চেঁচামেচি-চিৎকার শুনে মামুনের ঘুম ভেঙ্গে গেল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মামুনের বাবা তাদেরকে মা-ভাইবোনসহ নানার বাড়ি রাসূলপুরে পাঠিয়ে দিলেন। এলাকাটি নদী-নালা-খাল-বিল বেষ্টিত একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। হেঁটে নৌকা ছাড়া যাতায়াতের আর কোনো ব্যবস্থা নেই। রিক্সা, ভ্যান কোনো কিছুই চলাচল করে না।
মামুনের নানাবাড়ি এলাকায় সকলেই মীরবাড়ি বলে চিনে। বাড়ির সামনে দিয়ে চলে গেছে ধলেশ্বরী নদী। ডান পাশ দিয়ে একটা সরু তির তিরে খাল নদী থেকে বের হয়ে পেছনে মান্তার বিলে গিয়ে মিশেছে। সবকিছু চিন্তা করে মুক্তিযুদ্ধের সময় মামুনের বাবা জামালউদ্দিন পরিবারের সকলকে মামুনের নানাবাড়ি রেখে মুক্তিযুদ্ধে চলে যায়। যুদ্ধে যাবার সময় মামুনের বড় মামা আনিসকে নিয়ে যায়। আনিস দশম শ্রেণীর ছাত্র। প্রথমে আনিসকে মুক্তিযুদ্ধে নিতে চায় নি, জোর করেই আনিস মুক্তিযুদ্ধে চলে যায়।
হঠাৎ চারিদিকে চিৎকার চেঁচামেচি। সকলেই যার যা কিছু সম্বল আছে পিঠে-মাথায় করে দৌড়াচ্ছে, জীবনের ভয়ে সকলেই ব্যস্ত। কেউ কেউ চিৎকার করে চলছে, ‘গ্রামে মিলিটারী আইতাছে, পালাও সকলে পালাও।’ মামুনতো হতবাক কি করবে, সাথে সাথেই বইখাতা ফেলে রেখে এক দৌড়ে বাড়িতে চলে গেল, গিয়ে দেখে এদিকে মিলিটারী মামুনের নানাবাড়ি পর্যন্ত এসে গেছে পুড়িয়ে দিচ্ছে ঘরবাড়ি, ধরে নিয়ে যাচ্ছে গরু-ছাগল। গ্রামে জনমানব শূন্য, রাগে মিলিটারীরা ফাঁকা গুলি করছে। গ্রাম ছেড়ে এতোগুলো মানুষ কোথায় গেলো কিছু বুঝতে পারছে না। আবার মামুনেরা পাশের যে গ্রামে লুকিয়েছে, সেখানে মিলিটারীরা এগুতে ভয় পাচ্ছে এতই দুর্গম এবং ঝুকিপূর্ণ কারণ সেখানে মুক্তি যোদ্ধাদের একটি বড় ঘাঁটি আছে। সেখানে গেলে আর তাদের জীবন নিয়ে ফিরে আসতে হবে না।
সন্ধ্যা হয়ে যাওয়াতে প্রায় পঞ্চাশ-ষাটজন মিলিটারী মামুনের নানার বাড়িতেই তাঁবু গেড়ে ঘাঁটি বানালো। এখান থেকেই আশে পাশের গ্রামে সব অপারেশন চালাবে। এদিকে পাশের মুক্তি যোদ্ধারা খবর পেয়ে গেলো রাসূলপুরে মিলিটারী ঘাঁটি বেঁধেছে।
এবার মুক্তিযুদ্ধারা তাদের অবস্থান ও গতিবিধি জানার জন্যে গোয়েন্দা নিয়োগ করলো, মামুনসহ আরো তিনটি ছেলেকে বুঝিয়ে দিলো কীভাবে মিলিটারীদের তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।
মামুন, মোকাররম ও মাহবুব তিনজনকে মুক্তি যোদ্ধা আরিফ সন্ধ্যার দিকে একটু এগিয়ে পাঠিয়ে দিলো রাসূলপুর গ্রামে। এদিকে রাতের অন্ধকার নেমে আসলো। তিনজনই পা টিপে টিপে সামনে এগুচ্ছে, দূর থেকে দেখতে পেলো মামুনের নানার বাড়ির সব ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই, সেখানে একটি পাকিস্তানি পতাকা হাল্কা দেখা যাচ্ছে, আর নিচে অনেকগুলো বাতি জলছে। কাজল বললো, ‘দেখ দেখ বাড়িতে মিলিটারী ঘাঁটি বেঁধেছে। চল সামনে গিয়ে দেখি ওরা কি করে।’
তিনজন একেবারেই ঘাঁটির কাছে চলে গেছে, দেখছে মেশিনগান নিয়ে ঘাঁটির চারপাশে আট-দশজন পাহারা দিচ্ছে। চার-পাঁচটি তাবুতে বাতি জ্বলছে, কিছু মিলিটারী মাটিতে বসে অন্ধকারে গল্প করছে। একপাশে কয়েকজন চুলাতে রান্না করছে। ভয়ে তিনজনেই কাঁপছে এই বুঝি ওরা দেখে ফেলে, তা হলে আর রক্ষা নেই। একেবারে ব্রাশ ফায়ার করে তিনজনকেই ঝাঝরা করে ফেলবে। আর দেরী না করে তারা মুক্তি যোদ্ধাদের ঘাঁটিতে ফিরে এলো। মুক্তি যোদ্ধা কমান্ডার ল্যান্স নায়েক মুর্শেদ তিনজনকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে মিলিটারীদের অবস্থান, তাদের সংখ্যা, তাদের গোলাবারুদসহ বিস্তারিত তথ্য জেনে নিলো। এবার মুক্তি যোদ্ধাদের মিলিটারী ক্যাম্প অপারেশনের পালা। মুক্তি যোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশজন। সকলের কাছেই এসএমজি, এলএমজি, থ্রি-লট-থ্রি রাইফেল, গ্রেনেডসহ প্রচুর গোলাবারুদ আছে। পরামর্শ মোতাবেক গভীর রাতের অন্ধকারে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত হয়।
মামুনের নানার বাড়ির চারদিক থেকে আক্রমণ করা হবে, প্রত্যেক ভাগে দশ-বারোজন করে মুক্তি যোদ্ধা থাকবে। কথা মতো গভীর রাতে ঘাঁটি থেকে মুক্তি যোদ্ধারা পূর্ণ রণপ্রস্ত্ততিতে বেরিয়ে গেলো। পাঁচটি নৌকায় মোট চল্লিশজন মুক্তিযোদ্ধা মান্তারবিল ধরে এগুচ্ছে, উদ্দেশ্য মামুনের নানাবাড়ির পাশের খাল পর্যন্ত নৌকা নিয়ে যাবে। তারপর পায়ে হেঁটে আক্রমণ। প্রায় দুইঘণ্টা চলার পর নৌকা পাঁচটি জলসিঁগি প্রাইমারী স্কুলের ঘাটে পৌঁছাল। সকলেই নিশ্চুপ, ঘন অন্ধকার, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। সকলেই নৌকা থেকে নেমে স্কুলের মাঝে চার সারিতে লাইন ধরে দাঁড়ালো। নিজেদের অস্ত্র-গোলাবারুদ দেখে নিলো। পাঁচজনের কাছে চারটি করে কুড়িটা গ্রেনেড, কমান্ডারসহ দশজনের কাছে একটা করে মেশিনগান, বাকীদের কাছে একটা করে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল; প্রত্যেকের কাছে পর্যাপ্ত গুলি রয়েছে। ইতোমধ্যে অন্ধকারে চুপি চুপি মিলিটারী ক্যাম্পের খবর নিয়ে আসে মামুন। ক্যাম্প ঘিরে দশজন গোঁফওয়াপলা ভয়ালদর্শন পাঞ্জাবি সৈন্য স্বয়ংক্রিয় রাইফেল তাক করে বালির বস্তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে, বাকি সৈন্যরা কেউ জেগে আছে কেউ ঘুমুচ্ছে। মামুনের কাছ থেকে সব তথ্য নিয়ে দশজন করে চার ভাগে ভাগ হয়ে গেল চল্লিশজন মুক্তি যোদ্ধা। সকলেই সাবধান! টানটান উত্তেজনা, জীবনমৃত্যুর সম্মুখিন। কারো মনে কোনো ভয় নেই, সকলের মনে প্রতিশোধের আগুন। পাঞ্জাবি হায়েনাদের ধ্বংস করতেই হবে। সকলেই অন্ধকারে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে ভিজে পা টিপে টিপে সামনে এগুচ্ছে। তারপর কনুইয়ে ভর দিয়ে, ক্রলিং করে নিঃশ্বব্দে একেবারে ক্যাম্পের কাছে চলে এসেছে। কথা মত একসাথে দশজনে প্রথমেই দশটি গ্রেনেড বালির বস্তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা পাঞ্জাবি সৈন্যের উপর ছুঁড়ে মারলো, সাথে সাথে আরো পাঁচটি গ্রেনেড ক্যাম্পের মাঝখানে চার্জ করা হলো। সাথে সাথেই বিকট আওয়াজে সবকিছু উড়ে গেল, বাকি সৈন্যরা ক্যাম্প থেকে এলোপাতাড়ি ব্রাশফায়ার করছে। মুক্তি যোদ্ধারাও টার্গেট করে অন্ধকার থেকে ফায়ার করছে। এভাবে প্রায় বিশ মিনিট গুলি বিনিময়ের পর সব পাঞ্জাবি সৈন্য নিহত হয়েছে, লাশ পড়ে আছে। গ্রেনেড়ের আঘাতে অনেকের ছিন্নভিন্ন দেহ। এদিকে প্রচন্ড গোলাগুলিতে পাঁচজন মুক্তি যোদ্ধা শহীদ হন, দশজন গুলিতে আহত হন। আহত ও নিহত মুক্তি যোদ্ধাদের নৌকায় তুলে সকলেই আবার মান্তারবিল ধরে আছারগাঁও এর দিকে রওয়ানা হলো।
সেদিনের সেই ভয়াল যুদ্ধের স্মৃতি এবং বাবা এ বড়মামার শহীদ হওয়ার বেদনা মামুনকে একচল্লিশ বছর পর আজো তাড়িয়ে বেড়ায়। তবে আশা ও গৌরবে বুকটা মামুনের ভরে উঠে। মামুনের বাবা ও বড় মামার মতো লক্ষ লক্ষ বীর মুক্তি যোদ্ধাদের রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা, যার জন্যে বায়ান্নতে বাঙালি ছেলেদের রক্ত দিতে হয়েছিল। দেশমাতৃকার জন্যে কোনো শহীদের রক্ত বৃথা যায় না, জাতি চিরদিন তাদের বীর মর্যাদায় স্মরণ করে।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।