গল্পের ১ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
মৌরি বানু এখন বাকহারা। মুখে কিছুই বলতে পারেন না। কেবল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন। আর বুক ফাটিয়ে ‘খক খক’ করে কাশেন।
সলিম আলী সোজা বাড়ি চলে আসেন। আজ তার মনে নতুন একটা ভয় দানা বেঁধেছে। দু’দিন ধরে তার কফের সাথে রক্ত উঠছে। আর মা তো সেই কবে ধরে কাশছেন, তাহলে কি তারও কাশির সাথে…
আর ভাবতে পারেন না সলিম আলী। ব্যথায় গুড়িয়ে যেতে থাকে তার অন্তরটা।
প্রচণ্ড অনুশোচনায় ভুগছে সলিম আলী। রিকসাটা বেড়ার কাছে দাঁড় করিয়ে রেখে সোজা নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন। ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন মায়ের ঘরের দিকে। একপাশে কাঁত হয়ে শুয়ে আছেন তিনি। যেন নিথর একটা দেহ পড়ে আছে। ভীষণ মায়া লাগছে সলিম আলীর।
একবার ভাবলেন মাকে জিজ্ঞেস করবেন তার কাশির সাথে রক্ত ওঠে কি-না। কিন্তু পারলেন না। কোন্ মুখে জিজ্ঞেস করবেন? এতদিন কেন জিজ্ঞেস করেননি?
শুয়ে পড়লেন তিনি, চিত হয়ে। মাথার নিচে দু’হাত রাখলেন। কত কিছুই আজ তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কত কত প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। একটারও জবাব তার জানা নেই। তারপরও উঁকি দিয়েই যাচ্ছে। একটা শেষ হতে না হতেই আরেকটা। উঁহ্! অসহ্য!
মাথাটা প্রচণ্ড যন্ত্রণা করছে। কপালের দু’পাশের রগ দু’টো দপ দপ করে লাফাচ্ছে। এক হাতে চেপে ধরলেন রগ দু’টো।
কাশি পাচ্ছে। প্রচণ্ড কাশি পাচ্ছে সলিম আলীর। কাশতে গিয়ে থমকে গেলেন। মায়ের কাশি শোনা যাচ্ছে। শুকনো গলায় ‘খক খক’ করে কাশছেন তিনি। শুধু তখনই তার দেহটা একটু নড়েচড়ে উঠছে।
গলার মধ্যে কফ জমা হয়ে রয়েছে। কাশতেই হবে। নইলে… ভয়ও পাচ্ছেন ভীষণ। কাশির সাথে নিশ্চিত রক্ত বেরিয়ে আসবে। লাল রক্ত। বাবার কষ্টের রোজগারের টাকায় তৈরি রক্ত। মায়ের প্রশ্রয়ে তিলে তিলে সৃষ্টি হওয়া রক্ত। ধমনী ও শিরায় বয়ে যাওয়া রক্ত। যে প্রাণশক্তি তার দেহের মাঝে বয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত, তাকে সচল রেখেছে, সেই রক্ত!
অতীত দিনের নানান স্মৃতি আজ সলিম আলীর চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আবছা ভেসে উঠছে ছেলের মুখটা। ‘ও এখন কত বড় হয়েছে? দেখতে কেমন হয়েছে। আমার মতো না আমারে বাবার মতো? উচ্ছন্নে যাওয়া বখাটে আমার মতো না আদর্শবাদী শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর আমার বাবার মতো?’ মনে মনেই এসব ভাবেন তিনি।
ছেলেটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। ওরই তো ছেলে। ওরই রক্তে গড়া দেহ।
রক্ত! আবার সেই রক্ত।
আতঙ্কিত হয়ে পড়েন সলিম আলী। রক্ত ওকে তাড়া করে ফিরছে। যেন একপাল নেকড়ে বাঘ তার পেছনে ছুটে আসছে। রক্তলোলুপ জিহ্বাগুলো বেরিয়ে পড়েছে রক্তের গন্ধে। টপটপ করে সেখান থেকে লালা ঝরে পড়ছে। হা হা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে আর তেড়ে আসছে।
ছুটছেন সলিম আলী। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছেন। জীবন বাঁচানোর তাগিদে ছুটছেন। রক্ত বাঁচাতে ছুটছেন।
আবার সেই রক্ত! মুষড়ে পড়লেন তিনি। কিছুটা ঢিল দিলেন ছোটার তালে। তাতে এগিয়ে এলো নেকড়ের পাল। সম্বিৎ ফিরে পেলেন যেন। আবার ছুটলেন।
প্রচণ্ড কাশি পাচ্ছে। তড়াক করে লাফিয়ে নামলেন খাট থেকে। মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে কাশতে লাগলেন। কাশির দমকে প্রচণ্ড উঠানামা করছে বুকটা।
হাফাচ্ছেন তিনি। অবশ্য তা থেমেও গেল একটু পর। এখন তাকিয়ে আছেন মাটিতে, রক্তের দলার দিকে। কাশির সাথে শুধুই রক্ত বেরিয়ে এসেছে। কেমন থকথক করছে লোহিত জোযক কলাটুকু। আশপাশ দিয়ে কিছু মাছিও উড়ছে ভনভন করে।
কেশে উঠলেন মৌরি বানু, সলিম আলীর চির দুখী জননী। তার জন্মদাত্রী।
চমকে উঠলেন সলিম আলী। কেমন উদভ্রান্ত হয়ে গেলেন তিনি। কি করবেন এখন?
উঠে দাঁড়ালেন। ঘরের মধ্যে ছোটাছুটি করতে লাগলেন।
সলিম আলীর ছেলের শরীরেও বইছে একই রক্ত। না, নিরাপদে থাক ছেলে। নিরাপদে থাক তার রক্ত। ওই রক্ত কিছুতেই দূষিত হতে দিতে চান না তিনি।
সলিম আলী এখন ঘরের মেঝেয় পড়ে থাকা এক থোকা রক্তের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কয়েকটা মাছি ভনভন করছে তার উপর।
গল্পের ১ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।