
সাত নানা রকম কথাবার্তার আওয়াজে হঠাৎ ওর ঘুম ভেঙ্গে গেল। উঠে দেখে সন্ধ্যে হয়ে গেছে। আর ঘরের মধ্যে গোটা পঞ্চাশ ভূত বকবক করছে। ওকে বিছানায় উঠে বসতে দেখেই একজন বলল – তুমি কে? এখানে কি করে এলে? আর একজন বলছে – এটা ভূতের দেশ জানো না। এখানে কোন মানুষের ঢোকা বারন। ডাইনী জানতে পারলে তোমার রক্ত চুষে খেয়ে নিয়ে তোমাকে মেরে ফেলবে। আর একজন পেছন থেকে বলে উঠলো – একে এখানে আটকে রাখ। আমি এক্ষুনি গিয়ে সর্দারকে খবর দিচ্ছি। তখন রাজকন্যা বলল – তোমরা আগে মাছধরা জেলে ছিলে তো? ডাইনী তোমাদের এরকম ভূত করে রেখেছে। আমি এসেছি তোমাদের মুক্তি দিতে। তোমরা যদি আমার কথা মত কদিন কাজ করো তাহলে আমি এই ডাইনীকে মেরে ফেলে তোমাদের মুক্তি দেব। সবাই মুক্তি পাওয়ার কথায় আনন্দে নেচে উঠলো।
কিন্তু ততক্ষনে সর্দার আরো কিছু ভূতকে নিয়ে এসে হাজির। এসেই আদেশ দিল – ওকে বেঁধে রাখো দড়ি দিয়ে। ডাইনী এলেই ওকে নিয়ে যাবে তার কাছে। যা ব্যবস্থা করার ডাইনীই করবে। সঙ্গে সঙ্গে এক ঝাঁক ভূত এসে ওকে আক্রমন করল চারিদিক থেকে। রাজকন্যা কী করবে ভাবতে না ভাবতে সেই মুশকিল আসান পালক শুরু করে দিল ওর খেলা। সব ভূতের গায়ে এমন সুড়সুড়ি দিতে আরম্ভ করল যে সবাই কাতুকুতুর চোটে অস্থির। হাসছে, কাঁদছে, লাফাচ্ছে, ঝাঁপাচ্ছে, গড়াগড়ি খাচ্ছে। পালক তাও থামছে না। শেষে সবাই হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, সবাই রাজকন্যার পক্ষে। সবাই রাজকন্যাকে সাহায্য করবে। এপাশে সবাই রাজকন্যার পক্ষে চলে যাওয়ার সর্দার গেল খেপে। বলল – ঠিক আছে। রাজকন্যাকে বাঁধার জন্যে আমি একাই একশ। বলে যেই না কাছে এগিয়ে এসে সর্দার রাজকন্যার হাতটা ধরেছে অমনি রাজকন্যা তার গায়ে মূর্ছাফুল ঠেকিয়ে দিল। আর যায় কোথায়? সঙ্গে সঙ্গে সর্দার নিশপিশ অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। রাজকন্যা তখন বোতল থেকে ফিসফিসকে বার করে ওর জ্ঞান ফিরিয়ে দিয়ে সবাই কে বলল – আজ থেকে ফিসফিস তোমাদের নতুন সর্দার। সবাই ওর কথা শুনে চলবে। ফিসফিসের তো আনন্দের আর সীমা নেই। ‘ধিন তা না না’ করে নাচতে শুরু করে দিল। আর সেই বোতলের মধ্যে নিশপিশকে পুরে রাজকন্যা বোতলটা তুলে দিল নতুন ভূতের সর্দার ফিসফিসের হাতে। – দেখি তোমার হাতের জোর কেমন। কত দূরে তুমি একে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারো। ফিসফিস গায়ের জোরে কে-জানে-কোন-রাজ্যে ছুঁড়ে ফেল দিল বোতলটা। আট রাজকন্যা ভূতেদের সঙ্গে একটা জরুরী মিটিং সেরে নিল। রাজকন্যা ও ফিসফিসের সব কথা শুনে চলবে বলে কথা দিল সব ভূত। তারপর রাজকন্যা চিলেকোঠার ঘরে রাজপুত্রের খাটের তলায় লুকিয়ে বসে অপেক্ষা করতে থাকল ডাইনী বুড়ির জন্যে। রাত একটু বাড়তেই হঠাৎ বিকট আওয়াজ করে কেউ যেন উড়ে এসে নামল। ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠলো রাজপ্রাসাদটা। রাজকন্যা দেখল এক ভয়ানক দেখতে ডাইনী জানলা দিয়ে ঢুকে এলো ভেতরে। এসে একটা বিশ্রী কালো রঙের আলখাল্লা খুলে বাইরে রাখল। তারপর রূপ বদলে করে হয়ে গেল এক পরমাসুন্দরী মেয়ে। সে রাজপুত্রের ঘুম ভাঙ্গালো।
রাজপুত্রের সঙ্গে অনেক গল্প করল। খেতেও দিলো। ভালো ভালো খাবারের গন্ধে জিভে জল চলে এলো রাজকন্যার। সেই রাজপ্রাসাদ থেকে চলে আসার পর থেকে তার এই সব খাওয়া জোটেনি। জীবনটাই পালটে গেছে এখন। শরীর মহাশয়-এর ঢের শিক্ষা হয়েছে। গল্প করতে করতে রাজপুত্র একসময় বলল – তুমি রোজ আসো আর রোজ চলে যাও। তোমার সঙ্গে ভালো করে গল্প করা হয়না কোনদিন। আজ তুমি এখানেই থাকো। ডাইনী বলল – থাকতে কি আর আমারই ইচ্ছে করে না? কিন্তু অনেক কাজ। এই তো আর মাত্র কদিন। সামনের পূর্নিমাতেই তো আমরা বিয়ে করব। তারপরে তোমাকে নিয়ে চলে যাব আমার রাজ্যে। তখন অনেক গল্প হবে। রাজপুত্র ভেতরে ভেতরে একটু ভয়ে কেঁপে উঠলো। কিন্তু প্রকাশ করল না। বলল – এত কাজের লোক থাকতে তোমার আবার এত কাজ কী শুনি? – খুব বড় দায়িত্ব আমার উপর। সে তুমি বুঝবে না। – বুঝবো না কেমন? বলে দেখ দিকি। আর কদিন পরে তোমাকে বিয়ে করলে তো আমাকেই তোমার সব দায়িত্ব নিতে হবে। না বুঝলে চলবে কেন? – তা ঠিকই বলেছ।
তোমাকে বলাই যায়। আসলে একটা কই মাছের প্রান রক্ষার দায়িত্ব আছে আমার ওপর। তাকে সারাদিন পাহারা দিতে হয়। – একটা সামান্য কই মাছ তুমি সারাদিন পাহারা দাও? সে দেশে তো তোমার কত চাকর বাকর দাস দাসী। কাউকে একটা পাহারায় বসিয়ে রাখলেই তো পারো। – না, আর কাউকে আমার বিশ্বাস হয় না। এ তো আর যে সে কই মাছ নয়। এই কই মাছের পেটের মধ্যে এক সোনার কৌটে আমার প্রানভ্রমর রাখা আছে। – তাহলে তো খুব জরুরী ব্যাপার। কিন্তু তুমি যে রোজ রাত্রে এখানে আসো তখন যদি কেউ সেই মাছ ধরে নেয় তাহলে কী হবে। তুমি মরে গেলে আমার তো আর কেউ থাকবে না। – দূর! মাছ ধরা কি এত সহজ নাকি। এত গভীর রাত্রে সাতটা সমুদ্র পেরিয়ে কে যাবে সেখানে? তারপর তিন তিনটে দূর্গম পাহাড় টপকে তবে সেই সরোবরে পৌঁছতে হবে। সরোবরে তাকে ধরাও কি আর সোজা কথা। সরোবরের জল যেমন কালো, কই মাছের রঙ ও তেমন কালো মিশমিশে। – যাক শুনে নিশ্চিন্ত লাগছে। এতো কান্ড করে কই মাছ ধরা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। – একেবারেই চিন্তা কোরো না। তাছাড়া সেই কই মাছের পেট থেকে কৌট বার করলেও তো আমার প্রানভ্রমরের নাগাল পাবে না। সেই বাক্স খুলতে চাই এক সোনার চাবি। সে চাবি সবসময় আমার কাছে আমার আলখাল্লার পকেটে থাকে। – এটা খুব বুদ্ধিমানের কাজ করেছ তুমি। তারপর ডাইনী অনেক গল্প করে রাজপুত্রকে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিল। তারপর সেই বিচ্ছিরি কালো আলখাল্লা গায়ে দিয়ে ডাইনী রূপ ধারন করে উড়ে চলে গেল চিলেকোঠার জানলা দিয়ে।
নয়পরদিন সন্ধ্যেবেলা রাজকন্যা সব কথা জানল ভূতেদের। ঠিক হল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেই ডাইনী বুড়ির দেশে যেতে হবে। ভূতেরা বলল তাদের কয়েকজনকে যদি রাজকন্যা সঙ্গে নিয়ে যায় তাহলেই তারা ঠিক কই মাছ ধরে ফেলতে পারবে। সেই কথামত গোটা পঁচিশ সাস্থ্যবান ও শক্তিশালী ভূত বেছে নিল রাজকন্যা। ফিসফিসকে বলল – তুমি এখানেই থাকবে। রাজপ্রাসাদের সবকিছু দেখা শোনার ভার তোমার ওপর। ডাইনী এসে যেন বুঝতে না পারে যে ভূতের সংখ্যা কমে গেছে। আর একটা খুব দায়িত্বপূর্ন কাজও তোমাকে করতে হবে। পরদিন রাত্রে যখন ডাইনী এসে তার আলখাল্লাটা খুলে রাজপুত্রের ঘরে ঢুকবে তখন তার আলখাল্লার পকেট থেকে সোনার চাবিটা বার করে নিয়ে সেখানে একটা লোহার চাবি ঢুকিয়ে দিতে হবে। খুব সাবধানে। খবরদার ডাইনী যেন টের না পায়। ফিসফিস বলল – সে আমি সব করে দেবো। কিন্তু চিন্তার বিষয় হল কি ভাবে যাবে অতদূর দেশে? সাতটা সমুদ্র আর তিনটে পাহাড় পেরোনো তো সহজ কথা নয়। এ দেশে পক্ষীরাজ ঘোড়াও নেই যে তোমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। – কেন? মেছোভূতেরা পারবে না উড়িয়ে নিয়ে যেতে? – কিছুদূর পারবে। কিন্তু ভূতেরা একটানা বেশি দূর যেতে পারে না। অত দূরে যেতে যেতে রাত শেষ হয়ে গেলেই তো আবার সব ভূতেরা সরষে হয়ে যাবে। তখন আর কিছুই করার থাকবে না। – খুব মুশকিলের ব্যাপার হল।
আর তখনই মুশকিল আসান পালক বেরিয়ে এলো তার পকেট থেকে। তার গা থেকে রামধনু রঙের অদ্ভূত এক আলো বেরোতে শুরু করল। আর দেখতে না দেখতে সে একটা ভীষন সুন্দর রামধনু রঙের পাখিতে পরিনত হল। বলল – আমি পক্ষীরানি মায়া। আমার পিঠে চেপে বসো। আমি পৌঁছে দেবো সেই ডাইনী রাজ্যে।
রাজকন্যার তো খুশির শেষ নেই। চেপে বসল পক্ষীরানির পিঠে। সব ভূতরাও চেপে বসল। নীল সমুদ্র, পাহাড়, জঙ্গল, নানা অচেনা দেশের ওপর দিয়ে রামধনুর মতো ওরা ভেসে যেতে থাকল। ভাসতে ভাসতে ঠিক রাত শেষ হওয়ার একটু আগে পৌঁছে গেল ডাইনীর দেশে। তখনও সেখানে সবাই ঘুমিয়ে। ওরা সেই পাহাড়ে ঘেরা কালো সরোবরের পাশে এক গুহায় গিয়ে লুকিয়ে বসে থাকল। দিন হতে না হতেই ভূতেরা হয়ে গেল সরষে আর পক্ষীরানিও ফিরে এলো তার পালক মূর্তিতে।
আবার সন্ধ্যে হতেই ভূতেরা ফিরে পেল নিজেদের শরীর। ডাইনী যেই উড়ে গেল আনন্দ রাজ্যের রাজপুত্রের কাছে অমনি ভূতেরা নেমে পড়ল সরোবরের কালো জলে কই মাছ ধরতে। বেশীক্ষন লাগল না তারা কই মাছ ধরে এনে দিল রাজকন্যার হাতে। সঙ্গে সঙ্গে কই মাছকে ফুলের ঘায়ে অজ্ঞান করে দিল রাজকন্যা। তারপর পক্ষীরানির পিঠে চেপে ফিরে চলল রাজপ্রাসাদে। রাজপ্রাসাদ থেকে একটু দূরে একটা অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে নামল তারা। যাতে ডাইনীর কোন সন্দেহ না হয়। তারপর পালক নিয়ে ভূতের পিঠে চেপে রাজকন্যা পৌঁছে গেল রাজপ্রাসাদে। চুপিচুপি ঢুকলো রান্নাঘরে। ডাইনী তখনও রাজপুত্রের ঘরেই গল্প করছে। ফিসফিসকে ডেকে পাঠালো রাজকন্যা। ফিসফিস আগে থেকেই সোনার চাবি উদ্ধার করে রেখেছিল। রাজকন্যা একটুও সময় নষ্ট করল না। কই মাছের পেট বঁটি দিয়ে এক কোপে কেটে বার করল সোনার বাক্স। সেটা সোনার চাবি দিয়ে খুলে ফেলতেই বেরিয়ে পড়ল ডাইনীর প্রানভ্রমর। বিশ্রী কালো রং-এর ভোমরাকে বঁটি দিয়ে দু’টুকরো করে ফেলল রাজকন্যা। আর সঙ্গে সঙ্গে রাজপুত্র দেখলো তার সামনে বসে থাকা সুন্দরী মেয়েটি এক ভয়ানক দেখতে ডাইনীতে পরিনত হয়ে যাচ্ছে। তার গোটা গা যন্ত্রনায় কালো হয়ে যাচ্ছে। আর ভয়ংকর আর্তনাদ করতে করতে সেই ডাইনী চিলেকোঠার জানলা দিয়ে উড়ে বেরিয়ে গেলো আকাশে। আর দেখতে না দেখতে সব ভূত আর রাজকন্যাদের চোখের সামনেই ডাইনীর বিশ্রী বিশাল শরীরটা আছড়ে পড়ল মাটিতে। সবাই রাজকন্যার জয়ধ্বনি দিয়ে উঠলো।
দশসবাই ডাইনীর শরীরটাকে ঘিরে দাঁড়ালো। রাজকন্যা শুনতে পেল একটা মিষ্টি বাজনা বাজছে কোথাও। চোখে পড়ল ডাইনীর গলায় একটা সোনার হারে একটা ছোট লকেট ঝুলছে। বুঝতে পারল সেই লকেটেই জলতরঙ্গের মত মিঠে বাজনাটা বাজছে। রাজকন্যা তাড়াতাড় গিয়ে লকেটটা খুলে নেয়। তার একটা ছোট্ট বোতাম টিপতেই সেটা বাক্সের মতো খুলে যায়। আর তার ভেতরে জ্বলে ওঠে একটা সবুজ আলো। সেই আলো বাক্স থেকে বেরিয়ে সারা রাজপ্রাসাদ আলোয় ভরিয়ে তোলে। নিমেষের মধ্যে মেছোভূতেরা সবাই আবার মাছধরা জেলে হয়ে যায়।
সেই আলো তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে সারা রাজ্য জুড়ে। সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আওয়াজে ভরে যায় গোটা রাজ্য। রাজপ্রাসাদ ভরে ওঠে রাজা রানি মন্ত্রী সেনাপতি সভাসদ আর সব হারিয়ে যাওয়া মানুষে। রাজ্য ভরে ওঠে জনগনে। রাজপ্রাসাদ আবার ঝকঝকে চকচকে হয়ে যায়। ঝাড়বাতিতে আর সব বাতিদানে আলো জ্বলে ওঠে। ফোয়ারাগুলো চালু হয়ে যায়। হাতি শালে হাতি ঘোড়া শালে ঘোড়া ভরে যায়। সরোবরে টলটলে জল। সেখানে পদ্ম ফুটে ওঠে। রাজহাঁসেরা চরে বেড়ায়। আনন্দ আর ধরে না রাজপুরীতে। রাজপুত্র, রাজা আর রানী সবাই একে অপরকে দেখে খুশিতে আনন্দে ভেসে যায়। সবাই এসে রাজকন্যাকে তাদের প্রান রক্ষার জন্যে অনেক ধন্যবাদ জানায়। ফিসফিস সহ সব মাছধরা জেলেদের তাদের সাহসিকতার জন্যে পুরস্কৃত করা হয়।
আনন্দ রাজ্যের রাজা দূত মারফত নিশ্চিন্ত রাজ্যে খবর পাঠান। মহারাজ অচিন্ত্য সিংহ রাজকন্যা নন্দিনীর খবর পেয়ে খুব খুশী হন। রাজকন্যা ভাজা মাছ উলটে খেতে শিখে গেছে এবং একটা রাজ্যের সবাইকে উদ্ধার করেছে শুনে তাঁর আহ্লাদে আর গর্বে বুক ফুলে ওঠে। সেই খবর ছড়িয়ে পড়ে রাজ্যময়। আর রাজ্যের সব লোকের মাথার চুল আবার আগের মতো কালো হয়ে যায়।
দুই রাজ্যে শুরু হয়ে যায় আনন্দ উৎসব। মহা ধুমধাম করে রাজকন্যা আর রাজপুত্রের বিয়ে হয়। রাজপুত্র অনন্ত কুমার আর রাজকন্যা নন্দিনী সুখে শান্তিতে ও আনন্দে বসবাস করতে থাকে।