‘- গোপালবাবু যে! শুনলুম কাল রাতে আপনার বাড়িতে চোর এসেছিল! — ওঃ সে কী কান্ড মশাই। চোর বলে চোর! সাংঘাতিক চোর! — চোর-ডাকাতরই যুগ পড়েছে মশাই। চারদিকে চুরির একেবারে মচ্ছোব পড়ে গেছে। কী চুরি হচ্ছে না বলুন। সোনা- দানা, টাকা পয়সা, বাসনকোসন, জামাকাপড়, এমনকি জুতো, ঝাঁটা, বস্তা, পাপোষ যা পাচ্ছে চেঁছেপুঁছে নিয়ে যাচ্ছে। পরেশবাবুর বাড়িতে যেদিন চুরি হল তার পরদিন তো তাদের লজ্জা নিবারণের বস্ত্রটুকু পর্যন্ত রইল না। — তা যা বলেছেন। চোরদের আস্পদ্দা দিন-দিন বাড়ছে। — অতি সত্য কথা। নরেনবাবুর বাড়িতে যে চোর এসছিল সে তো রীতিমতো নরেনবাবুকে দু’চার কথা শুনিয়ে যেতে ছাড়েনি। কিপটে, কঞ্জুস, নীচু নজর, রুচিহীন, এমনকি এমন কথা বলে গেছে, আপনার বাড়িতে চুরি করতে এসে যে ভুল করেছি, গঙ্গাস্নান করে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে… –বটে! এ তো সাংঘাতিক অপমান! –অপমান বলে অপমান! নরেনবাবু তো সেই থেকে ভারী মনমরা হয়ে পড়েছেন। দু-দিন অন্নজল গ্রহণ করেননি। তবে কিনা বিশ্বকঞ্জুস নরেনবাবু সেই রাত থেকে বেশ দরাজ হয়েছে। এখন দেখছি বাজার থেকে বড় মাছ, ময়রার দোকান থেকে সন্দেশ এসব কিনছেন। — তাই নাকি! এই জন্যই সব জিনিসেরই খারাপ আর ভাল দুটো দিক থাকে। — তা আপনার বাড়ি থেকে কী কী চুরি গেল? — সে সব এখনও হিসেব হয়নি। –কিন্তু গোপালবাবু, আপনার কব্জিতে রোলেক্স হাতঘড়িটা এখনও দেখতে পাচ্ছি যে! ব্যাপারটা কী? চোর কি ওটা দামি ঘড়ি বলে বুঝতে পারেনি? –পারেনি মানে! ঘড়িটা একটানে খুলে নিয়ে একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে কত সালের কোন মডেল, কত দাম সব গড়গড় করে বলে গেল মশাই। — তাজ্জব কথা! তবু নেয়নি? — না। ঘড়িটা তাচ্ছিল্যে সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, এ ঘড়ির এখন অনেক দাম। সাবধানে রাখবেন। — বলেন কী? কলিযুগ কি শেষ হয়ে গেল নাকি মশাই? তারপর ধরুন, আপনার স্ত্রীর গলায় একটা পনেরো ভরির সীতাহারের কথা যেন শুনেছি। সবাই বলে দামি হার নাকি। তা সেটা নিশ্চয়ই গেছে। –উঁহু। সীতাহারটা তো ছুঁলই না। দূর থেকেই বলে দিল চৌদ্দ ভরি আট রতি মাপা আছে। এখনকার বাজার দর নাকি দেড়লাখ টাকার উপরে। — সেটাও নেয়নি! সে আবার কেমনধারা চোর? আপনার লোহার আলমারি খোলেনি? –খুলেছে বইকি। চোর বলে কথা! খুলল, দেখল। — ওই আলমারিতে তো বোধ হয় … — ঠিকই ধরেছেন। আমার সব ক্যাশ টাকা ওই আলমারিতেই থাকে। আজ লেবার পেমেন্টের জন্য আড়াই লাখ টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে এনে ওই আলমারিতেই রেখেছিলাম। টাকাগুলো বের করে গুনেটুনে দেখলও। — তারপর থলিতে ভরল তো! — হ্যাঁ, থলিও তার সঙ্গে একটা ছিল বটে। রুকস্যাকের মতো একটা ব্যাগ। ভরার উপক্রম একবার করেছিল। তারপর নিজের মনে ‘না থাক’ বলে যেমন ছিল তেমনি আবার আলমারিতে সাজিয়ে রেখে দিল। — আড়াই লাখ টাকা! চোর আড়াই লাখ টাকা হাতে পেয়েও নিল না মশাই! এ্যাঃ, আমারই তো হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আপনার দুবাই না তেহরান থেকে আনা হীরের কালেকশনটা? লোকে তো বলে পূর্ব ভারতে আপনার মতো হীরের কালেকশন কারও কাছে নেই। — ঠিকই বলে। আমি বহুকাল ধরেই হীরে কালেকশন করে আসছি, ওটাই আমার নেশা। রেয়ার সব হীরে মশাই। লাখ লাখ টাকা দাম। — তা সেসব কি ছাড়তে পারে? — ছাড়েওনি। আমাকে দিয়ে জোর করিয়ে সিন্দুক খুলিয়ে সব আঁতিপাঁতি করে দেখেছে। দেড়শো হীড়ে ছাড়াও নাোন সাইজের মুক্তে, নীলা, পোখরাজ, চুনি, গোমেদ মিলিয়ে কয়েক কোটি টাকার পাথর।
— আহা, শুনেই আমার পিলে চমকাচ্ছে। তা গেল তো সেগুলো! যাবেই। অত দামি জিনিস কি বাড়িতে রাখতে আছে মশাই? ব্যাঙ্কের ভল্টে বা মাটির নীচে পুঁতেটুঁতে রাখতে হয়। — তা বটে। সে রকম একটা ফন্দি মনে-মনে ঠিকও করে রেখেছি। কিন্তু সেটা কার্যকর করার আগেই কাল মধ্যরাতে চোরের আবির্ভাব। — জানালা ভেঙে ঢুকল বুঝি? — না, অতি ঘোড়েল চোর। ভাঙচুর করলে তো শব্দ শুনতে পেতাম। আমার আবার ভারী সজাগ ঘুম। বাড়ির দেউড়িতে দারোয়ান আছে, দুটো অ্যালসেশিয়ান কুকুর, টোটাভরতি বন্দুক আছে, বালিশের তলায় পিস্তল নিয়ে শুই। সুতরাং মোটামুটি নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে নিশ্ছিদ্রই বলা যায়। — হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনার বাড়িটা তো দুর্গ বিশেষ। কুকুরদুটো খুবই তেজী। দারোয়ান দুটোও বেশ তগড়াই চেহারার বটে। তাহলে চোরটা ঢুকল কীভাবে বলুন তো! –সেটাই রহস্য। আমি চোরটাকে জিগ্যেসও করেছিলুম, বাপু হে, এ বাড়িতে ঢোকা তো সহজ নয়। তুমি ঢুকলে কি করে? — জবাবে কী বলল? — বলল, দুনিয়ায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। সব জায়গাতেই ঢোকা সম্ভব। আমি আপনার বাড়ির সামনের তেঁতুল গাছ থেকে হুক সমেত একটা নাইলন ছুড়ে ছাদের রেলিঙে আটকে দিয়ে সেইটে বেয়ে ছাদে এসে নামি। — এ তো দেখছি টারজান! — তা বলতে পারেন। দিব্যি কসরত করা চেহারা। ভদ্রঘরের ছেলের মতোই মনে হয়। — দিনকাল যা পড়েছে, ভদ্রঘরের বেকার ছেলেদেরও এইসব পথেই নামতে হচ্ছে। তা তারপর কী হল? — চোরেরা নিঃশ্চুপ চুরি করে সেটাই রেওয়াজ। কিন্তু এর কায়দা আলাদা। খুব মোলায়েম গলায় আমার নাম ধরে ডেকে ঘুম ভাঙাল। — নাম ধরে? ছিঃ ছিঃ, আপনি বয়স্ক মা্নুষ। — না, সে আমাকে গোপালকাকা বলে ডেকেছিল। — বাঁচোয়া। তারপর বলুন। — আমি পিস্তল খুঁজতে গিয়ে দেখি, সেটা যথাস্থানে নেই। চোরটা বলল, অস্ত্রশস্ত্র সরিয়ে নিয়েছি।। আলমারি সিন্দুক সব খুলুন। সময় নেই। — ওরে বাবা! এ তো চোরের বেশে ডাকাত! — তাও বলতে পারেন। সব দেখল। টাকা পয়সা, হীরে জহরত, সোনাদানা, কিন্তু কোনটাই তার যেন পছন্দ হচ্ছিল না। হীরেজহরতগুলো একটু নাড়াচাড়া করল বটে, কিন্তু যেন তেমন গা করল না। — এ কেমন বেয়াদব চোর মশাই। এত কসরত করে ঢুকল, সব হাতের নাগালে পেল তাও তার গাল উঠল না কেন? — সেইটেই রহস্য। সব দেখেশুনে বলল, আপনার আর কোনও দামি জিনিস নেই? আমি অবাক হয়ে বললাম, এর চেয়ে দামি জিনিস আর কী থাকবে? চোরটা মুখ বেঁকিযে বলল, ‘হ্যাঁ, এসব জিনিস বটে, কিন্তু আমার দরকার লাগবে না। — বটে! খুব নবাবপুত্তুর দেখছি। তারপর? — তারপর সে বলল, আপনার বইপত্র কোথায় থাকে? আমি বললুম, নীচের লাইব্রেরী ঘরে। — বইপত্র! ছোঃ বইপত্র দিয়ে কী হবে? –সেইটে তো জানি না। তবে নিয়ে তে হল। দেখলাম বইপত্রে তার বেশ আগ্রহ। বিস্তর বই বের করে করে দেখল, আবার যত্ন করে জায়গায় রেখে দিল। অনেকক্ষণ ধরে প্রতিটি আলমারি ঘাঁটল সে। — বই ঘেঁটে সময় নষ্ট করা কেন বাপু? — আমিও সেই কাথাই বলেছিলুম। সে বলল, ও আপনি বুঝবেন না। — তারপর? — বললে বিশ্বাস করবেন না, খুঁজে খুঁজে সে একখানা বই বের করল। বেশ পুরনো বই। নাম নীলবসনা সুন্দরী। কার লেখা জানি না। বইপত্র পড়ার অভ্যাস আমার নেই। বাপ-দাদার আমল থেকেই ওগুলো পড়ে আছে। — নীলবাসনা সুন্দরী! তা সেটা কী করল? — সেটাই চুরি করল মশাই। বলল, এটা চুরি করতেই আমার আসা। — শুধু একটা বই? — হ্যাঁ। বইটা নিয়ে সে হাওয়া হয়ে গেল মশাই! — আশ্চর্য! এরকম আহাম্মক আর দেখিনি! ঝুরি কুড়ি গল্প – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়.