কায়েস চৌধুরীর মাথার ভেতরে চিন্তা চলছে ঝড়ের গতিতে। সম্মেলনকেন্দ্রের ভেতরের মৃদু শব্দে চলা এয়ার কন্ডিশনারটাও পারছে না তার কপালের ঘামের ফোঁটাগুলোকে থামিয়ে দিতে। কফির কাপে চুমুক দিচ্ছেন কায়েস চৌধুরী। তেতো কফি- অন্য সময় হলে ছুঁড়ে ফেলে দিতেন তিনি এটাকে- এই মুহুর্তে ভ্রুক্ষেপও করছেন না সেদিকে। ভয় পেয়েছেন, কায়েস চৌধুরী ভয় পেয়েছেন…
প্রথমে হলুদ স্কার্ফে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলার স্বরে অলিভার আনিস, এরপর ডোরাকাটা হাতকাটা গেঞ্জির মোটর ফাইয়াজ। একের পর এক জট পাকিয়ে যাচ্ছে সব মাথার ভেতর…
ব্যাপারটা শুরু থেকে ভাবা দরকার এবার একবার ঠাণ্ডা মাথায়।
বাংলাদেশ লেখক সমিতির পক্ষ থেকে আয়োজিত তিনদিনের বিশেষ সম্মেলনের আজ দ্বিতীয় দিন। এই সম্মেলন চালু হয়েছে গত বছর থেকে। পাঠকদের সাথে লেখকদের আলোচনা আর সরাসরি মত বিনিময়ের জন্যেই আসলে আয়োজনটা। পাঠকেরা আসবে- লেখকদের সাথে কথা বলবে; কেবল এই জন্যেই ভাড়া নেয়া হয়েছে এই আটতলা বিশাল দালানটা। নিবন্ধিত লেখকদের মাঝে লটারি করে স্টল দিয়েছে লেখক সমিতি, একতলাটা বরাদ্দ হয়েছে রহস্য- ভৌতিক আর হরর গল্প লেখকদের জন্যে। কায়েস চৌধুরীর বরাত মন্দ, সিঁড়ির সামনের একেবারে ওঁচা একটি স্টল পেয়েছেন তিনি। স্টলের অবস্থান নিয়ে ক্ষোভের অন্ত নেই কায়েস চৌধুরীর, তবে সবকিছুর মতোই এই জায়গারও একটা ভালো দিক আছে। বাংলা রহস্য উপন্যাসের প্রবাদ পুরুষ কাজী আনোয়ার হোসেন ওরফে কাজীদার স্টলটা পড়েছে তার ঠিক উল্টোদিকে। কায়েস চৌধুরী আবার কাজীদার ভীষণ ভক্ত, মেলায় আসা অন্যান্য পাঠকদের স্রোতের মাঝখানে একটূ ফাঁক পেলেই তিনি গিয়ে কথা বলে আসছেন কাজীদার সাথে। এককথায়, মন্দ লাগছিলো না সম্মেলনটা।
… মানে, লাগছিলো আর কী। কিন্তু এরপরেই ওই অলিভার আনিস আর মোটর ফাইয়াজ মিলে সমস্ত এলোমেলো করে দিলো।
অথচ সকালটা বড় চমৎকার ছিলো। সারাটা সকাল ভীড় লেগেই ছিলো কায়েস চৌধুরীর সামনে। অটোগ্রাফ আর ছবি তোলার জন্যে পাগল হয়েছিলো যেনো লোকগুলো। এর সাথে অনবরত ছুটে আসা প্রশ্নরা তো আছেই।…
– ‘স্যার, নায়িকা দিবা ফারাহকে অমন করে মেরে ফেল্লেন শেষটায় ??’
– ‘গোয়েন্দা ইমরুল বক্সীর মতো অমন দারুণ চরিত্রের আইডিয়াটা কি করে পেলেন স্যার ??’
-‘ ওফ, কায়েস আঙ্কেল- আপনার ‘মধ্যরাতের ঘড়ি’ থ্রিলারটা পড়ে এমন ভয় পেয়েছিলাম না !! সে রাতে বাতি জ্বালিয়ে ঘুমাতে গিয়েছিলাম… কেন এমন পচা করে লেখেন- যাতে এতো ভয় পেতে হয় ??’ … ইত্যাদি।
তবে কায়েস চৌধুরী এতো অল্পে বিরক্ত হন না। এই মুহুর্তে তাকে ঘিরে পাঠকদের এতো উচ্ছ্বাস-আগ্রহ খুবই স্বাভাবিক। কায়েস চৌধুরীই এখন সন্দেহাতীত ভাবে বাংলাদেশের সেরা রহস্য উপন্যাস লেখক। গত তিন বছরে টানা পাঁচটি শ্বাসরুদ্ধকর থ্রিলার লিখে তিনিই এখন রহস্য-গল্প প্রকাশকদের কাছে সবচেয়ে বড় ভরসার নাম। কায়েস চৌধুরীর বই মানেই বাজারে নিশ্চিত কাটতি, ছয় মাসে ন্যূনতম তিন সংস্করণ। খুঁতখুঁতে টিভি নাটক পরিচালক অনিকেত আহমেদ পর্যন্ত কায়েসের উপন্যাস ‘সীমান্তের দিনরাত্রি’ নিয়ে মাসছয়েক আগে একটা টিভি সিরিয়াল বানিয়েছিলেন, দর্শকদের কাছে দারুণভাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে ওটাও।
কায়েস চৌধুরীর বয়স ৪০-৪২ হবে। ছোট করে ছাঁটা চুলের সাথে মোটাফ্রেমের চশমায় তাকে ভালোই দেখায়। আগে একটা বেসরকারী ফার্মে চাকরি করতেন, এখন চাকরি ছেড়ে শুধু লেখালেখিতে মন দিয়েছেন। রেজা হায়দার কিংবা গোবিন্দ রায়ের মতো পুরাতন রহস্য ঔপন্যাসিকদের নাম এখন আর সহজে আসে না পত্রিকার পাতায়। হাইটেক প্রযুক্তি নির্ভর তরুণ প্রজন্মের পাঠকেরা কী চায়, তা খুব ভালোমতোই ধরতে পেরেছেন কায়েস চৌধুরীর। প্রচুর বিদেশী খুনখারাবির সিরিয়াল দেখে আর পুরনো দিনের রহস্যপন্যাসের থেকে আইডিয়া এদিক-ওদিক করে একের পর এক হিট লেখা বের করছেন তিনি। অবসরে বাসায় বসে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে কায়েস চৌধুরীও মনে মনে স্বীকার করেন- হ্যাঁ, তার গোয়েন্দাদের মাঝে রেজা হায়দার কিংবা গোবিন্দ রায়ের অতটা প্রখর বুদ্ধির মারপ্যাঁচ- অতটা সূক্ষ্ম মনোবিশ্লেষণ হয়তো নেই- কিন্তু আছে প্রযুক্তির যাদু আর তরুণ পাঠকের যতটা প্রয়োজন ঠিক ততটা হালকা যৌনতা।
… ঝামেলাটা শুরু হলো দুপুর নাগাদ। একটু স্পষ্ট করে বললে সকালের ভীড়ের পর লাঞ্চটা সেরে এসে যখন কায়েস চৌধুরী আবার স্টলে বসেছেন মাত্র, ঠিক তখনই তার সামনে এসে হাজির হলুদ স্কার্ফ জড়ানো একটা মানুষ।
‘হেহে, ভালো আছেন স্যার ?? … আয়া পড়লাম আপনের লগে দেখা করতে। জন্মদাতা বাপের মতোইতো আপনে আমার- না কি কন ??…’ বলতে বলতে তার দিকে অটোগ্রাফের একটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে লোকটা।
কী নাম লিখবেন জানতে চাইতেই কায়েস চৌধুরীর মুখের উপর হেসে দিলো লোকটা। ‘ কন কী স্যার, আমারে আপনে চিনবার পারলেন না ??… আরে আমি আনিস- অলিভার আনিস !! মীরপুর দশ নাম্বারে তিন জোড়া খুন- মনে নাই স্যার ?? …’
হতচকিত হয়ে লোকটার দিকে ভালো করে চাইলেন কায়েস চৌধুরী। হলুদ স্কার্ফ আর চাপা গলার স্বরের একটা ভয়াবহ লোককে তো তিনি চেনেন, বলা ভালো লোকটিকে তিনিই সৃষ্টি করেছেন। তার ‘তুরুপের তাস’ উপন্যাসের দুর্ধর্ষ খুনী অলিভার আনিস, শেষ অধ্যায়ে গোয়েন্দা রাশেদ হাসানকে হুমকি দিয়ে যে উধাও হয়ে গিয়েছিলো ঢাকা ছেড়ে !!
বিস্ময়ে দম আটকে গেলো কায়েস চৌধুরীর, যখন তিনি হাতের বইটার দিকে তাকিয়ে দেখলেন বইটার নাম ‘তুরুপের তাস’ !! এমন বিশ্রী রসিকতায় ক্ষেপে গিয়ে লোকটার দিকে আবার তাকিয়েই আরেকটা বিস্ময় উপহার পেলেন তিনি, কখন যেন মিলিয়ে গেছে অলিভার আনিস !!
ঘটনাটা মন বিক্ষিপ্ত করে তুললো কায়েস চৌধুরীর। বিকেলের দিকে আবার আসা শুরু করলো তার ভক্তের দল। অটোগ্রাফ-ফটোগ্রাফের তোড় কায়েসচৌধুরীকে ভুলিয়েই দিয়েছিলো সেই লোকটার কথা। বাজে একটা রসিকতা ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছিলো না তার ওই ঘটনাটাকে। কিন্তু ডোরাকাটা হাতাকাটা গেঞ্জির আরেকটা লোক তার সামনে দাঁড়াতেই আবার মনে পড়ে গেলো তার অলিভার আনিসকে, কারণ এই ডোরাকাটা পোষাক তার ‘অপারেশন ঈশ্বরদী’ উপন্যাসের খলনায়ক মোটর ফাইয়াজের ট্রেডমার্ক।
স্মাগলিং চক্রের নাটের গুরু ফাইয়াজের অন্তর্ধানটাও রহস্যজনক ছিলো বড়, গোয়েন্দা রাশেদ হাসান আগপাশতলা খুঁজেও ধরতে পারেনি ফাইয়াজকে- মনে পড়ে কায়েস চৌধুরীর। মোটর ফাইয়াজ তার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে একট বই, সই করতে হবে। কাঁপাকাঁপা হাতে সে বইতে সই করতে করতে কায়েস চৌধুরী বললেন, ‘নাম কী আপনার ?’…
জবাবে ইনস্পেকটর মোজাম্মেল হককে যেমনটা বলেছিলো সে উপন্যাসের পঞ্চম অধ্যায়ে, তেমনটা ফিসফিস করেই বললো লোকটা- ‘আমি ফাইয়াজ, মোটরগাড়ি দিয়ে মানুষ মারি বলে আমায় লোকে মোটর ফাইয়াজ নামকে চেনে। …সাপের গর্তে পা দিয়েছেন আপনি সাহেব, সাধ আহ্লাদ থাকলে মিটিয়ে নিন।’
ঠিক নিজের লেখা উপন্যাসের ভাষায় লোকটাকে কথা বলতে শুনে জমে গেলেন কায়েস চৌধুরী। এবং কথাটা বলেই মিলিয়ে গেলো মোটর ফাইয়াজ, অলিভার আনিসের মতোই- বইটা ফেরত না নিয়েই। কায়েস চৌধুরী ঘামতে লাগলেন দরদর করে। কেনো, কী ভাবে হচ্ছে এসব ??…
স্টল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন কায়েস চৌধুরী। ঠান্ডা মাথায় ভাবা দরকার বিষয়টা, রহস্য গল্প লেখেন তিনি- চেষ্টা করলে এই রহস্যও ভেদ করতে পারবেন তিনি নিশ্চয়ই ! সম্মেলনের প্রতি তলার ঠিক মাঝখানে ছোট্ট একটা জায়গা লেখকদের জন্যে সংরক্ষিত, সেই দিকে এগোলেন তিনি। ভাবতে হবে, গভীরভাবে ভাবতে হবে।
বিনা পয়সার কফিটায় – যেটা ভয়াবহ তিতকুটে হলেও তিনি পরোয়াই করলেন না- চুমুক দিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন কায়েস চৌধুরী। পুরো বিষয়টা খতিয়ে দেখা উচিৎ না মনে মনে ??…
প্রথম কথা, অলিভার আনিস বা মোটর ফাইয়াজ তার কল্পনা নয় তো ?? সম্ভব ছিলো ব্যাপারটা- কিন্তু তার হাতে ধরা বইদুটো একদম নিখাদ বাস্তব। অতএব আনিস বা ফাইয়াজ অথবা তাদের ছদ্মবেশে যারাই আসুক- তারা ঘোরতর বাস্তব। এবার পরের প্রশ্ন, মনে হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও এটাই। এ রকমটা কেনো হবে ?? মানে, বইয়ের পাতা থেকে কোন চরিত্র কেনো উঠে আসবে তার কাছে ?? এরকম ঘটনা কখনো অন্য কারো ক্ষেত্রেও হয়েছে কি ??
… চট্ করে কথাটা মনে পড়ে গেলো কায়েস চৌধুরীর। মানে রেজা হায়দারের কথাটা। আজ দুপুরে লাঞ্চ করবার সময়ই তার পাশে বসা রেজা হায়দার বলছিলেন কাকে যেন, ‘ যা ভয়টা পেয়েছিলাম বুঝলেন !! অবিকল সেই কপালের কাটা দাগ- সেই পাকানো মোঁচ- সেই ছ’ফুট দুই ইঞ্চির গুলজারিলাল !! আরে ‘অন্তিম মৃত্যু’ উপন্যাসে ঠিক এমন করেই আমি একটা চরিত্র বানিয়েছিলাম মনে নেই ?? আমার তো কথাই আটকে গেলো …’
কথোপকথনের পরের অংশটা আর শোনার প্রয়োজন বোধ করেননি তখন কায়েস চৌধুরী, তার মনোযোগ ছিলো তখন ফ্রায়েড রাইসের দিকেই। এখন মনে হচ্ছে শুনলে পারতেন পুরো ঘটনাটা। … যাক, রেজা হায়দারের কথাটা সত্য বলে মানলে বোঝা যাচ্ছে এরকম পরিস্থিতির ভিকটিম তিনি একাই নন। তবে কি সমস্ত রহস্য উপন্যাসের খলনায়কেরা একজোট হয়েছে ?? উঠে আসছে বইয়ের পাতা থেকে ?? কাজীদার কবীর চৌধুরী ?? গোবিন্দ রায়ের শাকের মৃধা ??…
কায়েস চৌধুরী ঠিক করলেন একবার কথা বলবেন রেজা হায়দারের সাথে। ভদ্রলোক বয়েসে তার চাইতে একটু বড়, কায়েস চৌধুরীর পূর্বে রহস্য উপন্যাসের প্রকাশনা জগতে তিনিই ছিলেন সেরা তাস। এখন সময় পাল্টেছে- বাজারের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়েছে বলে হয়তো রেজা হায়দার মনে মনেও ক্ষুদ্ধ কায়েস চৌধুরীর ওপর, সেকারণেই কায়েস চৌধুরী সযতনে এড়িয়ে চলেন রেজা হায়দারকে।
কিন্তু আজ এমন ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে মাথা ঘামালে চলবে না। কায়েস চৌধুরী তাই রওয়ানা দিলেন রেজা হায়দারের বসবার জায়গাটার দিকে।
কী আশ্চর্য ! রেজা হায়দারের স্টলটা খালি !! কেউ নেই সেখানে। কায়েস চৌধুরী গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন। রেজা হায়দার ছাড়া কারু কাছে তিনি যদি বলেন এই অলিভার আনিসদের কথা- শতকরা ৯৮ ভাগ লোকে সেটাকে ভাববে মানুষিক অসুস্থতা বলে। বাকিরা বলবে স্টান্ট- বলবে পাবলিসিটি করবার ধান্দা।
কোথায় যেতে পারেন রেজা হায়দার ?? গুরুতর অসুস্থ বা ওইরকম জরুরী কোন কারণ না থাকলে লেখকেরা সাধারণতঃ স্টল ছাড়েন না এই সম্মেলনে। পাবলিক ইমেজের জন্যে সেটা খুবই খারাপ। রেজা হায়দারের মতো ঝানু লোকে সেটা জানেন না ভাবার কোন কারণই নেই। তবে কি তারও কিছু হয়েছে ?? মানে, খারাপ ধরণের কিছু ?? …
গভীর ভাবনার ফাঁকতালে কখন লোকটা এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারেননি কায়েস চৌধুরী। কড়া চুরুটের গন্ধে নাক জ্বলে গেলে পেছনে ফিরলেন তিনি। নীল ফ্লানেলের স্যুট, ঠোঁটে চুরুট, সোনালী ফ্রেমের গোল চশমা পড়া লোকটা দাঁড়িয়ে আছে তার ঠিক পেছনে। হাসছে মিটিমিটি।
-‘ আপনি … আপনি… মিনহাজ শরফুদ্দীন ?? ’ প্রশ্নটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলো হঠাৎ করে তার। ঢিবঢিব বুকে অপেক্ষা করতে লাগলেন কায়েস চৌধুরী।
‘ঠিক ধরেছো তুমি চৌধুরী,’ ভয়ানক একটা হাসিতে মুখটা ভরে গেলো মিনহাজ শরফুদ্দীনের- ঠিক যেরকম হাসির বর্ণনা দিয়েছিলেন কায়েস চৌধুরী তার ‘পলাতক রাজকুমার’ উপন্যাসের দ্বাদশ অধ্যায়ে- ‘আমিই মিনহাজ। আর আমার যা প্রাপ্য, …আমি তা ঠিকই আদায় করে নেই !!’
‘কিন্তু… কিন্তু… মানে তোমরা হঠাৎ কেনো…’ প্রশ্নটা মুখেইআটকে যায় কায়েস চৌধুরীর, ঘাড় ফিরিয়ে একবার রেজা হায়দারের স্টলের দিকে তাকান তিনি।
যেন তার অসমাপ্ত প্রশ্নটা বুঝতে পেরেই চুরুটের ধোঁয়া ছাড়েন মিনহাজ সাহেব, কায়েস চৌধুরী তাকে সৃষ্টি করেছেন পূর্ব ইউরোপে অস্ত্র আর নারী পাচারকারী রিং লিডার হিসেবে- সেই বনেদীয়ানা বইয়ের মতোই বাস্তবেও বজায় রাখেন তিনি। ‘হ্যাঁ, আপনি ঠিক ধরেছেন। রেজা হায়দারও নেই। গুলজারিলালের কাজ ওটা। … আসছি, আমরা সবাই আসছি। রেজা হায়দার নেই, কাজী আনোয়ার হোসেন আর গোবিন্দ রায়ও বাদ যাবেন না। তুমিও প্রস্তুত থেকো।’
‘কিন্তু… কেনো ?? কী কারণে…’ বহু দূর থেকে ভেসে এলো যেন কায়েস চৌধুরীর গলাটা।
‘চৌধুরী,’ ফিসফিস স্বরে তার বুকে কাঁপন তুলে দিলো মিনহাজ শরফুদ্দীন। ‘ বলতে পারো, নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেও কতগুলো অপরাধ করতে হয়েছে আমায় ?? কেবল তোমার কলমের খোঁচায় ?? কত মানুষ হত্যা করেছো তুমি আমাকে দিয়ে, হিসেব রেখেছো তার ?? …’
‘কিন্তু ওসব তো কল্পনা !!’ আর্তনাদ করে ওঠেন কায়েস চৌধুরী। ‘তাই বলে লেখককে- তোমাদের জন্মদাতাকে সরিয়ে দিতে হবে তোমাদের ??’
‘তোমার হাত ধরেই আমি নিজ হাতে সায়ানাইড মিশিয়ে নিজের বাপকে মেরেছিলাম চৌধুরী, মনে নেই ??’ ক্রুর একটা হাসিতে ফেটে পড়লো মিনহাজ শরফুদ্দীন। ‘ভেবো না, তোমার মরণ তুমিই নিজ হাতে লিখেছো- ঈশ্বর নন। আমি তোমায় কেবল বিদায় জানাতে এলাম। … সলোমন আসছে।’
নীল ফ্লানেলের স্যুট হারিয়ে গেলো লোকের ভিড়ে।
মাথাটা যেন একটু একটু টলছে কায়েস চৌধুরীর। সেই অবস্থাতেই লোকের ভিড় ঠেলে আবার এসে নিজের স্টলে বসলেন তিনি। এবসার্ড, অবাস্তব কিছু একটা ঘটছে এই সম্মেলনে; বুঝতে পারছেন। বাস্তব জীবনের রহস্যভেদ করা বইয়ের পাতার চেয়ে অনেক কঠিন মনে হলো তার। সলোমন আসছে- দিদিয়ের সলোমন !! সেই নৃশংস ভাড়াটে খুনী, ‘লেখকের মৃত্যু’ উপন্যাসে যাকে জন্ম দিয়েছিলেন তিনি নিজে- যাকে একাধিকবার চেষ্টা করেও ধরতে ব্যর্থ হয়েছে রাশেদ হাসান। সেই খুনী দিদিয়ের সলোমন আসছে !!
হার্টের দূর্বলতাটা অনেকদিন চাপা দিয়ে রেখেছিলেন কায়েস চৌধুরী, এই মুহুর্তে সেটা ফিরে এসেছে প্রবলভাবে। কায়েস চৌধুরী কোন কিছুর দিকে দৃষ্টি না দিয়ে নেশাগ্রস্তের মতো পা বাড়ালেন সম্মেলনকেন্দ্রের প্রবেশ মুখের দিকে। দ্রুত- খুব দ্রুতই বের হতে হবে তাকে। যত দ্রুত সম্ভব বের পৌঁছতে হবে বাড়িতে। বাড়িতে একবার পৌঁছতে পারলেই হয় শুধু, এপার্টমেন্টের বাইরেরর নিরাপত্তা দ্বিগুণ করে নেবেন তিনি।
হঠাৎই, এই ঘোলাটে মস্তিষ্কেও নতুন সম্ভাবনাটা মাথায় আসতেই কায়েস চৌধুরী সাবধান হয়ে হলেন। এই ভিড়ের মাঝেও তো কোথাও লুকিয়ে থাকতে পারে দিদিয়ের সলোমন ?? গেটের নিরাপত্তারক্ষীদের ফাঁকি দেয়াটা কোন ব্যাপারই নয় তার মতো ট্রেইন্ড এসাসিনের কাছে। ভিড়ের মাঝে সাইলেন্সার লাগানো ছোট পিস্তলে তাকে গুলি করতেও সমস্যা হবে না সলোমনের, জানেন কায়েস চৌধুরী। ছোট একটা লাইটার জ্বালানোর মতো শব্দ হবে কেবল- খুনীর ধরা পড়ার সম্ভাবনা নেই কোন। কাজেই সতর্ক হতে হবে তাকে।
সাবধানে সমস্ত ভিড় এড়িয়ে প্রবেশ পথের কাছে পৌঁছে গেলেন কায়েস চৌধুরী, প্রথমেই বাইরে না গিয়ে ফোন করলেন তার ড্রাইভারকে। ঝুঁকি নিতে চান না তিনি প্রবেশ পথ থেকে পার্কিং স্পেসের মাঝের তিন মিনিটের হাঁটা পথটায়। প্রায়ই অন্ধকার থাকে ওখানটায়।
ড্রাইভার বেলাল সাড়া দিলো ফোনের অপরপ্রান্তে। কায়েস চৌধুরী তাকে বললেন গাড়ি নিয়ে ঠিক গেটের সামনেই পার্ক করতে, এরপর যেন সে ভেতরে ঢুঁকে নিয়ে যায় তাকে। ড্রাইভার বেলাল করিতকর্মা যুবক। তাই মিনিট দু’য়েক- যেটাকে কায়েস চৌধুরীর মনে হয় দু বছর- পরেই তাকে দেখা যায় প্রবেশ পথের সিকিউরিটি চেকিং পেরিয়ে ভেতরে ঢুঁকতে। কায়েস চৌধুরী লম্বা দম নিয়ে এগিয়ে যান বেলালের দিকে এবং ঠিক সেই মুহুর্তেই বেলালের পেছনে লম্বা ধূসর ওভারকোটের দিদিয়ের সলোমনকে তিনি দেখতে পান।
সেই মুহুর্তে হঠাৎ সব গোলমাল হয়ে গেলো কায়েস চৌধুরীর। তিনি জানেন ধূসর ওই ওভারকোটের ভেতরের দিকে একটা আলাদা খোপের মতো জায়গায় রয়েছে দিদিয়ের সলোমনের সিরিঞ্জটা, সলোমনের প্রিয় অস্ত্র। ‘এপোলো এক্সপ্রেস’ উপন্যাসের দ্বিতীয় অধ্যায়েই এই দিয়েই সলোমনের হাতে তিনি বধ করেছেন মার্থা বোকোভা’কে। সলোমনকে দিয়ে করানো তার অগণিত হত্যাকান্ডের আরো একটি…
ঘুরে দাঁড়িয়েই ছুট লাগালেন কায়েস চৌধুরী। ছুট। ছুট। ছুট। শ্বাস আটকে আসছে তার। বুকের ভেতর কেমন যেন অসহ্য ব্যাথা। হৃৎপিণ্ডটা যেন ফেটে বেরিয়ে আসবে তার। সব অন্ধকার দেখাচ্ছে …
কায়েস চৌধুরী আর কোনদিন রহস্য উপন্যাস লিখবেন না।
*******
হট্টগোল, প্রচুর হাঁকডাক, মানুষের ইতস্তত কথা বলার আওয়াজে গমগম করছে সম্মেলনকেন্দ্রের ভেতরটা। টিভি ক্যামেরার উজ্জ্বল আলো আর ফটোগ্রাফারদের ফ্ল্যাশলাইটের মাঝেও কাজী আনোয়ার হোসেন, রেজা হায়দার আর গোবিন্দ রায়দের ম্লান দেখাচ্ছে।
‘কায়েস চৌধুরীর মতো তরুণ ও প্রতিভাবান রহস্য-লেখক হারানো আমাদের জন্যে একটা অপূরণীয় ক্ষতি।’ ক্যামেরার দিকে মুখ করে বললেন রেজা হায়দার। ‘ তার লেখার মধ্য দিয়ে আমরা দেশের রহস্য-উপন্যাসের জগতে নতুন একটা যুগের সূচনা দেখতে পারছিলাম। … কিন্তু নিয়তির ওপর তো আর মানুষের হাত নেই। আর কায়েসও তো কোনদিন কাউকে জানায়নি যে তার হার্টের সমস্যা ছিলো। বড্ড হঠাৎ করেই যেন রোগটা কেড়ে নিলো কায়েসকে…’
পেছনে দাঁড়ানো অন্যান্য লেখকেরা সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। কেউ যেন এখনো মেনে নিতে পারছেন না কায়েস চৌধুরীর এই অকাল প্রয়াণ।
পুলিশ এসে সন্দেহজন কিছুই পায়নি, তদুপরি ডাক্তার বরকত মৃধা- যিনি নিজেও ছিলেন কায়েস চৌধুরীর লেখার একজন ভীষণ ভক্ত- নিশ্চিত করেছেন হার্ট হঠাৎ ফেল করাতেই মৃত্যু ঘটেছে কায়েস চৌধুরীর। তবে কেউই বুঝতে পারছে না কী দেখে আতঙ্কিত হয়ে হঠাৎ দৌড়াতে শুরু করেছিলেন তিনি।
সম্মেলনকেন্দ্রের সিকিউরিটি চীফ আসিফ আহমেদ করিতকর্মা লোক। পুলিশের লোকেরা ফিরে যেতেই প্রথমেই সাংবাদিকদের সম্মেলন ডেকেছেন। লেখকেরা বিবৃতি দিচ্ছেন সেখানে টিভি আর প্রিন্ট মিডিয়ায়। এই অবসরে সাধারণ দর্শকদের ধীরে ধীরে বের করে দিলেন আসিফ আহমেদ। ছবি তোলা হচ্ছে হরদম- টিভি চ্যানেল- দর্শক আর প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার…
… সমস্ত কাজ শেষ করে সম্মেলনকেন্দ্র থেকে বেরোতে রাত ১১টা বেজে গেলো রেজা হায়দারের। পিঠের ব্যাকপ্যাকটা নিয়ে ডাক দিলেন তিনি একটা খালি রিকশাকে। চড়ে বসলেন রামপুরা বনশ্রীর উদ্দেশ্যে। অক্টোবর শেষের হালকা শীতের বাতাস রাস্তায়, রেজা হায়দার একটা সিগারেট ধরালেন।
কাজটা সহজেই চুকে গেছে, ঝামেলা হয়নি একদম। নগর নাট্যদলের কাজ করে, তার এমন দুই বন্ধু অভিনয় করেছে অলিভার আনিস আর মোটর ফাইয়াজের চরিত্রে- ‘প্র্যাকটিকাল জোক’ বলে তাদের আগেই সন্দেহমুক্ত করে নিয়েছেন তিনি। এরপরেও কেউ এই নিয়ে প্রশ্ন তুললে গুলজারিলাল সম্পর্কে তার বানানো গল্পটা কাজ করবে দেয়াল হিসেবে, বলে দেয়া যাবে কোন পাগলা ভক্তের রসিকতা এটা। আর মিনহাজ শরফুদ্দীন আর দিদিয়ের সলোমনের চরিত্রে অভিনেতা হিসেবে তিনি নিজেই তো বেশ চমৎকার উতরে গিয়েছেন বোঝা যাচ্ছে। কাজটা কঠিন ছিলো না মোটেই- কেবল ফ্লানেলের স্যুটটা খুলে নিয়ে উপরে লম্বা ওভারকোটটা চাপাতেই হয়ে গেছে। মিনহাজের পরচুলাটা তিনি নিজেই কিনেছেন, যেটা এই মুহুর্তে রয়েছে তার ব্যাকপ্যাকে- ফ্লানেল স্যুটটা রয়েছে সম্মেলনকেন্দ্রের তেতলার ওয়াশরুমে আর ওভারকোটটা ফেলে এসেছেন নিজেরই স্টলে। দু’টোর মাঝে যোগসূত্র আবিষ্কার করতে পারবে না কেউ নিশ্চয়ই। কাল নিয়ে আসবেন ওভারকোটটা। ব্যাস- খেল খতম।
…প্ল্যানটা তার মাথায় এসেছিলো ঢাকা ক্লাবের এক আড্ডায়, যখন কায়েস চৌধুরী নেশার ঘোরে মুখ ফসকে তার কাছে বলে দিলেন নিজের হার্টের দুর্বলতা। তখনই তার মনে হয়েছিলো, এই ব্যাপারটা কাজে লাগিয়ে কারো সন্দেহের উদ্রেক না ঘটিয়েই সরিয়ে দেয়া যায় কায়েস চৌধুরীকে। কায়েস চৌধুরীর লম্বা লম্বা বোলচাল অসহ্য লাগতো তার। ছোকরার নিজের বলতে কিছু ছিলো না, বিদেশী থ্রিলার এদিক ওদিক করেই নিজের নাম কামিয়েছিলো ব্যাটা। একজন সত্যিকারের রহস্য-লেখকের মাঝে পর্যবেক্ষণশক্তি আর বুদ্ধিমত্তা থাকা দরকার- এর কিছুই ছিলো না কায়েস চৌধুরীর। অনেক মাথা ঘামিয়ে প্লট তৈরি করে করে তিনি যখন উপন্যাস লিখতেন- ঐ কায়েস চৌধুরী বরং তখন তামাশা করতো তা নিয়ে। আজকে তাই এক ঢিলে দু’পাখি মেরে নিলেন রেজা হায়দার। রহস্য উপন্যাস পাঠকদের কাছে আবারো নিজের হারানো শীর্ষ ফিরে পাবার রাস্তাটা পরিষ্কার হয়ে গেলো তার, আর বুঝিয়ে দেয়া গেলো সত্যিকারের রহস্যর ক্ষমতা অনুকরণ করা রহস্যের চাইতে অনেক বেশি। কোন পাঠক জানবে না, কিন্তু রেজা হায়দার জানেন- এটাই তার তৈরি করা শ্রেষ্ঠ রহস্য !!
রেজা হায়দার একটা সন্তুষ্টির হাসি দিলেন। একটু বেশ জোরেই।
‘কি হইসে স্যার ??’ রিকশাওয়ালার স্বরেই বোঝা যায় রাতের শহরে এমন উদ্ভট হাসির আরোহী পেয়ে বিস্মিত সে। ‘ হুদাই হাসেন ক্যালা ??’
‘ও কিছু না,’ হাসি থামিয়ে গম্ভীর হবার চেষ্টা করতে করতে বলেন রেজা হায়দার। ‘তুমি চালাও।’
রিকশাওয়ালা বরং একথা শুনে রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে দেয় রিকশাটা। কথা বোঝেনি, নাকি পেচ্ছাব করবে সে- বোঝা যায় না।
‘কী হলো, কথা কানে যায় না ??’ রেজা হায়দার ধমকে ওঠেন। ‘বললাম না চালাও !!’
মাথার গামছাটা খুলে নিয়ে ঘাম মুছে রিকশাওয়ালা কোন কথা না বলে কেবল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। রেজা হায়দার খেয়াল করেন- রিকশাওয়ালার চোখজোড়া গাঢ় নীল।
‘চিনতে পারলেন- রেজা হায়দার সাহেব ??’ ফিসফিস করে বলে রিকশাওয়ালা।
নীল চোখের একটামাত্র মানুষকেই চেনেন রেজা হায়দার- ছদ্মবেশ নিতে সে দারুণ পটু, রক্তপাত ঘটিয়ে শিকার করা যার আরেক বৈশিষ্ট্য। রেজা হায়দার রচিত ‘রক্তের রঙ লাল’ উপন্যাসের খলনায়ক ইসরাফিল আব্বাসির আরেকটা সনাক্তকরণ চিহ্ন হলো, নিখুঁত হোমওয়ার্ক করে শিকারের সমস্ত গতিবিধি ছকে এনে নেয়া।
রেজা হায়দার ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলেন, ‘আব্বাসি!! তুমি ??’
ইসরাফিল আব্বাসি কথা না বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রক্ত দেখতে দেখতে আজকাল তার বড় ক্লান্ত লাগে। ইসরাফিল আব্বাসি জানে, এই অপারেশনটা শেষ করলেই তার মুক্তি…