রাজবধূ পর্ব ৫১ (রেহানা পুতুল)

রাজবধূ ৫০ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

প্রকৃতিজুড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেই অন্ধকার মাড়িয়ে জুবায়ের এগিয়ে যায় বাড়ির সামনের পথে। লম্বা করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে। বিড়বিড়িয়ে বলে,

“আমি তোকে সব জানাবো রাজ। আমার ত কোন ভুল নেই। কোন অপরাধ নেই। বরং তুই আজন্ম ঋণী আমার কাছে। কিছু সত্য প্রকাশ করতেই হয়। তা যতই নির্মম হোক না কেন। আর শিখা তুমি কোথাও যাবে না। এই বাড়িতেই থাকবে। আমার নয়ন সম্মুক্ষে।”

রাজ দরজা আগলে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তার শাণিত চাহনি নিবদ্ধ শিখার পানে। মুখমণ্ডলজুড়ে অভিমান,দুঃখ,অনুযোগের তীব্র প্রলেপ। কিন্তু মুখে কিছুই বলছে না। শিখার কাণ্ডকীর্তি লক্ষ্য করাই যেন সেইমুহূর্তে তার একমাত্র কাজ।

শিখা কাঠের আলনা থেকে একে একে তার সব পরিধেয় পোশাক নামিয়ে নিলো বিছানার উপর। ভাঁজ করতে করতে ঘাড় বাঁকিয়ে সরু চোখে পিটপিট করে চাইলো রাজের পায়ের দিকে। সেও কোন কথা বলছে না।

“শিখা..”

“শুনছি।”

“সত্যিই চলে যাবে আমাকে ছেড়ে?”

“দেখতেই পাচ্ছেন।”

“যেওনা বলছি।”

রাজের কন্ঠস্বর ভার। ভেজা। করুণ!

শিখা সিদ্ধান্তে অটল,অবিচল! গোমড়া মুখে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো।

“যাবো বলছি। যাবই।”

রাজ দ্রুতবেগে পা ঘুরিয়ে চলে গেলো। একটুপর শিখার রুমের দরজায় আগমন ঘটলো তার স্বশুর জয়নুল তালুকদারের।

“বৌমা,তুমি সত্য সত্যই চইলা যাইবা এই বুড়া বাজানরে রাইখা?”

‘বাজান’ শব্দটা শুনে শিখা আপ্লুত হয়। তার হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠে। আজ যদি তার পিতা মকবুল বেঁচে থাকতো। এমন করেই কথা বলতো তার সঙ্গে। সেও বাজান বলে পিতার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তো। সেকি পারতো পিতার আবদার,চাওয়া অগ্রাহ্য করে পায়ে ঠেলে দিতে? কোনদিনও পারত না। শিখা বুঝতে পারলো, রাজ পিতাকে পাঠিয়ে তাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করছে। শিখা গোপনে রাজের উপর ক্ষোভ ঝাড়লো। কেন তাকে বিয়ে করলো সে। কেন?

“বিফ্রকেস গোছানো বন্ধ করো বউ।”

“বাবা,আমার মনটা হুহু করছে আম্মার জন্য। এখানে মন বসছে না আর। আমাকে মাফ করবেন। বাধা দিবেন না দয়া করে। এই বাড়িতে আমাকে কেউ ভালোবাসে না আপনারা বাবা, ছেলে ছাড়া। মাঝে মাঝে মনে হয় আপনাদের পরিবারে আমি অনাহুতের মতো পড়ে আছি।”

ক্ষোভ ঝরানো কণ্ঠে বলল শিখা।

তালুকদার সংকোচপূর্ণ গলায় দরদ মেখে বললেন,

“এভাবে বইলা নিজেরে খাটো কইরো না নিজের কাছে। তুমি সসম্মানে এই ঘরের বউ হইয়া আইছো। নিজগুণে আর বুদ্ধি দিয়া সব ঠিক কইরা নিতে পাইরবা। রাজ বুইঝা শুইনাই তোমারে এত বড় দায়িত্ব দিছে। এইটা কি তোমার কম গৌরবের? মন যেহেতু ছুইটা গ্যাছে। তোমার মায়ের কাছে যাইয়া বেড়াইয়া আসো দুইদিন। রাজ চইলা গ্যালে বেশিদিন থাইকো মন চাইলে। কাপড়গুলান আলনায় উঠায়া রাখো আবার।”

শিখা পিতার সমতুল্য স্বশুরের আদেশকে সম্মান করলো। আলনায় সব রাখতে রাখতে বলল,

“ঠিক আছে বাবা। তাহলে কাল আমি কলেজ থেকেই আমাদের বাড়ি চলে যাবো।”

“আচ্ছা। যাইও।”

তালুকদার চলে যায়। দোতলায় গিয়ে রাজকে জানিয়ে আসে। তবুও রাজের অভিমান, অনুযোগ সরে না শিখার উপর থেকে। কি করে শিখা তাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারে। রাতে সে শিখাকে কিছু বলবে।

ঘরের পরিবেশ গুমোট। বিভীষিকাময়। নিকষ কালো আঁধারের মতো। আদুরী সেদিন হতে রুম থেকে তেমন বের হয় না। কুনোব্যাঙের ন্যায় রুমের কোণায় চেপেচুপে থাকে। সময় ও পরিস্থিতি তার দম্ভ,অহমিকা এক লহমায় চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে। তালুকদার কন্যা হয়ে, শিখার মতো এক অসহায়,নিরীহ মেয়ের সামনে সে অচল পয়সায় মতো পড়ে আছে যেনো। আর শিখা যেন ক্রমশ প্রজ্বলিত হয়ে উঠছে তালুকদার পরিবারে। অথচ সারাবাড়ি দাপিয়ে মায়ের পরে সেই কর্তৃত্ব ফলাতো সবকিছুতে। ভেবেই ঘৃণায়,হিংসায় আদুরীর অন্তরটা রি রি করে উঠলো শিখার প্রতি। তাদের পরিবারে শিখা একটা বিষকাঁটা। উপড়ে ফেলতে পারলে তার অশান্ত মন কিছুটা হলেও শান্ত হতো। আজ বৈঠকখানায়ও সে অনুপুস্থিত ছিলো। তাকে কেউই ডাকেনি। রাজ তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে।

রাতে সবাই টেবিলে খেতে বসলো। শিখা খেতে আসেনি। তালুকদার জিজ্ঞেস করলো মতির মাকে,

“বউরে ডাকো। খাইব না?”

“ডাকছি মিয়াভাই। কইলো ক্ষুধা নাই। খাইবো না।”

রাজ নিজের ভাতের প্লেট নিয়ে শিখার রুমে চলে গেলো। জুবায়ের ট্যারা চোখে রাজের চলে যাওয়া দেখলো স্থির চোখে। সুফিয়া বিবি ছোট জা আমেনার কনুইতে গুঁতো মেরে বলল,

“দেখলি তো পোলার বেদিশাগিরি? এমন ভাব দেখাইলো। মনে হয় তার বউরে আমরা দিনের পর দিন ভুখা রাখছি। এরেই কয় কলির কাল। একবেলা ভাত না খাইলে মানুষ মরে?”

“তোমার বেলাওতো এমন হইছে। আমি তোমারে রুমে ভাত নিয়া খাওয়াই দিতাম।”

বলল তালুকদার।

” পুরানা কথা তুইলা কি বুঝাইতে চান আপনে?”

ভ্রকুটি বলল সুফিয়া।

পাশের চেয়ারে জুবায়ের ভাত খেতে খেতে মুচকি হাসলো।

রাজ শিখার মুখের সামনে ভাতের প্লেট ধরে বলল,

“ভাত খেয়ে নাও। তারপর যা করার করো।”

“ক্ষুধা নেই। খাব না।”

” তাহলে তোমার পেটে হাত দিয়ে দেখি। ক্ষুধা না লাগার কারণ উদঘাটন করতে হবে।”

রাজ শিখার পেটে হাত দিতে গেলে শিখা কটমট চোখে তাকায়। রাজ হাত থামিয়ে বলে,

“তার মানে ভুয়া কথা বলছ। ক্ষুধা আছে। ভীষণ ক্ষুধা। তোমার পাকস্থলীতে খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। নয়তো তোমার মন উত্তেজিত হতেই থাকবে। হতেই থাকবে। অল্প এনেছি। হা করো। খাইয়ে দিই।”

“আমি কারো হাতে খাই না। আমার হাত আছে।”

নাকের ফাটা ফুলিয়ে বলল শিখা।

রাজ খানিক অপমানিতবোধ করলো। প্লেট রেখে বেরিয়ে গেলো। টেবিলে গিয়ে অন্য প্লেটে ভাত নিয়ে খেয়ে নিলো। শিখা অনেকক্ষণ পর রাজের রেখে আসা প্লেটের ভাত সব খেয়ে নিলো। কেননা ক্ষুধায় পেট চনমনিয়ে উঠেছে। আর থাকতে পারছিল না। ক্ষুধার কাছে ধরাশায়ী হলো অভিমান ও ক্ষোভ।

রাতে শিখা দোতলায় রাজের রুমে গেল না। নিচতলায় নিজের রুমে ঘুমিয়ে গেলো। শিখার অনুপুস্থিতি রাজকে বিনিদ্র রজনী উপহার দিলো। তবুও সে শিখাকে জোর করল না নিচে এসে। স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে গেলে সবসময় সুফল বয়ে আসে না। হীতে বিপরীত হওয়ার আশংকা থাকে। এমনিতেই শিখার উপর কৃতজ্ঞতায় তার মাথা নুইয়ে আসে। শিখা তার পরিবারের কারো বিরুদ্ধেই তার কাছে অভিযোগ করেনি কখনো। অথচ দুটো বছর ধরে নিজে সয়ে গিয়েছে নিরবে। একেই বলে পারিবারিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ। শিখার চিন্তাচেতনা আসলেই উচ্চমানের।

সকালে শিখা ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে দোতলায় গেলো। চাপানো দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো। দেখলো রাজ খালি গায়ে উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে। জানালার ফাঁক গলিয়ে রাজের পিঠের উপর রোদ এসে ঠিকরে পড়ছে। শিখা জানালার পর্দা টেনে ছায়া করে দিলো রাজের পিঠের উপর। পালংকের একপাশে বসলো। রাজের পিঠে আলতো করে হাত রাখলো। রাজ শিখার অস্তিত্ব অনুভব করতেই উপুড় থেকে চিৎ হয়ে গেলো। চোখ দুটো নেশাখোরের মতো লাভ আভায় চেয়ে আছে। শিখার দিকে চেয়ে আছে ধ্যানমগ্ন ঋষির ন্যায়।

শিখা মোলায়েম গলায় বলল,

“আর দেখেন নি আমাকে?”

“দেখেছি। কিন্তু বদলে যাওয়া এই রূপ দেখিনি।”

পুঞ্জিভূত বেদনা নিয়ে বলল রাজ।

শিখা আলতো হাসলো। বলল,

“বুঝিনি?”

“তুমি আমার ধারণার চেয়েও আমাকে কম ভালোবাসো। নইলে কিভাবে উচ্চারণ করতে পারলে আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা? কিভাবে পারলে আমাকে ছাড়া একা বিছানায় ঘুমাতে? তুমি নিষ্ঠুর নারী।”

“মানলাম বিনাতর্কেই।”

শিখার অকপট স্বীকারোক্তি।

“শখের নারী কেন এত নিষ্ঠুর হয়? কেন এত জ্বালাময়ী হয়? বলতে পারো?”

শিখা প্রসঙ্গ পাল্টায়।

“দরজা,জানালা বন্ধ না করেই ঘুমিয়েছিলেন? যদি চোর আসতো?”

“চোর চুরি করার মতো অবশিষ্ট কিছুই নেই আমার কাছে। সবচেয়ে দামী জিনিস তুমি চুরি করে বসে আছো।”

“মাত্র একনিশি আলাদা ছিলাম। তাতেই আপনার এই ছন্নছাড়া অবস্থা? রুমের দরজা লাগান নি। জানালা খোলা ছিলো। পর্দা ফাঁকা ছিলো। মশারী খাটান নি। পিঠে কতগুলো মৃত মশার র*ক্ত। পানির গ্লাসের উপরে ঢাকনা নেই। আপনার চোখমুখ দেখে মনে হয় নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন।”

রাজ নিজের মাথাটাকে ঘুরিয়ে শিখার কোলের মাঝে নিয়ে নিলো। শিখা বিষম খেলো।

“কি হেয়ালামো করছেন? সরুন।”

“ভালোলাগছে খুব। সরব না। এবার উপলব্ধি করো শিখা,তুমি ছাড়া এক রাতে আমার এই নাস্তানাবুদ দশা। তাহলে কয়েকদিন হলে আমার কি হবে?”

ব্যথিত গলায় বলল রাজ।

“বুঝলাম। আচ্ছা করে বুঝলাম। নাস্তা করবেন না? আমি কলেজ থেকে আমাদের বাড়ি যাবো।”

” কলেজ থেকে যাবে কেন? বাড়ি থেকে যাও। আমিসহ যাবো।”

“আপনি কাল যাবেন মন চাইলে। আমি ওভাবেই যাবো।”

“শিখা,আমার পরিবারের সবার পক্ষ হতে আমি তোমাকে সরি বলছি। খুব সরি। মনে কষ্ট পুষে রেখ না।”

ধরা গলায় বলল রাজ।

“আপনাকে বিমর্ষ লাগছে। কিন্তু কেন? আমি আলাদা ঘুমালাম বলে?”

রাজ উঠে বসলো। শিখাকে শক্ত করে নিজের বুকের সঙ্গে মিশে নিলো। আর্তির স্বরে বলল,

“সেটার জন্য নয় প্রজাপ্রতি। কাল বৈঠকখানায় বলা তোমার একটি বাক্য আমাকে অসীম বেদনা দিয়েছে। কিভাবে বলতে পারলে তোমার স্থানে অন্য কেউ হলে ছেড়ে চলে যেতো?”

শিখা রাজের বুকে লেপ্টে থেকেই আহ্লাদী গলায় বললো,

“আমিতো উদাহরণ দিয়েছি মাত্র। আমি যাব ত বলিনি ফড়িং ভাই।”

রাজ, শিখার মুখকে তার বুক থেকে আলগা করে নিলো। শিখার চিবুক ধরে আকুল কণ্ঠে বলল,

“তুমি এই মূহুর্তে আমাকে ছুঁয়ে কথা একটা কথা দিতে পারবে?”

“একটা কথা নয় শুধু। হাজারটা কথা দিতে পারি আমি আপনাকে ছুঁয়ে।”

রাজকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল শিখা।

“তাহলে কথা দাও,কোনদিন তুমি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা মুখেও আনবে না।”

“জীবনেও না। মরণেও না। লাল শাড়ি পরে আপনার জীবনে এসেছি। সাদা কাফন পরে আপনার জীবন থেকে বিদায় নিবো। তার আগে নয়।”

“ওহ মাই বাটারফ্লাই। আই লাভ ইউ। আমার তো প্রাণ থাকতে তোমাকে ছাড়া বাঁচা সম্ভব নয়।”

বলে রাজ তার উষ্ণ ঠোঁটের ঘনিষ্ঠ আলিঙ্গনে শিখার সারাগাল ভিজিয়ে দিলো।

শিখা বলল,

” নিচে যাই। একটু লিখা আছে। নাস্তা করবেন না?”

“নাহ। তুমি যাও। আমি পরে খাবো। এখন ঘুমাবো একটু।”

রাজ আলস্য ভঙ্গিতে হাত পা ছড়িয়ে আবার উপুড় হয়ে রয় পালংকের মাঝ বরাবর। রাজের স্পর্শে,কথায়,শিখার অভিমান ও ক্ষোভ উবে যায়। একইভাবে রাজেরও।

শিখা নিচে গিয়ে নিদিষ্ট সময়ে তার কলেজে চলে যায়। সেখান থেকে চলে যায় মধুপুর গ্রামে নিজের বাড়িতে। কিনে নেয় মায়ের পছন্দের খাবার। নূরী মেয়েকে দেখে আবেগী হয়ে উঠে। কিছুটা অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করে,

“কিরে মা,কোন সমস্যা? কলেজ থেইকা আইসা পড়লি যে? জামাই চইলা গ্যাছে? ”

শিখা মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করে বলে,

“কোন সমস্যা নেই আম্মা। তোমাকে দেখতে মন চাচ্ছে। তাই চলে আসলাম।”

নূরীর চমকিত চাহনি দেখে শিখা বলল,

“উনি চায় শুদ্ধ ভাষায় কথা বলি। এবার বুঝলে আম্মাজান?”

“বুঝলাম। পোটলায় কি?”

“তোমার প্রিয় মোরব্বার কেক,স্পঞ্জ রসগোল্লা আর আঙুর ফল। আম্মা কাল চলো না, আলো আপারে দেখতে যাবো।”

“আইচ্ছা যামুনি।”

নূরীর নয়ন ভিজে যায়। সঙ্গে মেয়েরও। সৃষ্টি হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মধুরক্ষণ।

“আম্মা তোমার শরীর খারাপ? কেমন শুকনো লাগছে তোমাকে?”

“তেমন কিছু না। একটু সর্দি,কাশি হইছিলো।”

নূরী শারীরিক অসুস্থতার কথা জানালো মেয়েকে। কিন্তু মানসিক অসুস্থতার কথা গোপন করে গেলো সুকৌশলে। তাকে বিয়ে করতে চাওয়া সেই মেম্বার এই ভিতরে ভারি উৎপাত করেছে রাতের প্রহরি চৌকিদারকে পাঠিয়ে। এবং নিজে স্বশরীরে এসেও। নূরীকে ইউনিয়নের মেম্বার বানাবে এই লোভনীয় প্রস্তাবের প্ররোচনাও কম দেয়নি। নূরীর খুব কাঠখড় পোহাতে হয়েছে সেই মেম্বারকে দমন করতে গিয়ে। চেয়ারম্যানকে ও গ্রামের প্রধান দুজন ব্যক্তিকেও জানাতে হয়েছে তার।

সেদিন রাতে জুবায়েরের রুমে যায় রাজ।

“কিরে, আয়। বোস।”

“তোর নিঃসঙ্গতার গল্প শুনতে এলাম? বল?”

“বলব বলছি, বলবো। এত তাড়া কিসের?”

“তাড়া আছে শালা। তোকে বিয়ে করাবো জোর করে। নয়তো তোর নজর লাগবে আমার আর শিখার উপর।”

“নজর? কিভাবে? আমি ফকির নাকি?”

ধুম করে হেসে ফেলে বলল রাজ।

“ফকির মানে? তুই বড় ফকির। দেখস না, মানুষ কিছু খাওয়ার সময় দরজায় ফকির এলে, দরজা চাপিয়ে দেয় যেন ফকির খাওয়া না দেখে, আর নজর না লাগে। কারণ সেই ফকির নিঃশ্ব,ক্ষুধার্ত! তো আমাদের দুজনের খুনসুটি, দুষ্টামি, ফাজলামি,প্রেম,ভালোবাসা দেখলে ত তোরও বদনজর লাগবে।”

জুবায়ের ভাবুকের মতো ক্ষণসময় মৌন রইলো। অবশেষে রাজের উরুতে হাত রেখে বলল,

“বুঝলাম এবার। এভাবে চিন্তা করিনি। যেন আমার ক্ষুধার্ত হৃদয়ের বদ নজর যেন তোদের উপর না লাগে,সেই ব্যবস্থা করবো।”

“তার মানে বিয়ে করছিস তুই?”

উৎসুক চোখে জানতে চাইলো রাজ।

“নাহ। ভিন্ন উপায় অবলম্বন করবো।”

” যথা?”

“যথা সময় হলেই দেখবি।”

” কি ভুলভাল বলছিস। নিয়ন্ত্রণ কর আবেগকে। নয়তো মরবি তুই।”

রাজ বেরিয়ে যায়। জুবায়ের রাজের দিকে চেয়ে গোপনে বলে উঠে,

” মরেই ত যাচ্ছি রোজ। আমার ছায়াও তোদের সামনে পড়বে না আর। দেখিস।”

রাতে সবাই খেতে বসলো। সুফিয়া বিবি সবাইকে শুনিয়ে জুবায়েরের উদ্দেশ্যে বলল ,

“জুবায়েরের লগে আমার বোনজি লিমারে বেশ মানাইবো। কি কস আমেনা?”

“বড়মা, আমি সেদিন বৈঠকখানায় কি বলেছি বিয়ে করা নিয়ে, আপনি শুনেন নি?”

“হুনছি ত। কি হইছে? তুই কি হাঁচাই আর বিয়া করবি না?”

“আপাতত নাহ। যখন মন চাইবে আমিই করবো।কেউ করাতে হবে না।”

শিখা মায়ের কাছে দুইদিন বেড়ানো শেষে একাই চলে এলো স্বশুরবাড়ি। সে ভেবেছে রাজ যাবে। কিন্তু বাড়িতে কাজের ব্যস্ততার জন্য রাজ চাইলেও যেতে পারেনি।

এক দুপুরে রাজের একমাত্র ফুফু জাহানারা এলো তাদের বাড়িতে। এসেই সে হট্রগোল শুরু করে দিলো শিখার উদ্দেশ্য। রাজ নিচে নেমে এলো। তার বাবাও ছিলো। সবাই জড়ো হলো। শিখা এলো। জাহানারা শিখার সামনে তেড়ে এসে মারমুখী ভঙ্গিতে বলল,

“নিচতলার মানুষ হইয়া উপর তলায় উইঠা গ্যালি। এখন আবার নিজের বান্ধবীরে আমার পোলার পিছনে লেলাইয়া দিলি। তোর উস্কানি না পাইলে ক্যামনে হেই মাইয়া লাইন মারে সীমান্তের লগে? আমি হুঁশিয়ার কইরা দিতাছি তোরে। হেই মাইয়ারে সীমান্তের পথ থেইকা সরাইয়া নিবি। নইলে আমি তোগো মা,মাইয়ারে দেইখা নিমু। আমি তালুকদার বাড়ির বেটি। হুইনা রাখ।”

রাজসহ সবাই হতভম্ব হয়ে গেলো জাহানারার কথা শুনে। রাজ বিরক্ত স্বরে বলল,

“ফুফু এভাবে কথা বলছেন কেন শিখার সঙ্গে? এসব বিষয়ে কেউ কাউকে লেলিয়ে দিতে হয় না। এমনিই হয়ে যায় ভালোলাগা থেকে। আমি সব শুনে নিচ্ছি শিখার সঙ্গে।”

রাজের কথা কেড়ে নিয়ে গজগজ স্বরে জাহানারা বলল,

“তোর বউরে সামলা কইলাম। নয়তো একদিন তুই নিজেই পস্তাইবি। খুব বাইড়া যাইতাছে তোর প্রশ্রয়ে। আমার কানে কমবেশি সব কথা যায়।”

জাহানারা একদণ্ড জিরোলো না। বসল না। শিখার উপর বিপুল বিতৃষ্ণা ও রা* গ নিয়ে বাবার বাড়ির প্রাঙ্গণ ছাড়লো।

শিখাও তেতে গেলো গোপনে। অযথাই তাকে দশকথা শুনালো ফুফু শাশুড়ী। সেও তালুকদার বাড়ির পুত্রবধূ। রাজবধূ। তার সই কুসুম ও সীমান্তের ভালোবাসার সুখকর পরিনতি দেখেই ছাড়বে সে।

জাহানারা চলে গেলে সবাই হইচই শুরু করে দিলো বিষয়টা নিয়ে। নানান মুখরোচক কথার ফুলঝুরি সাজাতে লাগলো সবাই।

রাজ সবার সামনে শিখাকে কিছু জিজ্ঞেস করলো না। গম্ভীর চোখে আদেশ করে বলল,

“শিখা, দোতলায় আসো জলদি।”

শিখা অফুরন্ত সাহস নিয়ে রাজের পিছু পিছু সিঁড়ি ডিঙিয়ে উপরে উঠে গেলো। তার মাঝে কোন ভীরুতা নেই। আড়ষ্টতা নেই। নেই কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব। কেবল আছে শক্তিশালী হয়ে ঘুরে দাঁড়াবার প্রত্যয়।

রাজবধূ ৫২ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!