রাজা ও মুরগি— আহমেদ রিয়াজ

বনের পথ ধরে যাচ্ছিলেন বনের রাজা। অনেক লড়াইয়ের পর বনের রাজা হয়েছেন বাঘ। সিংহরা বেশ অনেকদিন রাজত্ব করেছে বনে। একটানা সিংহকে রাজা দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়েগিয়েছিল বনের পশুরা। রাজা জাত সিংহের দাপটে বনে টিকে থাকাই কষ্টকর হচ্ছিল বাঘদের। রাজা না হয়ে আর উপায় ছিল না।
বনের সবচেয়ে চতুর প্রাণী শেয়ালদের সাহায্যে রাজা হয়েছেন বাঘদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী এক বাঘ। যেমন তার গায়ের রঙ তেমনি তার তেজ। সুন্দর হলুদের মধ্যে কালো কালো ডোরা। সূর্যের আলোয় যখন বনের পথ দিয়ে হেঁটে যান বাঘ, তখন তাকে সত্যিকারের রাজার মতোই লাগে। রাজকীয় তার চাল-চলন। বনের পথ দিয়ে মাঝে মাঝেই হাঁটেন তিনি। বনের পশু-পাখিদের খোঁজ খবর নেন। সেদিনও সকাল সকাল হাঁটছিলেন বনের রাজা। হরিণদের আস্তানা, সজারুদের কুঁড়ে, বানরদের ঘরবাড়ি, শেয়ালদের গুহাÑসব ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। কেবল সিংহদের আস্তানায় যাননি। সিংহরা এখনও বাঘের ওপর রাগ পুষে রেখেছে কি না কে জানে। রাখতেও পারে। তাই সিংহের আস্তানায় যাওয়াটা বাদ দিলেন রাজা বাঘ। রাজার সঙ্গে পশু মন্ত্রী শেয়াল। একসময় ঘুরতে ঘুরতে তারা চলে এলেন মুরগির আস্তানায়। আর মুরগির আস্তানায় এসে দেখলেন আট-দশটা মুরগি বসে বসে তা দিচ্ছিল ডিমে। রাজাকে দেখে ওরা উঠে দাঁড়াল না।
পশু মন্ত্রী শেয়ালের কিন্তু ভালো লাগল না ব্যপারটা। রাজাকে বলল, রাজা হুজুর দেখেছেন কাণ্ডটা?
রাজা বললেন, কী কাণ্ড?
শেয়াল বলল, আপনি যে পথ দিয়ে হেঁটে গেছেন, সব পশু-পাখি আপনাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়েছে। মুরগিগুলো আপনাকে দেখে উঠে দাঁড়াল না। এটা কোনো ভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
রাজা ভাবলেন সত্যিই তো! তাকে তো সম্মান জানানো উচিত ছিল মুরগিদের। কিন্তু কেন ওরা এমন করল?
পশু মন্ত্রী কিন্তু এর মধ্যেই ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পেয়েছে। রাজাকে বলল, ওরা আপনাকে রাজা হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। ওদের কাছে সিংহই বনের রাজা। তাই আপনাকে দেখেও উঠে দাঁড়ায়নি।
রাজার মনে হলো শেয়াল ঠিক কথাই বলেছে। শেয়ালের কাছে জানতে চাইলেন, এখন কী করা যায়?
পশুমন্ত্রী বলল, মুরগিগুলো ধরে আনবো?
রাজা বললেন, না। ধরে আনার দরকার নেই। ওদের কাছ থেকে কেবল জেনে এসো কেন ওরা এমন করল?
মুরগিগুলোর সামনে এসে পশু মন্ত্রী বলল, তোমরা জানো বনের রাজা এখন কে?
শেয়ালের কথার উত্তর দেয়ার কিন্তু ইচ্ছে ওদের নেই। কেবল পশুদের মন্ত্রী হয়েছে বলে উত্তর দিতে হবে। তাই নিতান্ত অনিচ্ছায় ওরা উত্তর দিল, বনের সবাই জানে।
পশু মন্ত্রী বলল, তাহলে তোমরা রাজাকে দেখে উঠে দাঁড়ালে না কেন?
সবচেয়ে তাগড়া মুরগিটা বলল, আমরা এখন ডিমে তা দিচ্ছি। রাজাকে দেখে উঠে দাঁড়ানোর সময় আমাদের নেই।
এমন জবাব শুনে খেপে গেল পশু মন্ত্রী। একটু দূরে দাঁড়ানো রাজাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, রাজা মশাই শুনেছেন? আপনাকে সম্মান দেখানোর সময় নাকি ওদের নেই।
এবার এক সঙ্গে করর করর করে উঠল মুরগিগুলো। অবাক হয়ে বলল, আমরা এটা বলিনি। আমরা বলেছি, এখন আমরা ডিমে তা দিচ্ছি। এখন রাজাকে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান দেখানোর সময় আমাদের নেই।
রাজার সামনে অপমান বোধ করল পশু মন্ত্রী। আরো খেপে গেল সে মুরগিগুলোর ওপর। বলল, তোমরা জানো রাজা যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারেন? বনের যে কোনো পশুকে বন থেকে বের করে দিতে পারেন। ইচ্ছে হলে বনের যে কোনো পশু বা পাখিকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে পারেন। জানো সেটা?
শেয়ালের কথায় কক কক করে হেসে ওঠল ডিমে তা দিতে থাকা সবক’টা মুরগি। হাসতে হাসতে একটা মুরগি বলল, সত্যিই আমাদের রাজা সব করতে পারেন?
পশুমন্ত্রী বলল, হ্যাঁ। স-ব করতে পারেন। দেখতে চাও তোমরা?
আরেকটা মুরগি বলল, হ্যাঁ দেখতে চাই।
শেয়াল বলল, কেন তোমাদের বিশ্বাস হচ্ছে না?
আরেকটি মুরগি বলল, মোটেই বিশ্বাস হচ্ছে না। রাজা পারেন না এমন হাজারটা কাজ আছে। পারলে রাজাকে আমাদের ডিমে তা দিতে বলতো?
এবার বেশ ঝামেলায় পড়ে গেল পশুমন্ত্রী। রাজাকে সে কেমন করে মুরগির ডিমে তা দেয়ার কথা বলবে? শুনলে রাজা কী মনে করবেন? হাজার হোক বনের রাজা। তিনি বসে বসে মুরগির ডিমে তা দিচ্ছেন, দেখতে নিশ্চয়ই ভালো লাগবে না। সবচেয়ে বড় কথা হলো রাজা কেমন করে মুরগির ডিমে তা দেবেন? আবার রাজাকে মুরগির ডিমে তা দিতে না বললে মুরগিগুলোর কাছে নিজেকে হেয় করে ফেলবে সে। কারণ সে বলেছে রাজা যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারেন। কথাটা না বললেই ভালো হতো। মুরগিগুলোর কাছে এমনভাবে হেরে যাবে ভাবেনি পশুমন্ত্রী। এখন উপায়?
উপায় আর কী। শেয়ালের মাথায় থাকে হাজারটা ফন্দি ফিকির। তাকে বুদ্ধিতে হারানো সহজ ব্যাপার নয়। কিন্তু সবসময় যে কথাটা ঠিক, সেটাও নয়। এ অবস্থা থেকে বের হওয়ার উপায় নিয়ে ভাবতে শুরু করল শেয়াল। শেয়াল ভাবতে পারে খুব তাড়াতাড়ি। মুরগিগুলোর সামনে থেকে রাজার সামনে যেতে যতটুকু সময়, ওই সময়টুকুতেই যা ভাবার ভেবে নিয়েছে সে।
পশুমন্ত্রীকে দেখেই রাজা বললেন, মুরগিগুলো কী বলল?
শেয়াল বলল, হুজুর, ওরা বলেছে, ডিম ফুটে ছানা বেরোলে একসঙ্গেই সবাই মিলে আপনাকে সম্মান দেখানোর জন্য উঠে দাঁড়াবে। তা-ই আজ উঠে দাঁড়ায়নি।
পশুমন্ত্রীর জবাব শুনে খুশি হলেন রাজা। খুশি হলেন মুরগিগুলোর ওপর। খুশি মনে বনের অন্য পথে হাঁটতে শুরু করলেন আবার।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!