রাকিবের ভাই সফিক—– সোহেল রানা বীর

সেই কখন থেকে আলমারীর দিকে তাকিয়ে আছে রাকিব। কাঁচের আলমারীর মধ্যে রাখা জিনিসগুলো থেকে চোখ সরছে না কোন মতে।  আলমারীর দিকে তাকাতেই চোখে পড়ে একটি খেলনা হেলিকপ্টার। হেলিকপ্টারটি রাকিবের মামা তার বড় ভাইকে দিয়েছিলো। সফিক রাকিবের বড় ভাই। খেলাধুলায় খুবই পারদর্শী। আলমারীর মধ্যে রাখা অধিকাংশ শোফিস এবং পুরস্কারের জিনিসগুলো সফিকের কৃতিত্ব। হেলিকপ্টারের পাশে কয়েকটি প্লেট। ক্লাশ ফোরে থাকাবস্থায় একশ’মিটার দৌড়ে ফার্স্ট পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলো। আলমারীতে কতগুলো মেডেল আছে সবই সফিকের অর্জন। কোনোটা মোরগই লড়ায়ে ফার্স্ট, কোনোটা লং জাম্পে সেকেন্ড আবার কোনোটা পনেরশ’মিটার দৌড়ে ফার্স্ট।

‘ষোলই ডিসেম্বর’ এলেই ভবানীপুর বটতলা নতুনভাবে সাজে। ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়। এ প্রতিযোগিতায় গ্রামের কিশোর থেকে শুরু করে বয়স্করা পর্যন্ত অংশ নেয়। বয়সভেদে খেলার পার্থক্য দেখা যায়। বটতলা থেকে রাকিবদের বাড়ি খুব বেশি দূরে না। মাইকের স্পষ্ট আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ‘আর একটু পরেই আমাদের প্রতিযোগিতা শুরু হবে। এখনো যাদের নাম লেখানো হয়নি। অতিদ্রুত নাম লেখানোর জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে।’ কিছু সময় পরপর তুষারের এই কথাগুলো মাইকে ভেসে আসছে।

অন্যান্য বারের মতো এবার প্রতিযোগিতায় নাম লেখানো হয়নি রাকিবের। ইচ্ছেও করছে না। নাম লেখানোর তাগিদ নিয়ে আবারও তাকে ডাকতে আসলো রূপম ও সৈকত। এ নিয়ে বেশ কয়েকবার রাকিবদের বাড়িতে আসলো রূপম। সাথে সৈকতও।

‘কিরে যাবিনে?’- আবারও রূপমের জোর গলার প্রশ্ন।

‘না। তোরা যা।’ বলেই খাটের উপর শুয়ে পড়লো রাকিব।

প্রতিবছরের ন্যায় এবারও আয়োজনের কমতি নেই। আয়োজকের অন্যতম সদস্য হিসেবে তুষারের দায়িত্বটা একটু বেশি। তুষার হরিণাকুন্ডু সরকারি লালন শাহ্ কলেজে পড়ে। গ্রামের আর দশজন ছেলে থেকে একটু আলাদা সে। বড় একজন সংগঠকও বলা যেতে পারে তাকে। তুষারের অন্যতম সহযোগী হিসেবে বীর বাড়ির জাহাঙ্গীর, ফারুক, জুয়েল আলামিন, পাশের বাড়ির টুলু এবং শাহিনের নাম বলতেই হয়। পাঁচ দিন আগে থেকে চলে তাদের প্রস্ত্ততি। আর্থিক সহযোগিতার জন্য ভবানীপুর পান পরিবহনের সকল ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চাঁদা তোলা হয়। গ্রামের ছোট ছেলেদের এ আয়োজনে বড়রা সাড়া না দিয়ে থাকতে পারেন না। অনুষ্ঠানের আগের দিন রাস্তার মোড়ে মোড়ে লাল ফিতা ধরে অনুষ্ঠানে সহযোগিতার জন্য টাকা তোলা হয়। এ বছর চাঁদা আদায়ের রশিদ এবং আমন্ত্রণ পত্র ছাপানো হয়েছে। নতুন এ মাত্রা যোগ করার পেছনে জুয়েলের অবদানটাই মুখ্য। আয়োজক কমিটির অন্যদের মতো সফিকও অগ্রণী ভূমিকা রাখে সবসময়। ছোট ভাই রাকিবকে সঙ্গে রাখতেও ভুল হয় না তার। গত বছর আয়োজনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সফিকের সরব উপস্থিতি ছিলো লক্ষণীয়। ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় প্রায় সবকটি ইভেন্টেই পুরস্কার জেতে সে। খেলাধুলায় তেমন পারদর্শী না হলেও রাকিবও অংশ নেয় দু’টি ইভেন্টে। অল্পের জন্য পুরস্কার হাতছাড়া হয়। পুরস্কার না পাওয়ায় বেশ কষ্টও পেয়েছিলো রাকিব। নিজের জন্য না হলেও বড় ভাইয়ের খেলা দেখার জন্য তাই সকাল থেকে টানা বিকেল পর্যন্ত বটতলা থাকে। দু’ভাইয়ের সেদিন আর দিনের বেলা বাড়ি ফেরা হয় না। যদিও তাদের আববু-আম্মু একটু হলেও দুশ্চিন্তায় থাকেন।

মাঝখানে এক ঘন্টা বিরতি রেখে সকাল দশটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত চলে তুষারদের প্রতিযোগিতা। উপস্থাপনায় বরাবরের মতো সেবারও জুয়েলই ছিলো। সাতটি ইভেন্টের ছ’টিতে পুরস্কার জেতা হয়ে গেছে সফিকের। ক্লান্তি বোধ করায় সপ্তম খেলাটিতে আর অংশ নেয়া হলো না। সপ্তম খেলাটি ছিলো ১৫০০ মিটার দৌড়। দিনের শেষে দর্শকদের বাড়তি বিনোদনের জন্য এই ইভেন্টা রাখা হয়। এই একটি মাত্র প্রতিযোগিতা যেখানে ছেলে-বুড়ো সকলেই অংশ নিতে পারে। এ প্রতিযোগিতার শুরুতে প্রতিযোগীর সংখ্যা চোখে পড়ার মতো থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে চার থেকে পাঁচ জন। এদের প্রথম তিনজনকে পুরস্কৃত করা হয়। আগের বার ১৫০০ মিটার দৌড়েও সফিক পুরস্কার পেয়েছিলো। মোট মিলে পুরস্কারের সংখ্যা ছিলো চার। এবার সে সংখ্যা ছাড়িয়ে ছ’-এ এসে পৌঁছেছে।

খেলা শেষে পুরস্কার বিতরণের পালা। বড় ভাইয়ের হাতে ছ’টি পুরস্কার আর নিজের শূন্য হাতের দিকে তাকিয়ে বড় লজ্জা পেল রাকিব। নিজেকে যুদ্ধে হারা পরাজিত সৈনিক বলে মনে হচ্ছিল তার। ছোট ভাইয়ের মনের অবস্থা বুঝতে দেরি হলো সফিকের। একটা পুরস্কার রাকিবের হাতে দিয়ে বললো-

বাড়ি গিয়ে বলবি, এটা তুই পেয়েছিস।

মানে!

মানে সহজ, এই পুরস্কারটা তোর। পুরস্কার হিসেবে পাওয়া ট্রে-টার দিকে ইশার করে বললো সফিক। কথাটি শোনার পর খুশিতে রাকিবের চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। তৃপ্তির রেখা দেখা দিলো তার কপালে। বাড়ির সবাই জানবে দিনশেষে রাকিবও খালি হাতে ফেরেনি- ভাবতেই রাকিবের মন আনন্দে নেচে উঠলো।

বিজয়ীর বেশে সন্তানদের বাড়িতে প্রবেশের দৃশ্য দেখে মায়ের মনও আনন্দে ভরে গেল। এভাবেই যেন জীবনের সকল প্রতিযোগিতায় তারা বিজয় লাভ করে- বিজয়ের এই দিনে মায়ের দোয়া রইল দুই সন্তানের উপর।

এর কিছু দিন পর। হরিনাকুন্ডু উপজেলা মাঠে ফুটবল টুনামেন্ট ২০০৭ এর আয়োজন চলছে। ঐতিহ্যবাহী এ খেলায় হরিণাকুন্ডু উপজেলার প্রায় সবগুলো গ্রাম থেকে একটি করে দল অংশ নেয়। ভবানীপুর গ্রামের যে দলটি প্রতিবছর এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় ভবানীপুর ফুটবল একাদশের সে দলের ক্যাপ্টেন রাকিবের বড় ভাই। বড় ভাই ক্যাপ্টেন হওয়ায় রাকিব বেশ পুলকিত। বড় ভাইকে নিয়ে তার অনেক গর্ব। বড় ভাইয়ের প্রায় সবগুলো সাফল্যের সাক্ষী সে।

২০০৫ সালের টুর্নামেন্টে খেলার শেষে যখন ম্যান অব দ্যা ম্যাচের পুরস্কারের জন্য সফিককে মঞ্চে ডাকা হলো তখন চারপাশে দাঁড়ানো দর্শকদের করতালিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠেছিলো। এ দৃশ্য দেখে রাকিব কী যে আনন্দ পেয়েছিলো। তা সে ছাড়া আর কেউ জানে না। তাইতো বড় ভায়ের সাফল্য নিজ চোখে দেখতে কখনো সফিকের পিছু ছাড়ে না রাকিব।

হরিনাকুন্ডু ফুটবল মাঠে ২০০৭ সালের টুর্নামেন্টে এবারও ঠিক একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি দেখা গেল। ভবানীপুর ও জোড়াদহ ফুটবল একাদশের মধ্যকার খেলায় একমাত্র গোলটি আসে সফিকের পা থেকে। ফাইনালের এই গোলটি যে কত কাঙ্ক্ষিত ছিলো, তা গোল হওয়ার পরপরই টের পাওয়া গেল। উত্তেজনার এ ম্যাচে শত শত দর্শকের করতালি আর চিৎকারে মুখরিত হয়ে উঠলো ফুটবল মাঠ। আরও একবার এ দৃশ্য দেখা গেল ম্যাচ সেরার পুরস্কার দেওয়ার সময়। ফাইনাল খেলার ম্যাচের একমাত্র গোলদাতাকে নিয়ে শুরু হয়ে যায় বিজয়োল্লাস। এ দৃশ্য দেখে রাকিবও বাধভাঙ্গা খুশির জোয়ারে ভাসতে থাকে।

পুরস্কার বিতরণী শেষ। বাড়ি ফিরতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো সবাই। ছোট ভাইকে ট্রাকে তুলে সফিকও উঠলো। ভবানীপুর গ্রাম থেকে প্রতিবছরই ট্রাক ভর্তি দর্শক খেলা দেখতে আসে। একই গাড়িতে থাকে খেলোয়াড়রাও। সবার পেছনে সফিক। ট্রাকের ডালায় এক হাত আর অন্য হাতে ছোট ভাইকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ওদিকে গলা ফাটানো জয়োল্লাসে রাস্তার আশে পাশের সকল মানুষকে জানান দিয়ে যাচ্ছে ভবানীপুরবাসী। গ্রামের বাসিন্দাদের দেয়া মালাগুলো দারুণভাবে শোভা পাচ্ছে প্রত্যেক ফুলবলারের গলায়। দলের ক্যাপ্টেন সফিকের মালা প্রথমে তার গলায় থাকলেও সেটা এখন তার ছোট ভাইয়ের গলায়।

উপজেলা থেকে ভবানীপুরের দূরত্ব প্রায় চার কিলোমিটার। এ অল্প দূরত্বটুকু পথ পাড়ি দিতে যেন বেশি সময় লাগছে। পথ যেন শেষ হচ্ছে- রাকিব মনে  মনেই ভাবলো। সফিককেও একটু উদাসীনই মনে হতে লাগলো। অন্য সবার আনন্দ উল্লাসে রাকিব ও সফিকের ব্যাপারটা তেমন চোখে পড়লো না কারোর।

ভবানীপুর যেতে আর দেড় কিলোমিটার পথ বাকী। তার আগেই গাজীপুর আসতে না আসতেই সবার জয়োল্লাস হঠাৎ থেমে গেল। আত্মচিৎকারে চারিদিকের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠলো। রাস্তার পাশে বাবলা গাছে ধাক্কা খেয়ে চ্যাপ্টা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ট্রাকটি। ওদিকে বাঁচাও! বাঁচাও!! আত্মচিৎকার।

সফিকের মাথা থেকে গল গল করে রক্ত বের হচ্ছে। আরও চল্লিশ জনক আহত অবস্থায় হরিণাকুন্ডু স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হলো। সংবাদ পেয়ে ছুটে আসলেন সফিকের স্বজনরা। সারা এলাকাজুড়ে দুর্ঘটনার সংবাদটি ছড়িয়ে পড়লো।

সফিকের অবস্থা বেশি আশংকাজনক। ডাক্তারদের তৎপরতার কমতি নেই। এদিক সেদিক ছুটছে সফিকের জন্য। একঘন্টা আগে তাকে সবাই দেখেছে ম্যাচসেরার পুরস্কার হাতে। অথচ এখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। নিয়তির নিষ্ঠুর চেহারা বোধহয় এ রকমই। বমি করলো সফিক। পরপর দু’বার। হাসপাতালের প্রধান ডা. দিদারুল আলম এবার আরও বেশি আশঙ্কিত হয়ে পড়লেন। ভয়ে গা-হাত-পা অবশ হয়ে আসলো সবার।

ইনটেনসিভ কেয়ারে শুয়ে আছে সফিক। দরজার বাইরে বাবা-মা আর ছোট ভাই রাকিব ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। হাসপাতালের সামনে শত শত মানুষ চোখে-মুখে অজানা ভয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সফিকের সুস্থতার জন্য হাত তুলে প্রার্থনা করছে অনেকেই।

অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে সবকিছু উপেক্ষা করে না ফেরার দেশে চলে গেল সফিক। মুহূর্তের মধ্যে শোক সংবাদটি ছড়িয়ে পড়লো সারা হাসপাতাল জুড়ে। শোকের ছায়া নেমে আসলো সারা এলাকায়। কান্নার রোল পড়ে গেল।

সেদিনের সে শোক আজও কাঁদায় সবাইকে। ‘ভবানীপুর ফুটবল একাদশ ঠিকই আছে, নেই একাদশের অধিনায়ক সফিকুর রহমান সফিক। আজও ফুটবল খেলা হয়। খেলায় নেই আগের মতো উন্মাদনা। ‘বিজয় দিবস’ এসেছে আবার; লাল ফিতা ধরে টাকা তোলা  হচ্ছে ঠিকই, টাকা তোলার ওখানে নেই সফিক। সফিকের মতো আর কেউই সবগুলো ইভেন্টে পুরস্কার জিততে পারে না। এ রকম হাজারো ভাবনা সফিকের স্বজনদের মনে বারবার আছড়ে পড়ে।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!