রাজবধূ পর্ব ৪৯ (রেহানা পুতুল)

রাজবধূ ৪৮ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

শিখা কলেজ থেকে এসে মাত্রই ঘরের দাওয়ায় পা রাখলো। ঘরের ভিতর হতে রাজের ক্ষিপ্ত কণ্ঠস্বর শুনে সে কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেলো। নিশ্চয়ই তাকে নিয়ে নতুন কোন সংঘর্ষ বেঁধেছে। শিখা তার বই খাতাকে বুকে চেপে ধরে,পা টিপে টিপে তার রুমে প্রবেশ করলো।

টের পেলো আদুরীর রুমের ভিতরে রাজ এবং অন্যরা অবস্থান করছে। শিখা বই রেখে বেরিয়ে যায় পিছনের আঙিনায়। পুকুরঘাটে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নেয়। রান্নাঘরে গিয়ে ভাত খেয়ে উঠে। মতির মাকে জিজ্ঞেস করেও সঠিক তথ্য জানতে পারেনি। নিজের রুমে এসে সে শান্তভাবে বসে রইলো। তবে কান পেতে রইলো আদুরির রুমের দিকে।

আদুরিকে একাধিক প্রশ্ন করেও কোন সদুত্তর পেল না রাজ ও তার মা। রাজের রক্তচক্ষু চাহনিতে আদুরী নিচু মাথায় মরা কণ্ঠে বলল,

“বড় ভাবি সব জানে।”

রাজ মায়ের দিকে তাকালো। চোখের ইঙ্গিতে বোঝালো তার শুনে আসা কথাগুলো সত্যি। তারা অহেতুক আদুরীর নামে দুর্নাম রটায়নি। সে রানীকে খুঁজে আদুরীর রুমে ডেকে আনলো। জিজ্ঞেস করলো,

“কে শোয়েব?”

রানি বলতে বাধ্য হলো রাজের হুমকির তোড়ে। শুনে রাজ বলল,

“এগুলোত শেষ বিয়ের আগেই। তাহলেতো তারা কিভাবে এখন এসব জানে? বাচ্চার বিষয়?”

রানী বলল,

“আদুরী স্বশুর বাড়ি থেইকা মিছা কথা বইলা বাইরে গেছিলো শোয়েবের লগে দেখা করতে। এইটা কেউ দেইখা তার জামাইরে জানাইলো। আবার তার শরীরের মইধ্যে বাচ্চা হওনের দাগ দেখছিলো তার জামাই। সে অস্বীকার করছিলো সব। তবুও তার জামাই বিশ্বাস করেনাই। এইজন্য তালাক দিয়া দিলো।”

রাজ বলল,

“তারা ভালো, ভদ্র পরিবার বলেই কোন ঝামেলা করেনি। আমাদের বাড়ি এসে অপমান করেনি। পুরো পাড়া করেনি। শুধু ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে চুপচাপভাবে। আর তুমিওতো সমান দোষী। কারণ তুমি আদুরীর এসবকে প্রশ্রয় দিয়েছো। আমাদের জানাওনি। শাস্তি তোমারো পাওনা। এখন আর দ্বিতীয় বিয়ে হবে কোনদিন? না সেই শোয়েব বিয়ে করবে তাকে?”

রানী অপরাধীর ভঙ্গিতে বসে রইলো। সুফিয়া কপাল চাপড়াতে লাগলেন পালংকের কোনায় বসে। আদুরী বিড়ালের মতো মিনমিনে স্বরে বলল,

“উনিতো বিয়ে করতে চাইছে৷ আমাদের পরিবারের নিয়মের জন্যইতো আমি তারে মানা করছি। নইলে কি আর এসব হয়?”

রাজ উত্তেজিত হয়ে উঠে। প্যান্টের বেল্ট খুলে আদুরীকে প্রহার করতে করতে বলে,

“আমাদের পরিবারে যেহেতু নিয়ম, কোন রিলেশনে জড়ানো যাবে না। তাহলে কেন এমন অনৈতিক সম্পর্কে জড়ালি? কেন একটা নিষ্পাপ ভ্রুণ হত্যা করতে বাধ্য হলি? আমি শহরে থাকি। চাইলে রিলেশন করে বিয়ে করতে পারতাম না? বাড়িতে কেউ জানতো আমি না শুনালে? আমার পিছনে ত মেয়েদের সিরিয়াল এখনো। কেন বাবার পছন্দে একটা গ্রামের মেয়েকে বিয়ে করলাম? পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই ত। আর তুই মেয়ে হয়ে কি নোংরা কাজ করলি? ঘরের সবাই কি মরে থাকে? খেয়াল ছিল না তোর দিকে?”

আদুরী আহ! উহু! মাগো বলে চিৎকার করে কেঁদে যাচ্ছে। সুফিয়া রাজকে অনুরোধ করেও থামাতে পারছে না। আমেনা,হারিছা,সুমনা, রানী,ডলি,মতির মা এসেও রাজকে থামাকে পারছে না। শিখা আদুরীর কান্না ও রাজের গর্জন শুনতে পাচ্ছে। সে আর থাকতে পারল না। আদুরীর শারিরীক যন্ত্রণার আর্তচিৎকারে তার কোমল অন্তরটা হু হু করে উঠলো। সে তৎক্ষনাৎ ছুটে গেলো।

আদুরীর রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে অনুনয় করে রাজকে বলল,

“আল্লাহর ওয়াস্তে থামেন এবার। আর মারবেন না আপাকে।”

রাজের হাত থেমে গেলো তার শিখার মধুর গলা শুনে। সে তীব্র চোখে শিখার শীতল চাহনিতে তাকালো। এই একটি নারীর সামনে রাজ নুইয়ে যায়। আগে এমন হতো তার মায়ের সামনে। কিন্তু শিখাকে বিয়ে করা নিয়ে তার প্রতি মায়ের বিরূপ আচরণের দরুণ, সেই শ্রদ্ধায় ও গুরুত্বে ঘাটতি এসে গিয়েছে অনেকখানি।

শিখা রাজের সামনে গিয়ে আদুরীকে ঝাপটে ধরলো রক্ষা করার নিমিত্তে। রাজ তার প্যান্টের বেল্ট পরতে পরতে রুম হতে প্রস্থান নিলো। বাকি সবাই শিখার দিকে বিস্ময়ের চাহনি নিক্ষেপ করলো। তালুকদার পারিবারে যেন অলৌকিক কিছু ঘটে গেলো। তারা এতক্ষণ যা পারলো না,তা শিখার এক বাক্যে ঘটে গেলো? আদুরী শিখাকে খুব অপছন্দ করে। একটিবারের জন্যও ভালো ব্যবহার করেনি শিখার সঙ্গে। তা জানা সত্ত্বেও শিখা আদুরীকে বাঁচালো রাজের হাত থেকে? প্রশ্নগুলো তাদের সবার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে সাইক্লোনের মতো।

আদুরী নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে রইলো। শিখা সবার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলো,

“কি হয়েছে? হঠাৎ উনি বিবাহিত বোনের গায়ে এভাবে হাত তুলল কেন? সমস্যা থাকলে সমাধান অবশ্যই আছে।”

রানী সব বলল শিখাকে। শিখা আশ্চর্য হয়ে গেলো শুনে। এতসব কিছু কখন কিভাবে হলো? অবশ্য সেতো এই বাড়িতে থাকা শুরু করলো মাত্র দু’মাস হলো। তালুকদার বাজার থেকে বাড়িতে এলো। সবকিছু তাকেও জানানো হলো। তিনি কিছুই বলার মতো বোধশক্তি পেলেন না। পরাজিত সৈনিকের মতো পরিশ্রান্ত মুখে নিজের কক্ষে গিয়ে শুয়ে পড়লেন।

রাতে শিখা কিছুটা শংকিত মনে দোতলায় গেলো। রুমে ঢুকে দরজায় খিল লাগিয়ে দিলো। রাজ পালংকে শোয়া থেকেই ভরাট গলায় বলল,

“এত দেরী করলে কেন আজ?”

“আমিতো ভাবছি আজ আসবই না। নিচেই ঘুমাবো।”

বিছানায় উঠে শুয়ে গিয়ে বলল শিখা।

“কারণ?”

“আপনার যেই জেদ দেখলাম। বাপসরে বাপ। কখন না জানি সামান্য ভুল হলে আমার গায়ে হাত তোলেন।”

রাজ ইতস্ততবোধ করলো। তবুও বলল,

” আমি সহজে রা*গি*না। আর রা*গলে সহজে থামিনা।”

সেই সঙ্গে শিখা তাল মিলিয়ে বলল,

“আমি অল্পতেই রেগে যাই। অল্পতেই থেমে যাই।”

“তোমার রা*গ দেখার অপেক্ষায় রইলাম।”

শিখা হেসে উঠলো। রাজ শিখার কোমরে হাত দিয়ে নিজের দিকে ভিড়িয়ে নিলো। বলল,

“আমি উত্তপ্ত। ঠান্ডা করো তোমার নিবিড় প্রণয়ে।”

“আমি এসব পারি না।”

“আর কতদিন গেলে তুমি নিজ থেকে সব উজাড় করে দিবে?”

“কখনোই না।”

“তাহলে আমি সেই নিষ্ঠুর কাঠুরিয়ার মতো তোমার অরণ্য হতে সব উজাড় করে ফেলবো। আপত্তি করতে পারবে না।”

“আমি বনের মালিক। অনুমতি না নিয়ে আবাদ করতে এলে শুধু আপত্তি নয়,হামলে পড়বো।”

“কিভাবে?”

“কেন? আমার কাছে অস্র নেই? আমার তীক্ষ্ণ দাঁত,ধারালো নখ এসবই যথেষ্ট।”

রাজ হোঃহোঃহোঃ করে ঘর কাঁপিয়ে অট্রহাসিতে ফেটে পড়লো। বলল,

“তো টেস্ট হয়ে যাক। দেখি কতটা পারো নিজের বিশাল অরণ্যের দামী বৃক্ষরাজিকে রক্ষা করতে?”

শিখা রাজের খালি গায়ে খামচি দিতে লাগলো বিক্ষিপ্তভাবে। কামড় দিতে লাগলো রাজের হাতের মাঝে। রাজ উঁহু করে উঠলো মৃদু স্বরে। শিখাকে নিজের বাহুবন্ধী করে বলল,

” জামাইকে বউ ব্যথা দেয় দুষ্ট? একই কাজ যদি আমি শুরু করি, স্থির থাকতে পারবে? দিবো নাকি আমার প্রিয় স্থানে একটা আবেশী কামড়? যেটায় তুমি কষ্ট না পেয়ে সুখ পাবে। শিহরণ জাগবে তোমার প্রতি অঙ্গের গোপনে গোপনে।”

শিখা লজ্জাবনত মুখটি লুকিয়ে ফেলল বালিশের মাঝে। রাজ শিখার ঘাড়ের উপর ভারি নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

“বেশী করে খাওয়া দাওয়া করবে। এখনো সরু বাঁশের কঞ্চি হয়ে আছো। আমার মন ভরে না। একটু নাদুস নুদুস হও। এতে দুজনেই আরাম পাবো।”

নিশি বাড়ে। প্রভাত আসে। প্রভাত পেরিয়ে ভোর। শিখা উঠে যায়। গোসল সেরে নেয়। কলেজে চলে যায় সময় হলে। সেদিন বিকেলে শিখা কলেজ থেকে বেরিয়ে মাঠ পার হতেই দেখলো জুবায়ের দাঁড়িয়ে আছে। শিখা এগিয়ে এসেই,

“আরেহ জুবায়ের ভাই? হঠাৎ আপনি?”

জুবায়ের পকেট হতে সেই চিরকুটটি বের করে নিলো। শিখার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল,

“এই হাতের লিখা কি তোমার?”

শিখা চিরকুটের লিখাটি পড়ে খিলখিলিয়ে হেসে ফেলল। জুবায়ের গম্ভীর চোখে শিখার মুখপানে চেয়ে রইলো।

শিখা বলল,

“আমার খালাতো ননদ লিমা আপনাকে অনেক পছন্দ করে। তার হাতের লিখা সুন্দর না বলে আমাকে বার-বার অনুরোধ করাতে লিখে দিলাম। আমি কত করে লিমাকে বললাম,

আমার হাতের লিখা বুঝতে পারলে জুবায়ের ভাই রেগে যাবে। মনে করবে আমিই দিয়েছি। সে বলল,

ভাবি তুমি একলা না। দোকলা। জুবা ভাই কোন দুঃখে তোমাকে ভাববে? এবার বুঝলেন বিষয়?”

“এরপর আর কোনদিন লিমা বা কারো হয়ে কিছু লিখবে না আমার কাছে। শধু তোমার কথাই তোমার হাতে লিখবে আমার কাছে।”

ভারকণ্ঠে আদেশের সুরে বলল জুবায়ের।

“বুঝিনি?”

“ধরো,রাজ নেই বাড়িতে। তোমার কোন প্রয়োজন আমার কাছে। তখন সামনে বলতে না পারলে এমন লিখে দিবে। এবার বুঝলে শিখা?”

“ওহ! বুঝছি ভালো করেই।

বলে শিখা ফের রিনিরিনিয়ে হেসে ফেলল। শিখার হাসি জুবায়েরের বুকের চিলেকোঠায় সেতারের বীণার মতো ঝংকার তুললো। সে শিখার দিকে চেয়ে স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করলো,

“তোমাকে আজকাল বেশ আমুদে,ফুরফুরে দেখা যাচ্ছে। বর কাছে আছে বলে?”

“হুম।” বলে শিখা মুচকি হাসলো। বলল,

“আপনার বিয়ে খাওয়ার আমার খুব শখ। লিমাকে বিয়ে করেন না। ও দারুন মেয়ে। আমার ওকে ভালোলাগে।”

“আমারো একটা শখ ছিলো। সেই শখের পরিমাপ সমুদ্রের মতই গভীর ছিলো। আকাশের মতই বিশাল ছিলো। প্রকৃতির মতই উদার ছিলো। রঙধনুর মতই রঙিন ছিলো। সোনার মতই খাঁটি ছিলো। পাহাড়ের মতই মজবুত ছিলো। রোদ্দুরের মতই ঝলমলে ছিলো। সূর্যের তাপের মতই প্রখর ছিলো।

তবুও তাকে পাইনি। শখও পূরণ হয়নি। তাই তোমার এই ক্ষুদ্র শখও কোনদিন পূরণ হবে না। লিমা নয়, কাউকেই বিয়ে করবে না এই জুবায়ের।”

ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে কথাগুলো বলল জুবায়ের।

“আপনার মাথার তার সব ছিঁড়া। নইলে কেউ জীবন নিয়ে এমন তামাসার সিদ্ধান্ত নেয়?”

“হ্যাঁ সব ছিঁড়া। দায়িত্ব নিয়ে ঠিক করতে পারবে তুমি?”

“আমি কেন করবো? যে আপনার বউ হবে। সেই একটা একটা করে জোড়া দিয়ে ঠিক করে দিবে।”

“বিয়ে করব না। বউ নেই। তুমি আছো চোখের সামনে। একই পরিবারের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব তোমার উপরে কিছুটা হলেও বর্তায়। নিবে ছেঁড়া তার জোড়া দেওয়ার দায়িত্ব?”

ঠাস ঠাস করে শিখার চোখে চোখ রেখে বলল জুবায়ের।

“আমি দিলে হবে? আজব কথাবার্তা বলেন জুবায়ের ভাই?”

“যদি বলি হবে, বিশ্বাস করবে তুমি? করবে শিখা?”

বিষাদ কণ্ঠে বাক্যটি বলেই লম্বা লম্বা পা ফেলে সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত মাঠ পেরিয়ে গেলো জুবায়ের। শিখা পিছন পিছন জুবায়ের ভাই বলে এগিয়ে গেলো। তবুও জুবায়ের শুনল না। নিজের বাইকে চড়ে বসলো। ফুল স্পীড দিয়ে চলে গেলো পিচঢালা পথ ধরে।

এক সন্ধ্যার পর তালুকদার পরিবারের বৈঠকখানায় বৈঠক বসেছে রাজের আহবানে। জুবায়ের মার্কেট থেকে চলে এসেছে রাজের অনুরোধে। সেও উপস্থিত। কারণ তার বিয়ে না করার কারণটা আজ সবার সামনে স্পষ্ট করতে হবে। সবাই বসে আছে। রাজ তার বাবাকে নিজামের বিষয়টা জানালো। তার মায়ের উপর অভিযোগের আঙ্গুল তুলে শিখাকে শারীরিক নির্যাতনের বিষয়টা উত্থাপন করলো।

সুফিয়া বিবি হই হই করে উঠলেন। ক্রোধে গরগর করতে করতে বিষাক্ত গলায় বললেন,

রাজবধূ ৫০ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!