উনবিংশ শতাব্দীর ইংল্যান্ড। দুই ভাই হেনরি ব্যারাউড এবং উইলিয়াম ব্যারাউড। দুজনে মিলে একসঙ্গেই ছবি আঁকেন। মূলত ওয়াইল্ডলাইফ, ফক্স হান্টিং এবং বে হান্টারের ওপর আঁকা সেই সব ছবি প্রদর্শিত হয়েছে রয়্যাল একাডেমিতে, প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন স্পোর্টস ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে, এমনকি এই ছবি থেকেই নাকি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে শিকার নামক খেলাটি। হেনরি-উইলিয়ামের এক তুতোদাদুও ছিলেন শিল্পী। এহেন হেনরির ছেলে মার্ক। এই রকম একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করে তিনিও যে ছবি এঁকেই জীবিকানির্বাহ করতে চাইবেন এটাই তো স্বাভাবিক। তবু ভবিতব্য ছিল অন্যরকম। চিত্রশিল্পী হলেন মার্ক। কিন্তু পারিবারিক প্রতিভা রইল অধরা, অনিবার্য পরিণতি হিসেবে জনপ্রিয়তা, অর্থ সবই সেই পথেই বয়ে চলল। ভাগ্যান্বেষণে ব্রিস্টলে এসেও ভাগ্যদেবীর কৃপাবঞ্চিত হয়েই রইলেন। কাজ একটা জুটল বটে। প্রিন্স থিয়েটারে সেট আঁকা। কত আর উপার্জন হয় তাতে? হতাশাগ্রস্ত মার্ক আশ্রয় হিসেবে বেছে নিলেন মদ্যপান। রোজগারের একটা ভাল অংশ খরচ হয় নেশার পেছনে। এর ওপরে বাড়িতে স্ত্রী আর পাঁচ সন্তান। ফলত দারিদ্র্য হয়ে রইল নিত্যসঙ্গী। বিশৃঙ্খল জীবনযাপন এবং আর্থিক দৌর্বল্য, প্রধানত এই দুটো জিনিসই ১৮৮৭ সালে মাত্র ঊনচল্লিশ বছর বয়সেই মার্কের জীবনে ইতি টেনে দিল।
এই ঘটনার প্রায় তিন বছর আগে এক রাতে মার্ক বাড়ি ফেরার সময় রাস্তায় একরকম কুড়িয়ে পেয়েই সঙ্গে এনেছিলেন একটি কুকুরছানা। বাড়িতে কেউ এলে তার পায়ের পেছন দিকে কামড়ে দেওয়ার এক অদ্ভুত অভ্যাস সেই কুকুরের। ওই অভ্যেস থেকেই তার নামকরণ হয়ে গেল নিপার। মার্কের অবর্তমানে নিপারের মালিকানা গেল মার্কের ভাই ফ্রান্সিসের কাছে। তিনিও আঁকেন। পেশাদার শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার আগে প্রথমে লন্ডনের হেথার্লে আর্ট স্কুলে এবং পরে অন্টেয়র্পের বেয়াক্স আর্টসে প্রশিক্ষণ নিয়ে জনপ্রিয়তা এবং প্রতিভার দিক দিয়ে দাদার চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে থাকলেও কোনও অবস্থাতেই জ্যাঠা বা বাবার সমতুল্য হলেন না। স্বাভাবিক কারনেই টাকা রোজগারের জন্য অনেক কিছুই আঁকতে হয়। লিভারপুলে নিজের স্টুডিওতে বসে তেলরঙ আর জলরঙে ছবি আঁকেন ফ্রান্সিস। সঙ্গে থাকে নিপার। স্যর হারবার্ট ফন হার্কমারের অনুকরণে ফ্রান্সিসও স্টুডিওতে এনে রেখেছেন একটি ফোনোগ্রাফ। যখন মনিব ব্যস্ত ছবি আঁকায় তখন নিপার তার শিঙার সামনে কান খাড়া রেখে টুকটুক করে মাথা নাড়ায় আর বুঝতে চেষ্টা করে কিভাবে কোথা থেকে বের হচ্ছে আওয়াজ।
এভাবেই ধীরে ধীরে কেটে গেল আট বছর। একদিন ফ্রান্সিস সারে-তে মার্কের বিধবা স্ত্রীর কাছে রেখে এলেন নিপারকে। এবার নিপার আর ফিরে এল না। পাড়ি জমাল তার প্রথম মনিবের কাছে। টেমসের ধারে কিংসটনে নিপারের শেষশয্যা গ্রহণের পরে কাটল আরও তিন বছর। ১৮৯৮ সাল নাগাদ নিজের স্টুডিওতে বসে ফ্রান্সিসের হঠাৎ মনে পড়ল নিপারের ফোনোগ্রাফ শোনার কথা। মনে পড়ল নিপার কি রকম একটু হতভম্ব ভঙ্গিতে কান খাড়া করে মাথা নাড়ত। মনে হল বিষয়টি একটি ছবির উপযুক্ত। আঁকতে শুরু করলেন তিনি। ফোনোগ্রাফের সামনে বসে নিপার। শেষ হল আঁকা। না, এই ছবি কোনও কারো প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নয়, আঁকাআঁকি ফ্রান্সিসের জীবিকা। কঠোর পেশাদার ছবিটি আঁকলেন বিক্রি করার উদ্দেশ্য নিয়েই। ১১ই ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯ তারিখে নিয়ে গেলেন এডিসন-বেল কোম্পানিতে। যাওয়ার আগে অবশ্যই নিজের নামে ছবিটির আইনি স্বত্ত্ব পাকাপাকি করে নিলেন। নাম দিলেন ‘ডগ লুকিং অ্যান্ড লিসনিং টু আ ফোনোগ্রাফ’।
ডগ লুকিং অ্যান্ড লিসনিং টু আ ফোনোগ্রাফ – ফ্রান্সিসের আঁকা মূল ছবি
যদিও জানা নেই তারা এই ছবি নিয়ে কি করবে, তবু আশা কদর পাবেন কারণ আর কিছু না হোক, ছবিটির যন্ত্রের প্রস্তুতকর্তা তো তারাই, হতে পারে কোনও কাজে লেগে গেল। কিন্তু ঘটল ঠিক সেটাই যেটা এর আগেও ঘটেছে যখনই ফ্রান্সিস ছবিটা বিক্রির চেষ্টায় বেরিয়েছেন
– আপনাদের যন্ত্রের ছবিই তো রয়েছে!!
– তাতে কি? পাগল নাকি? কুকুর ফোনোগ্রাফ শুনছে? যান যান। যত্তসব গাঁজাখুরি গল্প
যদিও এমন নয় যে এই একটি ছবি বিক্রি হল না বলে ফ্রান্সিস আতান্তরে পড়লেন, তবুও একটু হতোদ্যম হয়ে পড়লেন……… হাজার হোক রুটিরুজির প্রশ্ন। এক শুভানুধ্যায়ী বন্ধুর পরামর্শে ছবিটা একটু পালটালেন। কালো রঙের শিঙা বদলে দিলেন পিতলের শিঙায়। ওই বছরেরই ৩১শে মে দ্বারস্থ হলেন সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া গ্রামোফোন কোম্পানিতে। কথা হল ম্যানেজার ব্যারি ওয়েনের সাথে। এডিসন-বেল সিলিন্ড্রিকাল ফোনোগ্রাফের বদলে তাঁদের নিজস্ব গ্রামোফোনের ছবি থাকলে তাঁরা ভেবে দেখতে পারেন। এ তো সামান্য জিনিস!! এটুকু পারবেন না ফ্রান্সিস? বিক্রির জন্যেই তো আঁকা!!! আর খদ্দের হল লক্ষ্মী। তবে গ্রামোফোন কোম্পানির একটি যন্ত্র তাঁকে দিতে হবে। তিনি ঠিকই পারবেন দেখে দেখে এঁকে দিতে। যন্ত্র পেলেন, প্রয়োজনীয় পরিবর্তন হল, ছবি জমা পড়ল।
গ্রামাফোন কোম্পানির জন্য আঁকা মূল ছবির পরিবর্তিত রূপ
১৫ই সেপ্টেম্বর, ১৮৯৯। অবশেষে অবসান ঘটল অপেক্ষার। চিঠি পেলেন গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে। মঞ্জুর হয়েছে আবেদন। ফ্রান্সিস পাবেন মোট একশ পাউন্ড। পঞ্চাশ পারিশ্রমিক হিসেবে বাকিটা ছবির স্বত্ত্ব বিক্রি করে। এরপর থেকে এর স্বত্ত্বাধিকারী হবে গ্রামোফোন কোম্পানি। ২৯শে অগাস্ট, ১৯২৪ তারিখে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত উপযুক্ত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ফ্রান্সিস তৈরি করেছিলেন এই ছবিটির আরও চব্বিশটি কপি।
ফ্রান্সিস ব্যারাউড গ্রামোফোন কোম্পানির লোগো আঁকছেন
অবশ্য ততদিনে নাম বদলে গেছে ছবির। ১০ই জুলাই, ১৯০০ খ্রীস্টাব্দে ইউনাইটেড স্টেটস পেটেন্ট অফিসে এমিলি বার্লাইনার ৩৪৮৯০ ক্রমিক সংখ্যায় ছবিটি নথিভুক্ত করিয়ে নিয়েছেন ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ ট্রেডমার্কে।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।