সন্ধ্যায় এসেছিল ফোনটা, আর একটুও সময় না নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমার সাথে আছে শুভ। শুভ’র সাথে আমার বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের। আমার পাশের বাড়িতেই থাকে সে।
সেই অনেক বছর আগে আমার বাবা মারা যান, শুভ’রও একই অবস্থা। পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে আমাদের উপর। দিশেহারা হয়ে পড়ি দু’জনই, শেষে একটা ম্যাজিক স্কুলে প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন জলসায় জাদু দেখাতে শুরু করি, দিন দিন আমাদের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। অজো পাঁড়া গাঁ থেকে শুরু করে শহরের আধুনিক মহলেও আমাদের সুনাম ছড়িয়ে পড়ল। অলিখিত ভাবে আমাদের নাম হয়ে গেল ‘‘রহস্যময় জাদুকর’’ অবশ্য আমাদের জাদুতে কোন রহস্য নেই। সবটাই লোক ঠকিয়ে টাকা আদায় করা। তবুও সবাই আমাদের এই নাম দিল কেন কে জানে!
আমাদের জাদু দেখে দর্শক বেশ অবাক হয়। কেউবা হাত তালি দিয়ে মঞ্চ কাঁপিয়ে তোলে, কেউ বা চোখ কপালে উঠায় আবার বৃদ্ধ বা দুর্বল মনের মানুষেরা মঞ্চেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে, তখন জনপ্রিয়তা যেন আকাশ ছোঁয়া হয়, টাকার অংকটাও বড়।
আজ এক গ্রাম্য জলসায় আমাদের ডাক পড়েছে। যাতায়াতের পথটা বেশম সুবিধার নয় বলে প্রথমে যেতে রাজি হইনি, পরে টাকার অঙ্ক ভারী বলেই চলে গেলাম।
আমরা যখন স্টেশনে পৌঁছলাম তখন রাত দশটা। জলশার এক লোক আমাদের স্টেশন থেকে নিয়ে গেল। গ্রামটা মোটেও আধুনিক নয়। কাঁচা মাটির রাস্তা। তার উপর কোথাও আলো জ্বলছে না। হাঁটতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, একসময় মঞ্চে এসে পৌঁছলাম, মঞ্চটাও দেখতে তেমন একটা ভালো নয়। তবুও ভাবলাম, আমাদের টাকা পেলেই হলো, অতো ভেবে আমাদের কাজ নেই।
প্রায় দুই ঘন্টা আমরা মঞ্চে জাদু দেখালাম। শেষে এক পরিত্যক্ত বাড়িতে আমাদের রাতে থাকার ব্যবস্থা করা হলো, বাড়িটা বেশ নির্জন, চারপাশে হাল্কা জঙ্গল। আশে পাশে কোথাও কোন বসতি নেই। বাড়িটাতে আমি রাত কাটাতে রাজি হলেও শুভ কোনভাবেই বাড়িতে থাকতে রাজি হচ্ছে না। তার সারা মুখে কিসের যেন একটা ভয় আশ্রয় নিয়েছে। বেশ অস্থির দেখাচ্ছে তাকে।
এক সময় কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে বলেই ফেললাম-
‘‘কি হলো তোর? এতো অস্থির দেখাচ্ছে কেন?’’
শুভ বেশ কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলো তারপর ফিসফিসিয়ে বলল-
‘‘আমার মনে হচ্ছে সারা বাড়িটা জুড়ে একটা অস্বাভাবিক এবং ভয়ংকর কিছু ঘুরে বেড়াচ্ছে।’’
‘‘অস্বাভাবিক?’’
‘‘হুম, এই বাড়িতে আমরা দু’জন ছাড়াও আরো কেউ আছে, ওরাই এই বাড়িতে বসবাস করে। সাধারণত এই বাড়িতে অনেক বছর কেউ থাকে না, হঠাৎ করে আমরা বাড়িটাতে আসায় উনারা বেশ ক্ষেপে গেছেন, যে কোন মুহূর্তে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারেন। আমাদের সাবধান থাকতে হবে।’’
শুভ বেশ রহস্য নিয়ে কথা গুলো বলছে, আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল, এক মুহূর্তের জন্য শুভকে বেশ অচেনা মনে হলো আমার। গলা শুকিয়ে গেল, মুখ দিয়ে কোন কথা বেরুচ্ছে না।
তবুও বললাম-
‘‘কি যা তা বলছিস? কারা বসবাস করে এই বাড়িতে? আমি তো কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।’’
‘‘এই বাড়িটা জুড়ে ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা আছে। আত্মহত্যার ঘটনা, শুনবি?’’
‘‘এই বাড়িতে আজই আমরা প্রথম এলাম, এই বাড়ি নিয়ে যে কোন ঘটনা আছে সেইটা তুই কি করে জানলি?’’
আমার কোন কথার জবাব না দিয়ে শুভ কেমন করে যেন মুচকি হাসলো, বড় রহস্যময় ছিল সে হাসি;
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বললাম-
‘‘এসব এখন বাদ দে, চল্ ঘুমিয়ে পড়ি, অনেক রাত হয়েছে।’’
‘‘তুই ঘুমিয়ে পড়, আমার ঘুমালে চলবে না। আজ রাতে আমার অনেক কাজ।’’ শুভ কেমন যেন আনমনা হয়ে কথাগুলো বলছিল, আমি এক পলকে শুভর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
রাতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম বুঝতেই পারিনি। সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখলাম শুভ মাটির উপর চোখ রন্ধ করে, পিঠ টান টান হয়ে বসে আছে, তার চারপাশে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কি ঘটেছিল সারা রাত? অনেক কৌতুহল আমার বুকের ভেতরটায় তোলপাড় করছে, তবুও শুভকে কোন প্রশ্ন করার সাহস পেলাম না।
এই ঘটনার পর থেকে শুভকে বড়ই রহস্যময় মনে হয় আমার। সারাক্ষণ ঘরে চুপচাপ বসে থাকে। একা একা ফিসফিসিয়ে কারো সাথে যেন কথা বলে, মাঝে মাঝে মাঝরাতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
কোন জলসায় ডাক পড়লে সেখানেও বেশ ভয়ঙ্কর সব ঘটনা ঘটে, কখনো বা মঞ্চে না উঠেই বাড়ি ফিরতে হয়।
এইতো সেদিনের কথা, আমাদের ডাক পড়ল এক গ্রাম্য জলসায়। তবে গ্রামটা অন্য গ্রামের চেয়ে কিছুটা আধুনিক। রাতে গ্রামের চেয়ারম্যানের বাড়িতেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হলো, কিন্তু শুভ কোন ভাবেই চেয়ারম্যানের বাড়িতে থাকতে রাজি হলো না। কারণ জানতে চেয়ে যা শুনলাম তার পরেও ঐখানে থাকার আর সাহস হলো না আমার। ঐ গ্রামের চেয়ারম্যান নাকি তার আপন চাচাকে খুন করে এসব সম্পত্তির মালিক হয়েছে। এখন তার মৃত চাচার আত্মা তার খুনের বদলা নিতে চায়। আত্মাদের নিজস্ব কোন শক্তি নেই। তাই সে শুভর শরীরে ঢুকে চেয়ারম্যানকে খুন করতে চায়।
আমি ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ঐ বাড়ির দারোয়ানকে প্রশ্ন করে জানতে পারলাম, চেয়ারম্যানের চাচা অনেক বছর আগেই খুন হয়েছিল তা ঠিক তবে কে বা কারা খুন করেছিল তা আজো কেউ জানতে পারেনি।
আরো এক জলসার ঘটনা, জলসায় পৌঁছতে দেরি হয়ে যাওয়ায় আমরা দু’জনই দ্রুত পা চালাচ্ছি, এমন সময় এক কবর স্থানের সামনে গিয়ে শুভ আপনা-আপনিই থেমে গেল, তারপর চারপাশে কি যে খুঁজতে লাগলো। আমি রেগে গিয়ে বললাম-
‘‘কি হলো? দাঁড়িয়ে পড়লি যে?’’
‘‘একটা চাঁপা কান্নার শব্দ, শুনতে পাচ্ছিস?’’
আমি কান খাঁড়া করে কিছু একটা শুনার চেষ্টা চালালাম কিন্তু কিছুই শুনতে পেলাম না।
শুভ আবার বলল- ‘‘কান্নাটা কবর স্থান থেকে আসছে, এক দুঃখী মা তার সন্তানের জন্য কাঁদছেন, তার সন্তান পৃথিবীতে বেশ কষ্টে আছে, সে অভাবের মধ্যে দিনকাল পার করছে, কিন্তু সে সন্তান জানেনা তাদের ঘরেই মাটির নিচে তার মা তার জন্য গুপ্তধন রেখে গেছেন।’’
আমি গুরুত্বহীনভাবে বললাম- ‘‘সেটা তাদের মা-ছেলের সমস্যা, তুই দাঁড়িয়ে পড়লি কেন?’’
‘‘মহিলাটি মরে গিয়েও শান্তি পাচ্ছে না, তাই আমার সাথে কথা বলতে চাই।’’
আমি সে রাতে কোনভাবেই শুভকে কবরস্থানে যেতে দিলাম না, কিন্তু পরে খোঁজ করে সে মৃত মায়ের ছেলেকে গুপ্তধনের সংবাদটা জানিয়ে দিয়েছিলাম।
সন্ধ্যার দিকে শুভর বাড়িতে গেলাম, দরজায় পা রাখতেই থমকে দাঁড়ালাম, ঘরটা বেশ অন্ধকার, চারপাশে সুনসান নীরবতা, ঘরের দরজা-জানালা সব বন্ধ তবুও ঘরটা ঠান্ডার হিম হয়ে আছে, আমি বাইরে থেকে শুনলাম, শুভ বিড়বিড় করে কার সাথে যেন কথা বলছে, আমার বুকের ভেতরটা ভয়ে কেঁপে উঠল, শুভ দিনের পর দিন অস্বাভাবিক এবং ভয়ঙ্কর হয়ে যাচ্ছে, তার এই অস্বাভাবিকতা প্রকৃতি মেনে নেবে না, যে করেই হোক তাকে এই পথ থেকে ফেরাতে হবে, তাকে বুঝাতে হবে যে, সে এক ধরনের হেলুসেলুমানের মধ্যে আছে, এসব আত্মা, অশরীরী বলে কিছু নেই, সবই তার মনের ভুল।
এমন সময় শুভ ডেকে উঠল- ‘‘বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আয়, ভেতরে আয়।’’
আমি ঘরে ঢুকতেই আলো জ্বলে উঠল, নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললাম- ‘‘এভাবে অন্ধকারে বসে আছিস কেন?’’
‘‘কি করব বল? ওরা যে আলোতে আসতে পারে না।’’
আমি ঘরের চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম- ‘‘কারা আলোতে আসতে পারে না?’’
শুভ ফিসফিসিয়ে বলল- ‘‘মৃত আত্মা এবং অশরীরী, এরা আলো ভয় পায় ত আমি চমকে উঠলাম।
‘‘মানে?’’
‘‘হুম, মৃত আত্মারাই তো তাদের সমাধানের বিষয় নিয়ে আমার কাছে ছুটে আসে। যেন আমি তাদের আত্মীয়-স্বজনদের সাহায্য করি।’’
ক্ষেপে গেলাম আমি- ‘‘তুই জানিস। তুই পাগল হয়ে যাচ্ছিস?’’
অশরীরী। আত্মা বলে কিছু নেই পৃথিবীতে, সবই তোর মনের ভুল, আত্মাদেরও আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই দুনিয়ায় এত মানুষ থাকতে শুধু সমাধানের কথা তোকে এসে বলে যাবে।’’
আমার কথা শুনে শুভ বেশ অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো, তার চোখে অসহায়ের ছায়া, মুখটা বেশ মলিন দেখাচ্ছে। শুকনো গলায় বলল-
‘‘তুইও আমাকে অবিশ্বাস করলি? আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি, এত বড় কথাটা তুই আমাকে বলতে পারলি, দেখিস, একদিন তুই ঠিকই বিশ্বাস করবি যে, আমি তোকে কোন মিথ্যা বলিনি, সেদিন তুই আমার জায়গায় থাকবি আর আমি………….।’’
আর কিছু বললো না শুভ, আমিও তার অসমাপ্ত কথাটা শুনার জন্য কোন উৎসাহ দেখালাম না।
পরদিন ভোরে আমরা রওনা হলাম, পৌঁছতে প্রায় সারাদিন লেগে গেল, আমি সারা রাস্তা জুড়ে ম্যাজিক গুলো প্র্যাকটিস করছিলাম। কিন্তু শুভকে বেশ নিশ্চিন্ত দেখালো, অন্য সময় হলে আমার চেয়ে শুভর অস্থিরতায় বেশি চোখে পড়তো।
সন্ধ্যার একটু আগেই গ্রামটাতে পৌঁছলাম আমরা, গ্রামের অতিথিশালায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হলো সে এক বিশাল কান্ড, যত্নের কোন ত্রুটি রইলো না। সবাই বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে আমাদেরকে নিয়ে। জলসা শুরু হবার আগেই দূর থেকে লোকজন এক পলক আমাদেরকে দেখবার জন্য ছুটে আসতে লাগলো। অতিথিশালার সামনে লোকজনের বিশাল লাইন পড়ে গেল, তাদের এত উৎসাহ দেখে নিজের মধ্যে কেমন যেন একটা অহঙ্কার জন্ম নিল।
কিন্তু শুভর সেদিকে কোন খেয়ালই নেই, তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে এসব নিয়ে মোটেও উৎসাহী নয়। বরং এসব কোলাহল তার কাছে যেন বেশ বিরক্তিকর ঠেকছে।
বাড়ির এই পাশটা বেশ অন্ধকার। শুভ অন্ধকারে মাথা নিচু করে বসে আছে, আমি তার পাশে গিয়ে বসলাম, শুভ মাথা তুলে তাকালো আমার দিকে। তার চোখ গুলো দেখে আমি অাঁতকে উঠলাম, এই চোখ যেন শুভর নয়। অন্য কারো।
আমি কিছু বলার আগেই সে বলল- ‘‘পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাণী হলো মানুষ, স্বার্থের জন্য পারে না এমন কোন কাজ তাদের নেই। জীব জন্তুরা রক্ত খায় জিহবা দিয়ে। আর মানুষ নামক প্রাণীরা রক্ত খায় চক্ষুদিয়ে, জীবজন্তু রক্ত খাওয়ার আগে শিকারকে ধাওয়া করে আর মানুষ নামক প্রাণীরা শিকারকে ভালোবেসে তাদের রক্ত শোষণ করে। অনেকটা রক্ত খাওয়া পিশাচদের মত। আমার মনে হলো কথাগুলো শুভ’র না, বহু দূর থেকে কেউ যেন কথা গুলো বলছে।
রাত দশটার দিকে আমরা মঞ্চে উঠলাম, একের পর এক জাদু দেখাতে লাগলাম, টানা দুই ঘন্টা জাদু দেখানোর পরেও দর্শক আমাদের ছাড়ছে না, এদিকে আমাদের সকল জাদু বিদ্যা শেষ। আমি কি করব বুঝতে পারছিনা। শেষ পর্যন্ত নাকি গণধোলাই খেয়ে বাড়ি ফিরতে হয়।
এমন সময় শুভ একটি নতুন জাদু দেখালো, যেটা আমাদেরকে শেখানো হয়নি। কিন্তু এ জাদু শুভ শিখলো কোথায় বুঝতে পারলাম না।
জাদুর জন্য দর্শক সারি থেকে একজনকে প্রয়োজন;…. সাথে সাথে একজন মহিলা উঠে এলো, শুভ সেই মহিলাকে প্রথমে কালো কাপড়ে ঢেকে দিল। তারপর ধারালো চাকু দিয়ে মহিলার গলা কেটে ফেলল। গলগল করে রক্ত ঝরতে লাগলো।
এমন জাদু আমি আর আগে দেখিনি, একেবারেই যেন জীবন্ত। আমার মাথা ঘুরে উঠল। এমন সময় বেশ কিছু গুলির শব্দ শুনতে পেলাম, চারপাশে লোকজন ছুটাছুটি করতে লাগলো, আমি দিশেহারার মত হয়ে গেলাম, কি করব বুঝতে পারছিলাম না। চোখ ফিরিয়ে দেখি শুভ নেই।
হঠাৎ মঞ্চে জলসার এক কর্মচারী উঠে এলো, তার নাম রমিজ।
সে ফিসফিসিয়ে বলল- ‘‘আরে মশাই, কি করেছেন আপনারা? সর্বনাশ হয়েছে।’’ আমি বেশ অপ্রস্ত্তত ভঙিতে বললাম- ‘‘কেন, কি হয়েছে?’’
‘‘এই গ্রামে একটা ডাকাত দল আছে। যে মেয়েটাকে নিয়ে আপনার বন্ধু জাদু দেখিয়েছে সে মেয়েটাকে অনেক বছর আগেই ঐ ডাকাতরা খুন করেছিল, এত বছর পর মেয়েটিকে মঞ্চে দেখে ডাকাতদের সন্দেহ হলো যে, মেয়েটি আপনাদের দলের লোক।’’
আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো, বুঝতে পারছিলাম না যে কি বলব, তুবুও কাঁপা গলায় বললাম- ‘‘আমার বন্ধু কোথায়? শুভ কোথায়?’’ ‘‘তাকে ডাকাত দল কিডন্যাপ করেছে।’’
আমি মাটিতে ধপাস করে বসে পড়লাম। রমিজ আমাকে আশ্বস্ত করে বলল- ‘‘অতোটা ভয় পাবেন না, আমরা ডাকাত দলের আস্তানা চিনি, তবে, এখন যাওয়া যাবে না। সকাল হলেই গ্রামের সবাই মিলে সেখানে যাবো। আপনার বন্ধুর কপাল ভালো হলে বেঁচেও যেতে পারে।’’
আমার যেন নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল, একটা মুহূর্তও যেন কাটতে চাইছিল না।
ভোর হতে না হতেই গ্রামের লোকজনসহ ডাকাতদের আস্তানায় গেলাম। দু’তলা পরিত্যক্ত বাড়ি। সেখানে বেঁধে রাখা হয়েছে শুভকে। কিন্তু একি; শুভ’র পাশে ডাকাত সর্দার মরে পড়ে আছে, তার সারা গায়ে জখম, মরা ডাকাতকে দেখে সবাই যেন আনন্দে ফেটে পড়ল, গ্রামের এক স্কুল শিক্ষক উত্তেজিত হয়ে বললেন- ‘‘আপনি জানেন, আপনি কতবড় কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছেন, এমন ধূর্ত সন্ত্রাসীকে পুলিশ পর্যন্ত পাকড়াও করতে পারেনি। আর আপনি তাকে কুপকাৎ করে দিলেন।’’
শুভ শান্ত গলায় বলল- ‘‘আমি এসবের কিছুই জানি না। আমি কীভাবে এতবড় সন্ত্রাসীকে খুন করব, তাছাড়া আমার হাত তো বাঁধা ছিল। সন্ত্রাসীকে খুন করেছে ঐ মেয়েটা, যাকে সে খুন করে মাটিতে পুঁতে ফেলেছিল।’’
কেউ শুভ’র কথা বুঝতে পারলো না। শুধু আমিই বুঝতে পেরেছিলাম, তবুও কোন কথা না বলে বাড়ি ফিরে এলাম।
পরদিন সকালে শুভ’র মায়ের কান্নার শব্দ শুনে ঘুম ভাঙলো, শুভ’র বাড়ি গিয়ে দেখি তার নিথর দেহ বিছানায় পড়ে আছে। হঠাৎ করেই যেন দুর্ঘটনাটা ঘটে গেল। আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে, শুভ আর বেঁচে নেই।
আমি তার লাশটা জড়িয়ে ঢুকরে কেঁদে উঠলাম- ‘‘শুভরে………………।’’
হঠাৎ যেন আমার কাঁধে হাত রেখে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল- ‘‘কাঁদছিস কেন রে? এইতো আমি আছি।’’
আমি চারপাশে তাকালাম, কিন্তু কোথাও কাউকে দেখতে পেলাম না।