছিল স্নেহপূর্ণ, কোমল এবং বন্ধুসূলভ। তিনি তাদের হাসি আনন্দে যোগ দিতেন। ছোটদের চপলতায় তিনি কখনও অসন্তষ্ট কিংবা বিরক্ত হতেন না। রাসূল (সাঃ) তাদের সাথে সবসময় হাসিমুখে কথা বলতেন। শিশুরা তাঁর কাছে এলে নিজেদের সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে যেতো। পবিত্র ঈদে মীলাদুন্নবী উপলক্ষে আমরা রাসূলের শিশুপ্রীতি সম্পর্কে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করেছি।
রাসূলের শিশুপ্রীতি সম্পর্কে আমরা বিশ্বনবীর সাহাবী আবু নায়ীম শৈশবের মধুমাখা স্মৃতির কিছু কথা শুনবো- যে স্মৃতিতে অম্লান হয়ে জড়িয়ে আছেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)!
মক্কা থেকে মদীনায় বিশ্বনবীর হিজরতের প্রাথমিক বছরগুলোয় প্রিয় নবীজির সান্নিধ্যের সেই মিষ্টি দিনগুলোর কথা প্রায়ই ভেসে ওঠে তাঁর মনে ৷ আবু নায়ীম মাঝে মধ্যে তাঁর ছেলের কাছে সে দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে আবার যেন ফিরে পেতে চান সোনালী সেই দিনগুলো৷ বিশেষ করে, যে দিন প্রিয় নবী আদর করে তাঁর পিঠ চাপড়িয়ে দিয়েছিলেন সেই সুন্দর দিনটি তিনি কখনোই ভুলেন না ৷ সে দিনটি মদীনার অলি গলি শিশুদের প্রাণচাঞ্চল্য ও কোলাহলে মুখরিত ছিল ৷ রাস্তার এক পাশ থেকে অন্য পাশে তারা ছুটোছুটি করছিলো ৷
কচি কাঁচা শিশুদের হাসির কলোরোল যেন গোটা মদীনা শহরেই ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল ৷ শিশু কিশোরদের কোলাহলের মধ্যেই শোনা গেলো উটের ঘন্টার শব্দ ৷ এ ঘন্টার শব্দে বোঝা যাচ্ছিলো, দূর থেকে শহরের দিকে এগিয়ে আসছে একটি কাফেলা ৷ হ্যাঁ, কোনো এক সফর থেকে মদীনায় ফিরছিলেন বিশ্বনবী (সাঃ) ও তাঁর সাহাবীদের একটি দল ৷ আবু নায়ীম বললেন, মহানবী (সাঃ) ও তাঁর কাফেলা শহরের দিকে আসছে এটা দেখতে পেয়ে আমরা আমাদের খেলাধুলা বন্ধ করলাম এবং আল্লাহর প্রিয় নবী (সাঃ)’র আগমনের জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম৷ বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, কোনো কিছুই আমাদেরকে খেলাধুলা থেকে বিরত রাখতে পারতো না ৷ কিন্তু সব সময় মুখে হাসি লেগে থাকা প্রিয় নবীজীকে দেখলেই আমরা খেলা ভুলে যেতাম ৷ রাসূলের কাফেলা যখন শহরে ঢুকে পড়লো তখন আমরা শিশুরা আনন্দে উচছ্বসিত অবস্থায় তাঁর দিকে ছুটে গেলাম ৷ ভ্রমণের কারণে শ্রান্ত ও ক্লান্ত হওয়া সত্ত্বেও তিনি আমাদের জন্যে থামলেন এবং আমাদেরকে তাঁর দিকে আসার জন্যে সাহাবীদেরকে পথ ছেড়ে দিতে বললেন ৷
আবু নায়ীম বললেন, আমার ছোট্র বন্ধুদের অনেকেই রাসূল (সাঃ)কে জড়িয়ে ধরলো এবং কেউ কেউ খুশীতে মত্ত হয়ে তাঁর চারদিকে পাখীর মতো ঘুরতে লাগলো ৷ রাসূলের সাহাবীরা আমাদের বাধা দিতে চাইলেন, কিন্তু রাসূল তাঁদেরকে তা করতে দিলেন না, বরং তিনি অত্যন্ত দয়াদ্রভাবে আমার বন্ধুদের সাথে আলিঙ্গন করলেন ৷ আমিও প্রিয় নবী(সাঃ)’র কাছে আসার জন্যে অপেক্ষার প্রহর গুণছিলাম, কিন্তু লাজুক হওয়ায় আমি এক কোণে সরে দাঁড়িয়েছিলাম এবং আনন্দের এ দৃশ্যগুলো দেখছিলাম ৷ এমন সময় রাসূল মিষ্টি হাসি হেসে আমার দিকে তাকালেন ৷ তিনি আমার দিকে এগিয়ে এলেন এবং এগিয়ে আসতে আসতে তিনি আমার দিকে তাঁর দু’হাত বাড়িয়ে দিলেন৷ আর আমিও অপ্রতিরোধ্য ইচ্ছা নিয়ে রাসূল (সাঃ)কে আলিঙ্গন করতে এগিয়ে গেলাম ৷ রাসূল (সাঃ) আমার সাথে আলিঙ্গন করলেন এবং আমার কপালে চুমু দিলেন এবং আমার পিঠ চাপড়িয়ে দিলেন ৷ এটা ছিল আমার জন্যে অবর্ণনীয় মুহূর্ত যা আমি কখনো ভুলবো না ৷ মহানবীর সান্নিধ্যের সেই স্মৃতি কতো মধুর! ইস! সেই দিনগুলো যদি আর একবার ফিরে আসতো! রাসূলের শিশুপ্রীতি সম্পর্কে আরেকটি ঘটনা শোনা যাক। একদিন প্রিনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) খেতে বসেছিলেন। কিন্তু খানা তখনও শুরু করেননি। উম্মে কায়েস বিনতে মুহসিন (রাঃ) তার শিশুপুত্রটিকে কোলে করে রাসূলের সাথে দেখা করতে আসলেন। শিশুটিকে দেখে রাসূল (সাঃ) তার দিকে এগিয়ে এলেন। পরম আদরে কোলে তুলে নিয়ে খাবারের জায়গায় গিয়ে বসলেন। শিশুটি নবীজীর আদর পেয়ে তাঁর কোলেই পেশাব করে ভিজিয়ে দিলো। রাসূল (সাঃ) স্মিত হাসলেন। চেহারায় বিরক্তি প্রকাশ পেলো না। তিনি পানি আনার জন্য একজনকে বললেন। পানি আনা হলে যে যে জায়গায় পেশাব পড়েছিল সেখানে পানি ঢেলে দিলেন। রাসূলেখোদা মনে করতেন, বাগানের ফুল যেমন পবিত্র, মায়েব কোল থেকে নেয়া শিশুও তেমনি পবিত্র।
রাসূলে খোদা বলেছেন, “তোমরা শিশুদেরকে স্নেহ কর এবং তাদের প্রতি দয়ালু হও।” শিশুদের প্রতি মহানবী (সাঃ)’র স্নেহ ও পিতৃসূলভ আচরণের কথা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে ৷ রাসূল (সাঃ) শিশুদের সাথে খেলতেন এবং এমনকি তাদের খেলনা ও পোষা প্রাণীরও খবর নিতেন ৷ তিনি তাঁদের সাথে শিশুসুলভ ভঙ্গিতে ও নীচু কন্ঠে কথা বলতেন ৷ বিশেষ করে নাতি ইমাম হাসান ও হোসাইনের প্রতি রাসূলের ভালোবাসা ও স্নেহের কথা কমবেশী সবাই জানে ৷ মহানবী (সাঃ) তাঁর এ নাতিদের সাথে খেলাধুলা করতেন এবং অন্যদের সামনে তাদের চুমু দিতেন ৷ তিনি প্রতিদিন তাঁদের সান্নিধ্য দিতেন ৷ আর এভাবে তিনি মুসলমানদের বাস্তবে শিখিয়ে গেছেন যে,কিভাবে শিশুদের সাথে ব্যবহার করতে হয় ৷
শিশুদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়, তাদের সাথে আমাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত তা রাসূলেখোদার জীবনী থেকে জানলাম। কিন্তু অনেক অভিভাবক আছেন যারা শিশুদের সাথে কোমল আচরণ করেন না, তাদের কথাও মনোযোগ দিয়ে শোনেন না। কেবল হু,হা করে যান। এমন আচরণ করলে শিশুরা কষ্ট পায়। আর এটা ইসলামী আদর্শেরও পরিপন্থী। মনে রাখতে হবে, ঘর সাজাতে হলে শিশু প্রয়োজন। যত মূল্যবান আসবাবপত্র দ্বারাই গৃহ পূর্ণ করা হোক না কেন, একটি শিশু ঘরটিতে যত জীবন্ত, আনন্দময় এবং সুন্দর করে তোলে, অতি মূল্যবান আসবাবপত্রও তার তুলনায় মূল্যহীন। তাই আমাদের সবাইকে শিশুদের প্রতি আন্তরিক ও স্নেহশীল হতে হবে।
শিশুদের প্রতি অভিভাবকদের কর্তব্য এবং রাসূল (সাঃ)এর ব্যবহার সম্পর্কে জানা হলো। এখন শিশুদের কর্তব্য হচ্ছে, পিতা-মাতা ও অভিভাবকদের কথামতো চলা। তারা কষ্ট পান এমন কোন আচরণ করা কখনই উচিত হবে না। তো, আমরা সবাই রাসূল (সাঃ) এর নির্দেশিত আদর্শ পরিবার গঠনে ভূমিকা রাখবো-এই হোক এবারের ঈদে মীলাদুন্নবীর অঙ্গীকার।