
পশ্চিমটা লাল হয়ে উঠল, যেদিন কৃষ্ণচূড়ার বনে হাঁটছিলাম সেদিনের মতো। কেউ আগুন লাগায়নি, তবু প্রস্ফুটিত পুষ্পের মধ্যে অগি্নশিখা ছিল। তাই দেখে দূর থেকে ভাবছিলাম, সামনে বুঝিবা দাবানল। চোখ তুলে চেয়ে দেখি, রবি ডুবছে কিন্তু আকাশের গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়ে গেল। আমাদের পথ কি এখনো শেষ হয়নি, ঠাকুর? সত্তরোর্ধ্ব রাজেন্দ্র ঠাকুর মোটা আসামি বেতের লাঠি ভর দিয়ে আগে, আগে পশ্চাতে দোভাঁজ করা পুরনো শাড়িতে বাঁধা গাঁটরি হাতে সাবিত্রী। পুঁটলিটির মধ্যে উভয়ের যাবতীয় অস্থাবর সম্পত্তি — বাড়তি বস্ত্র, রন্ধনের তৈজসপত্র, গাড়ু ইত্যাদি। বয়সের ভারে কিঞ্চিৎ কুঁজো সাবিত্রী অগ্রগামীকে অনুসরণ করছিল। ওরা প্রভাতে যাত্রা শুরু করেছে। সাবিত্রী ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। সূর্যাস্তের পূর্বক্ষণে পশ্চিম দিগন্তে কিছু মেঘ করেছিল। তাতে সূর্যালোক পড়ে আকাশ অগি্নবর্ণ হয়েছিল। সাবিত্রী সেদিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়ায়। এবং অগ্রযাত্রীকে প্রশ্ন করে : পথ কি এখনো শেষ হয়নি, ঠাকুর?
কীসব কথা যে আজ বলছ সাবিত্রী, মাথামন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। পাখির মনমেজাজ কেমন করে জানব — পাখি তো মানুষ নয়, তার ভাষাও বুঝি না। তার কূজন ভাষা কি না — তাও জানি না। ধ্বনিবৈচিত্র্য নেই তার কুহরণে। কিন্তু মানুষ! মানুষকেও কি বোঝো না ঠাকুর? বুঝি বৈকি! সেদিন তোমার মনের কথাটি বুঝতে পেরেছিলাম বলেই তো তোমাকে আহ্বান করেছিলাম। সেদিন কি দোহে এক হইনি সাবিত্রী? দুজনে মিলে এক কিন্তু একা তো ছিলাম না। তখনো ছিলাম দুজন আজও দুজন। দুজনে মিলে এক ও অভিন্ন, কিন্তু কখনো একা নই। সে তো অনেক অনেক দিন আগের কথা ঠাকুর। আমি বাল্যে বিধবা হয়েছিলাম কিন্তু যৌবন আমাকে ত্যাগ করেনি। প্রকৃতির কী আশ্চর্য শক্তি! সে লোহার ন্যায় শক্ত সামাজিক বিধানও মানে না। তাই বুঝি মানুষও বিধান উপেক্ষা করে, তাই না ঠাকুর? প্রকৃতি ও মানুষের ধর্ম তাহলে এক ও অভিন্ন, কি বলো? কিন্তু সে যে বহুকালের কথা, তখন তোমার স্ত্রী ছিল।
গায়ে অসংখ্য আঁচড় লেগেছিল কিন্তু ব্যথা পাইনি; তোমার হাঁটুর চামড়া ছিঁড়ে গিয়েছিল, কিন্তু যন্ত্রণা বোধ করোনি : তাই না ঠাকুর? সাবিত্রী হাঁপাতে থাকে।হ্যাঁ! হ্যাঁ! ঠিক বলেছ সাবিত্রী, যথার্থ বলেছ। এই তো প্রকৃতিস্থ হয়েছ। কিছুই মিলিয়ে যায়নি সাবিত্রী, স্মৃতির মধ্যে সব বেঁচে আছে। স্মৃতিই জীবন। স্মৃতি শান্তি। বলবে জাবর কাটা। জাবর কাটা-ই যে প্রশান্তি সাবিত্রী। তুমি সুস্থ হয়ে গেছ, ওঠো আবার পথ চলি। জল! একটু জল! কোথায় জল! সারা পৃথিবী ঘুরে এলাম কোথাও একবিন্দু জল দেখলাম না। এ কোথায় এলাম আমরা ঠাকুর? তৃষ্ণার্ত সাবিত্রী চোখ বিস্ফোরিত করে। জল খাবে সাবিত্রী? কমণ্ডলু ভরা জল থাকতে জল নেই বলছ কেন? এই নাও, জল খাও। রাজেন ঠাকুর কমণ্ডলু কাত করে দেয় সাবিত্রীর মুখে। জলের ধারা ওষ্ঠসন্ধি বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। সাবিত্রী তার যাত্রাপথ শেষ করেছে। সাবিত্রী বিশ্রাম নিচ্ছে। সে এখন আর জল খাবে না। রাজেন ভট্টাজ কয়েকবার চেষ্টা করে সাবিত্রীর ঘুম ভাঙাতে। কিন্তু সাবিত্রীর ঘুম ভাঙে না। সহসা একটা ভয়ানক ভীতি পাথর হয়ে চেপে বসতে চায় রাজেন ঠাকুরের দেহের ওপর। সে দ্রুত প্রদীপ দীপ্তি লোকালয়ের দিকে পথ ধরে। পশ্চাৎ দিকে ফিরেও তাকায় না। সাবিত্রী ঠিকই বলেছিল, সেতু নেই। মনে মনে সেতুর কথা ভাবতে ভাবতে সে লাঠি ঠুকে পথ ধরে। পুঁটলিটা পড়ে থাকে সাবিত্রীর শিথানে। —আবু জাফর শামসুদ্দীন