রাজবধূ পর্ব ৫৫ (রেহানা পুতুল)

রাজবধূ ৫৪ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

পাত্রের বাবা বিস্মিত হয়ে বললেন,

“একি! আমরা তো এই পাত্রী পছন্দ করিনি। অন্যপাত্রী পছন্দ করেছি। তারকথা বলেছি? তালুকদার সাহেবের কয় কন্যা?”

জুবায়ের বুঝতে পারলো সমস্যা কোথায় হয়েছে। সে উঠে গেলো বসা থেকে। শিখাকে ডেকে সাথে করে নিয়ে এলো। কিন্তু নিজে কিছু বলল না তাদের। যা বলার তারাই বলবে। শিখা সালাম দিলো মাথায় ওড়না দিয়ে। শিখাকে দেখেই পাত্রের বাবার মুখ চকচক করে উঠলো রূপোলী থালার মতন।

তিনি বললেন,

“এইতো, আমি এই কন্যাকেই সেদিন পথের ধার ঘেঁষে বই নিয়ে হেঁটে আসতে দেখলাম। তালুকদার সাহেব না করবেন না। বুঝতে পেরেছি আপনার দুই কন্যা। এটা সম্ভবত আপনার ছোট কন্যা। সমস্যা নেই। সে যতদূর পড়তে চায় আমরা পড়াবো।”

শিখা বোকা বোকা চোখে তাদের দিকে পলক তুলে চাইলো। যদিও বুঝতে পারলো মূল বিষয়টা। সে চলে গেলো নিজের রুমে।

আদুরীও চলে গেলো নিজের রুমে। ক্রোধে বেলুনের মতো ফুলে উঠেছে। পরনের শাড়ি সেফটিফিনসহ খুলে ফেলল এক ঝটকায়। তার মন চাচ্ছে সবার সামনেই শিখাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে। তারপর জেলে পঁচে মরবে। তাও তার শান্তি।

তালুকদারও ক্ষেপে গেলো। কর্কশ গলায় বললো,

“আপনারা ভুল ভাবছেন। এইটা আমার পুত্রবধূ। আমার একমাত্র কইন্যা আদুরী। যে শাড়ি পরা ছিলো।”

পাত্রের বাবা বিশ্বাস করল না। সরস হেসে বললেন,

“জানি মিথ্যা বলছেন। বড় মেয়ে রেখে ছোট মেয়ে বিয়ে দিলে বিপদে পড়বেন। কিন্তু ভাইসাহেব,আপনি তালুকদার মানুষ। খানদানি বংশ আপনার। আপনার কন্যার বিবাহ আটকাবে না। দরকার হলে দুই বেয়াই মিলে আদুরী মায়ের জন্য সুযোগ্য পাত্রের সন্ধান করবো। তবুও আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না।”

সুফিয়া বিবি ফোঁস করে তপ্ত স্বাস ছেড়এ বললেন,

“আকথা কইবেন না মিয়া। মানুষ এত বেক্কল হয় ক্যামনে? বাড়ির বউ কে,কন্যা কে না জাইনা সাদির প্রস্তাব নিয়া আইলেন?”

পাত্রপক্ষের একজন বলল,

” তালুকদার ঘরের পুত্রবধূ পড়াশোনা করে,কলেজে যায়,এটা অন্য মানুষ কিভাবে জানবে? কিভাবে বিশ্বাস করবে? সাত গ্রাম খুঁজলেও এমন নজির মিলবে না। তাহলে আমরা কিভাবে আন্দাজ করবো এটা তালুকদার কন্যা নয়? এই ভুল দূরের অচেনা,অজানা সবাই করবে। আমাদের ভুল নাই।”

“তাইলে কি আমাগো ভুল?” বলল তালুকদার।

তারা হতাশ মনে চলে গেলো।

জুবায়ের কোন বাহানায় উঠে গিয়ে শিখার রুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো। শিখা সরু চোখে চেয়ে জুবায়েরকে বলল,

“আপনার আবার কি সমস্যা জুবায়ের ভাই? যান। ভালো লাগছে না।”

জুবায়ের মিটমিটিয়ে হাসতে হাসতে বলল,

“গোলাপকে কে সবাই পছন্দ করে। নিজের করে পেতে চায়। বিবাহিত মেয়ের বিয়ের জন্য প্রস্তাব এলো। তাও আবার শ্বশুরবাড়িতেই। স্বশুরদের কাছেই। হাসি আসছে না তোমার? অনভূতি কেমন? আমি তো দারুণ মজা পেলাম। ইসস! রাজ থাকলে জমতো ভালো। বুঝি না,এই রাজটা চলে গেলেই কেন তোমাকে নিয়ে নানান ঝট বাঁধে। আবার ছাড়াতে হয় আমাকেই। অবশ্য এটার ঝট এমনিতেই খুলে গেলো এখন।”

“যান ত আপনি। অসহ্য।”

“কে? আমি?” বলল জুবায়ের।

“নাহ। আমি। আমার সাধের নারী জনম।”

ভ্রু জোড়া ঝাপটিয়ে বলল শিখা।

জুবায়ের রুমের দরজা হতে পা ঘুরিয়ে চলে গেলো। আদুরীর রুমে গিয়ে উঁকি মেরে আদুরীকে দেখলো। আদুরী জানালা দিয়ে উদাসপানে বাইরে তাকিয়ে রইলো। জুবায়ের আপন মনে হাসতে হাসতে চলে গেলো ছাদের দিকে।

সুফিয়া বিবি বরকতকে নিয়ে সেই বিকেলে টি এণ্ড টি অফিসে গেলো। রাজকে টেলিফোন করলেন। ল্যান্ডফোন রিসিভ করতেই রাজ মায়ের গলা শুনতে পেলো। অবাক হলো বেশ। কারণ সুফিয়া বিবি প্রয়োজন না হলে এভাবে বাইরে গিয়ে তাকে টেলিফোন করে না। রাজ মাকে সালাম দিলো। এবং জিজ্ঞেস করলো,

“মা কেমন আছেন? কোন সমস্যা?”

সুফিয়া বিবি কণ্ঠে গভীর খেদ ঢেলে বললেন,

“কইলে ত আমি খারাপ। বউরে ব্যারিস্টার বানাবি। এই লাইগা পড়ালেহা করাস। জামাইর বাড়ি থেইকা আবিয়াত্তা মাইয়ার মতো বাইরে যায়। বিদ্যালয়ে যায়। এখন হইলো টা কি,তার বিয়ার লাইগা প্রস্তাব আইলো গতকাইল।”

রাজ চমকে উঠলো। বিব্রতকর গলায় জিজ্ঞেস করলো,

“কি বলছেন মা?”

“তয় কই কি আমি? তারে মধুপুর চইলা যাইতে ক। আদুরীর বিয়া ঠিক হইলে আইবো। তার আগে নয়।”

বলে সুফিয়া বিস্তারিত জানালো রাজকে।

রাজ প্রতিউত্তরে বলল,

“বিষয়টাতো আসলেই জটিল। আচ্ছা আমি জুবায়েরকে টেলিফোন করে শিখাকে বুঝিয়ে বলবো।”

সুফিয়া চলে গেলো। রাজ জুবায়েরের দোকানে ফোন দিলো। বলল,

“শিখাকে এর আগেও বলছি তাদের বাড়ি থেকে কলেজে যাওয়া আসা করতে। সে রাজী হয়নি। মায়ের কাছে যা শুনলাম, তাতে সিচুয়েশন কঠিন হয়ে গেলো। তালুকদারের মেয়ে মনে করে তারজন্য বিয়ের প্রস্তাব আসে। এক কাজ কর, কাল কলেজ ছুটি হলে শিখাকে তোর দোকানে নিয়ে আসিস। আমাকে টেলিফোন করিস তখন। শিখাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলতে হবে। তুই বললে ও শুনবে না।”

“আচ্ছা, অবশ্যই নিয়ে আসবো।”

বলল জুবায়ের।

তার পরেরদিন জুবায়ের বাইক নিয়ে শিখার কলেজের মাঠে অপেক্ষা করতে থাকে। শিখা বের হলে রাজের কথা বলে শিখাকে বাইকে করে নিয়ে যায় জুবায়ের। টেলিফোনে ধরিয়ে দেয়। শিখাকে রাজ বুঝিয়ে বলে। কিন্তু শিখা একরোখা। নাছোড়বান্দা। সে জানালো,

“আমি ঠিক যেতাম। কিন্তু যাব না। ক্ষমা করবেন। আমাকে কে বা কারা মারতে চেয়েছে সেই নিখুঁত সত্য উদঘাটন করার জন্যই আমাকে তালুকদার বাড়ি থাকতে হবে। কারণ আমি চলে গেলে এই নির্মম নিষ্ঠুর সত্য চাপা পড়ে যাবে চিরতরে। এটা আমি কখনোই হতে দিব না। কেউ যেন আমাকে না দেখতে পায় সেজন্য আমি বোরকা পরে বের হবো প্রয়োজনে।”

শিখার যুক্তি উপস্থাপনের কাছে পালটা যুক্তি দাঁড় করাতে ব্যর্থ হলো রাজ। তাই একবাক্যেই বলে দিলো,

“যা ভালো মনে করো তুমি।”

কথা শেষে জুবায়ের শিখাকে বলল,

“এখানে একটা ভালো হোটেল আছে ভাত খাওয়ার। তোমার প্রিয় ভর্তা ও কচু শাক আছে। চলো একসঙ্গে খাই। কাজ ছিলো বলে আমিও এখনো খাইনি।”

ভর্তা শাক শুনে শিখার জিভে জল গড়াগড়ি শুরু করলো। ক্ষুধাও লেগেছে। তবুও ভদ্রতার খাতিরে বলল,

“নাহ থাক। আমি বাড়িতে গিয়ে খাবো। দেরি হয়ে গেলে উনারা বাজে মন্তব্য করে বসবে।”

“আমি বাইকে পৌঁছে দিবো। দেরী হবে না। আসো।”

“খাবো একশর্তে।”

“কি শিখা।”

একগাল হেসে জিজ্ঞেস করলো জুবায়ের।

“আমি জানি আপনি আমাকে মানুষ হিসেবে অত্যন্ত পছন্দ করেন। তাই বলছি অধিকার নিয়েই। কথা দেন আপনি বিয়ে করবেন? এবং সহসাই।”

“সামান্য এক বেলা ভাত খাওয়ানোর পরিবর্তে আস্ত জীবনের একটা শর্ত জুড়ে দিলে শিখা? তুমি আসলেই একটা চিজ।”

” হ্যাঁ দিলাম শর্ত। বলেন বিয়ে করবেন? চাচীর দীর্ঘশ্বাস আমাকে দুঃখ দেয়।”

মুখস্রীকে দুঃখী দুঃখী করে বলল শিখা।

“চাচীর দীর্ঘশ্বাস দেখো,আমার হৃদয় পোড়ার দহন টের পাও না শিখা?”

মনে মনে বলল জুবায়ের। ক্ষণ সময় ব্যয় করে উত্তর দিলো।

” প্রমিজ। বিয়ে করবো। তবে আমি যাকে চাই তাকে এনে দিতে পারলে। পারবে?”

“সে কি এখন অন্যের ঘরণী?”

“হ্যাঁ।”

“তাহলে পারব না। দুনিয়াতে কি আর মেয়ে নেই? আঁখিমনি, লিমা কি পাত্রী হিসেবে খারাপ? তাদের বিয়ে করেন। বা অন্য কোন মেয়েকে? নতুন এসে পুরাতনকে ভুলিয়ে দিতে পারবে। এটাই নিয়ম। এটাই হয়। দেখবেন তখন আপনি কত্ত ভালো থাকবেন।”

“দুনিয়াতে কেন,আমাদের ছোট্ট ভূখণ্ডেই কত মেয়ে আছে। কিন্তু যারা আছে, তাদেরকে এই হৃদয় টানে না শিখা। কারণ তারা সে নয়। জীবনের প্রথম অনুভূতি, প্রথম কল্পনা,প্রথম আবেগ,প্রথম ভালোলাগা,ভালোবাসা, প্রথম রঙিন স্বপ্ন সব ছিলো তাকে ঘিরেই।”

” এমন ভাব দেখান, মনে হয় আপনার প্রেমের কাছে পৃথিবীর সব প্রেম বাতাসা। ছাঁই। কেবল আপনিই ভালোবাসতে পারেন। মহান প্রেমিক সাজতে পারেন। দ্বিতীয় কেউ পারে না।”

চওড়া হাসি দিয়ে বলল শিখা।

“পারেনাকি? আছেনাকি? দেখাও না শিখা?”

“কেন উনি? আপনার জানেজিগার দোস্ত?”

“হাহাহাঃ সেতো দিল্লিকা লাড্ডুর মতো একবারেই পেয়ে গিয়েছে। আমার মতো আগেতো কাউকে হৃদয় দেয়নি। বাদ দাও৷ খাল্লি বাল্লি। আসো ভাত খাই।”

কথা শেষে শিখা খেতে রাজী হয় না। জুবায়ের অনুরোধ করে তাকে ভাত খেতে নিয়ে যায় হোটেলে। দুজনে পাশাপাশি নয়,মুখোমুখি চেয়ারে বসলো। খেয়ে বের হয়ে এলো। শিখাকে বাইকে চড়িয়ে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে দিলো। শিখা বাইক থেকে নেমে রাস্তায় ঘাসের উপর দাঁড়ালো। ধন্যবাদ দিলো জুবায়েরকে।

জুবায়ের হাত দিয়ে মাথার চুলগুলো পিছনে ঠেলে দিলো। বাইক স্ট্রাট দিয়ে চলে গেলো নিজের দোকানে। আপন মনে আওড়ে নিলো,

“একদিন তোমাকে কিছু কথা বলব শিখা। তখন দেখবো তোমার প্রতি আমার এত ত্যাগের প্রতিদানে তুমি আমাকে কি উপহার দাও।”

একদিন সকালে শিখা বুদ্ধি করে কলেজে যাওয়ার সময় সেই ধানের জমির আলে গিয়ে দাঁড়ায়। তাকে দেখেই কজন পুরুষ এগিয়ে এলো। শিখা তাদের সালাম দিলো বিনম্র গলায়।

একজন জিজ্ঞেস করলো,

“কে মা তুমি? চিনলাম না?”

“আমি তালুকদার বাড়ির পুত্রবধূ। আমাদের জমিটা দেখতে এলাম। সেদিন আমি দেখলাম আমাদের এই জমিতে দুই লাঠিয়াল গ্রুপ হাতাহাতি করছে।”

তখন একজন আরেকজনের দিকে চেয়ে তীর্যক স্বরে বলল,

“এক গোয়ালের গরুর দুধ কি আর দুই রকম স্বাদের হয়? দুইদিনের বউও আমাদের জমি কইতে শিখা গ্যাছে।”

“তার কি দোষ? নয়া বউ হইলো তোতাপাখির মতন। তারে যেমনে বোল শিখাইবো,তার মুখে তেমনিই বুলি ফুটবো।”

বলল আরেকজন।

শিখা নম্রহেসে বলল,

“আপনাদের ধারণা ও বিশ্বাসটা পুরোপুরি ভুল ও ভ্রান্ত। আমরা মানুষ। সৃষ্টির সেরা জীব। আল্লাহ আমাদের চোখ,কান,হাত,পা কেন দিয়েছেন? যেন দেখেশুনে চলতে পারি।জ্ঞান,বুদ্ধি,বিবেক কেন দিয়েছেন? যেন কারো ভুলকথায় আমরা পা না দিই। প্রভাবিত না হই। নিজের বিবেক,নীতি,জ্ঞান দিয়ে যেন ভালোমন্দ,সত্যমিথ্যা যাচাই করতে পারি।”

“সেইটা হইলে অন্যের জমিনরে তোমাগো কও ক্যান?”

“আমি শুনেছি এটাই। তাই বলেছি। এখন সত্যিটা শোনার পর আর বলব না। বরং যাদের জমি তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবো।”

তারা চমকিত চোখে শিখার দিকে চাইলো। এক আরেকজনের দিকে চোখাচোখি করে তাকালো। একজন শিখাকে বলল,

” তাইলে আসল কথা কই। আমি মনসুর। এই বিশ শতক জমিন তোমার স্বশুরগো না। আমাগো। আমার দাদার কেনা জমি। কিন্তু জোর কইরা তোমার দুই ভাসুর আসলাম,খালেদ দখল দিয়া রাখছে। আমরা মধ্যবিত্ত ঘরের মানুষ। হেগো জোরের লগে কুলাই না। দুই লাঠিয়াল গ্রুপের একদল তাদের দুই ভাইয়ের। আরেকদল আমাদের। তাও পারি না মা। তোমার কথা শুইনা মনে হইলো তুমি ভালো ঘরের মাইয়া। তাই কইলাম। তালুকদার সাহেবরে গিয়া আবার কইয়ো না। আমগো উপরে হামলা চালাইবো। এই যে, এই বাড়িটাই আমাগো। আইসো সুযোগ কইরা।

কিন্তু মা, তুমি একরত্তি মাইয়া। আবার এই উজানপুর গেরামের বধূ। মাইয়া হইলে তাও এককথা ছিলো। তুমি ক্যামনে এতবড় কাম করবা? যেইটা মামলা মোকদ্দমা কইরাও কেউ পারেনাই।”

শিখা তাদের বাড়ি চিনে রাখলো। নম্র হেসে বলল,

“আমার হাতে এগুলো কি? বই। আমি কলেজে পড়ি। দ্বাদশ শ্রেনীতে পড়ছি। বছর বাদেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবো। এই গ্রামে আর কোন বধূ এর আগে বিয়ের পরে পড়াশোনা করতে পেরেছে? কোন বধূ এমন রাস্তায় বের হতে পেরেছে?”

“নাতো। কই মনে পড়তাছে না।”

“তাহলে আপনাদের বুঝতে হবে এই বধূটার সাহস,শক্তি,জ্ঞান কতবেশী। সে নিশ্চয়ই পারবে আপনাদের জমি আপনাদের ফিরিয়ে দিতে। যেভাবেই হোক।”

তাদের সবার বিস্ময় ও মুগ্ধকর চাহনি শিখার মুখের উপর নিবদ্ধ হলো। কতগুলো পুরুষের পাশে একটা মেয়েকে দেখে আরো কয়েকজন বিভিন্ন বয়েসী মানুষ এগিয়ে এলো।

তখন আগেরজনদের একজন বলল,

“আলহামদুলিল্লাহ মা। তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হউক। তুমি মনে হয় তালুকদারের ছোট পোলার বউ। শহরে ব্যবসা করে যে?”

“জ্বি চাচা। আমি তালুকদারের ছোট ছেলে রাজের বউ। রাজবধূ।”

শিখা চঞ্চল পায়ে ক্ষেতের আল পেরিয়ে মেঠোপথে উঠে যায়। তারা সবাই বিস্মিত হলেও আনন্দিত হলো শিখাকে পেয়ে। নিজেকেরকে শক্তিশালী ভাবতে শুরু করলো শিখার প্রতিবাদী বলিষ্ঠ কণ্ঠ শুনে।

একদিন রাত বারোটার দিকে সুফিয়া কালো বোরকা পরে বেরিয়ে যায়। হাতে একটি বাজারের থলে। তার সঙ্গী হয় আদুরী। তিনরাস্তার মাথায় গিয়ে দাঁড়ায় সুফিয়া। আদুরি একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে নৈশপ্রহরীর মতো। চারদিকে শুনশান নিরবতা। পাশের ডোবা থেকে কানে ভেসে আসছে ব্যাঙের ডাক। সুফিয়া বিবি থলে হতে একটি কাস্তে বের করলো। মাটির মাঝে আধহাত সমান গভীর করে একটি গর্ত খুঁড়লো। তার ভিতরে কিছু জিনিস রাখলো। দিয়াশলাই জ্বালিয়ে সেগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিলো। জিনিসগুলো পুড়ে যাওয়া অবধি অপেক্ষা করতে লাগলো মা মেয়ে দুজন। তারপর চোরের মতো এদিক ওদিক চেয়ে চলে গেলো দুজন বাড়িতে।

বেলা বয়ে যায়। দিন ফুরাতে থাকে। কিন্তু সুফিয়া বিবির মনোবাসনা অপূর্ণ রয়ে যায়। সে কারণ খুঁজে পায় না। সারাদিন খিটখিটে মেজাজের আচরণ করে সবার সঙ্গে। রাজ্যহারা রাজার মতো পাংশুটে মুখে ঘোলাটে চোখে ইতি-উতি চায়। এমন এক বিকেলে শিখা তার সামনে আসে। আদুরীও ছিলো পাশে। শিখা নিজ থেকেই মধুর হেসে ঠান্ডা মেজাজে বলে,

“এভাবে ভেঙ্গে পড়বেন না মা। মানুষের মনের আশা আকাঙ্খা পূরণ করার অস্র উনার হাতে। উনি চায় না তাই আপনার ইচ্ছাও সফল না হয়ে বিফলে যাচ্ছে। বিয়ের পর পরেই পেঁপে পড়া দিয়ে মারতে চেয়েছেন কাউকে। হয় নি।

কিছুদিন আগে মসজিদে গিয়ে তার মৃত্যু কামনা করে পাঁচটি মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে এলেন। মোমবাতি জ্বলে গলে নিভে গেলো। কিন্তু তার জীবন প্রদীপ নিভে যায়নি।

কয়েকদিন আগে কাঁচা রাস্তার মোড়ে গভীর রাতে তারজন্য কবিরাজের পড়া তাবিজ গেঁড়ে রাখলেন। পুড়লেন আরো কিছু জিনিস। সে ওই পথ মাড়িয়ে বাইরে যায়। সাতদিন পা পড়লেই সে অক্কা পাবে। কিন্তু এর কিছুই হয় নি। কেন? কারণ রাখে আল্লাহ মারে কে?”

সুফিয়া ও আদুরীর কলিজা ধক করে উঠলো। হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার উপক্রম। তারা দুজন আতংকিত চোখে শিখার দিকে চাইলো।

শিখা রহস্যভরা হাসি ছড়িয়ে বলল,

“মনে শতেক প্রশ্ন,শতেক জিজ্ঞাসা? তাইতো? শেষবারেও কেন কার্যসিদ্ধি হলো না? কোথায় ভুল? শেষবারে নকল জিনিস পুড়িয়েছিলেন। তাহলে আসলগুলো কই গেলো? এইতো? এটা আমারো প্রশ্ন আপনাদের মা,মেয়ের মতো। সত্য জানার অপেক্ষায় আমিও।”

আদুরী ও সুফিয়া বিভ্রান্তি নিয়ে পাথর চোখে শিখার দিকে তাকিয়ে রইলো। এ যেন এক সত্যি সত্যি জ্বলন্ত অগ্নিশিখা। যেই কিনা সত্য,নিজের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সব তছনছ করে দিতে পারে। সঅব!

রাজবধূ ৫৬ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!