আজ আমার সকাল সাড়ে সাতটা থেকে ক্লিনিক ছিল। সকাল সাড়ে পাঁচটায় ঘুম ভেঙে যায়। অন্তুকে স্কুলে পাঠিয়ে ব্রেকফাস্ট না করেই ক্লিনিকে গেলাম। কিছুক্ষণ পর শুরু মাথাব্যথা। ঘুম কম হওয়া বা ব্রেকফাস্ট না করার জন্য এমনটা হয়েছে ধরে নিলাম। সারাক্ষণ মাথাব্যথা নিয়েই বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত রোগী দেখলাম। এই মাথাব্যথার মধ্যেও সারাক্ষণ মাথার মধ্যে যূথীর কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল।
যূথীর সাথে আমার প্রথম পরিচয় একটা মার্কেটে। তখন এই দেশে আমি নতুন, বাঙালি কাউকে পথে-ঘাটে পেলেই নিজের উদ্যোগে কথা বলতাম। বাঙালি মুখ দেখলেই নিজের অতি আপনজন মনে হত, এখনও হয়, তবে এখন আর নিজে থেকে কথা বলি না। একদিন Macy*s-এ মূল্যহ্রাসের কাপড়-চোপড় দেখছি। মানুষ মনে করে এই স্টোরটা দামি স্টোর, আসলে এখানে অনেক কমে জিনিসপত্র পাওয়া যায়। মাঝে-মাঝে কম দামে বেশ দামি জিনিস কেনা যায় এখান থেকে। এমনি জিনিস খুঁজতে-খুঁজতে যূথীর সাথে দেখা। হাতে শাঁখা দেখে নিশ্চিত হলাম বাঙালি হিন্দু, বাঙালি হিন্দুরাই শাঁখা-সিঁদুর পরে। নন-বাঙালি হিন্দুরা শাঁখা-সিঁদুর পরে না। আমি নিজে থেকেই আলাপ করলাম,
: আপনি কি বাংলাদেশি?
: হ্যাঁ, আপনি?
: আমিও, আমার নাম মনোরমা, সবাই ডাকে রমা, কী নাম আপনার?
: যূথিকা, সংক্ষেপে যূথী।
: কতদিন এ দেশে?
: চার বছর (তিন কি চার বলেছিলেন, ঠিক মনে নেই)।
আরও আলাপ করে জানলাম, যূথীর দেশের বাড়ি কুষ্টিয়া, বিয়ে হয়েছে মানিকগঞ্জ জেলায়। ও আমার চেয়ে বছর দুয়েক ছোটই হবে, ওর একটি মাত্র ছেলে। ছেলে অর্কের চেয়ে এক ক্লাস নীচে পড়ে, মানে ছেলেটি অর্কের চেয়ে এক বছরের ছোট। ওরা কুইন্সমলের আশে-পাশে Elmhurst-এ থাকে, আমরাও ওই এলাকায় থাকতাম। প্রথম দিনেই ওর সাথে ফোন নাম্বার আদান-প্রদান করলাম।
পরে আমরা প্রায়ই ফোনে কথা বলতাম। ও আমাকে দিদি-দিদি করত, আমি যূথী বলেই ডাকতাম। ও তখন Duane Reade-এ চাকরি করত। ঢাকা ইউনিভারসিটি থেকে পাস করেছে। দুই ইয়ার সিনিয়র এক ছেলের সাথে প্রথমে প্রেম এবং পরে বিয়ে হয়েছে। ওদের মধ্যে কাস্টের মিল না থাকার কারণে ছেলের অভিভাবকেরা এ বিয়েতে রাজি ছিলেন না। পরে ছেলের কারণে তাঁরা বিয়েটা মেনে নিতে বাধ্য হন। কিন্তু পরোক্ষ রাগ গিয়ে পড়ে যূথীর উপর। তাঁদের ধারণা, যূথী তাঁদের ছেলেকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে বিয়ে করেছে, এ নিয়ে তাঁরা কটূক্তি করতেও ছাড়তেন না। বিশেষ করে, ওরা যখন গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যেত, তখন গ্রামের অশিক্ষিত লোক, দূর সম্পর্কের আত্মীয়রাও এ নিয়ে কটাক্ষ করত। যূথী নীরবে সহ্য করলেও ওর ভালোবাসার মানুষের নীরবতা ওর সহ্য হয়নি। ও পরে যখন এ নিয়ে ওর স্বামীকে জিজ্ঞেস করেছে, ওর স্বামী নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিয়েছে, ‘ওরা ঠিকই বলেছে’। ‘সত্যি বলেছে বুঝলাম, তুমি কিছু বলো না কেন’?– যূথী পালটা জিজ্ঞেস করে।
আমেরিকায় ওরা এসেছিল ডিভি পেয়ে। এখানে এসে প্রথমে চাকরি করেনি, পরে পার্ট-টাইম একটা জব করত। পরে আমার সাথে যখন পরিচয়, তখন Duane Reade-এ চাকরি করত। চাকরি করলে কি, সব টাকাই জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে জমা রাখত। সেই টাকা নিজের মতো খরচ করার অধিকার ছিল না তার।
যূথীর হাসবেন্ডের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল একটা পিকনিকে গিয়ে। খুবই ভালো মানুষ। ওর স্বামী নাকি আমার খুব প্রশংসা করেছিল। এ কথা যূথী ফোনে আমাকে জানায়। একবার পূজায় গিয়ে ওদের সাথে আবার দেখা, আমি দু’জনের সামনেই বলে দিলাম, ‘যূথী পুরুষের কথায় বিশ্বাস করো না, ওদের চোখে সব মেয়ে ভালো, নিজের বউ ছাড়া’। শুনে যূথী হাসতে লাগল, ওর হাসবেন্ড মনে হয় একটু লজ্জা পেল। এর পর আমি ওই এলাকা ছেড়ে ব্রক্সে চলে আসি, এখানে এসেই কলেজে ভর্তি হই। পাস করে চাকরি, একটা সময়ের গ্যাপ হয়ে গেছে। ফোন নাম্বার বদল হয়ে গেছে, যূথীর সাথে সম্পর্কের ছেদ পড়ে যায়।
কিছু দিন আগে আমরা দু’জনে জ্যাকসন হাইটসে গিয়েছি। আমার কর্তা বন্ধুর সাথে আড্ডা দিতে গেল আর আমি একা বাজার করার জন্য প্যাটেল ব্রাদার্সে ঢুকলাম। অল্প কিছু বাজার করে বেরিয়েই দেখি— যূথী, সঙ্গে ওর ছেলে। ওকে দেখেই ওর হাত ধরে ফেললাম। বেশ মোটা হয়ে গেছে, ওর ছেলেও বেশ লম্বা হয়ে গেছে। প্যাটেল ব্রাদার্সের পাশেই নতুন বাংলা রেস্টুরেন্ট হয়েছে, পারস্পরিক কুশল বিনিময়ের পর সেই রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। ছেলে ঢুকতে চাইল না, যূথী ছেলেকে বলে দিল আধ ঘণ্টা পরে ফোন করতে। আমি কিছু শিঙারা আর দু’কাপ চায়ের অর্ডার দিলাম।
এই কয়েক বছরে ওর জীবনের কিছু-কিছু কথা বলে গেল। ও বেশ সহজ সরল। এজন্যই প্রথম থেকে ওকে আমি পছন্দ করি। ও নতুন একটা চাকরি পেয়েছে, স্কুলের চাকরি। এটা সিটি জব, বেতন ভালোই, অনেক বেনিফিট আছে। ও আবার পতি পরায়ণা। যথাসাধ্য চেষ্টা করেও স্বামীকে খুশি করতে পারছে না। স্বামী যা-যা খেতে পছন্দ করে, তা-ই রান্না করে। একটু রান্না এদিক-সেদিক হলেই তীব্র তিরস্কার সহ্য করতে হয়। প্রতিদিন তার জন্য গরম-গরম রান্না করে রাখতে হয়।
কখনো যদি বলে শরীর ভালো নেই, অমনি বলে চাকরি বাদ দাও। এই জন্য ভয়ে নিজের শারীরিক অসুবিধার কথা প্রকাশ করে না। কয়েক মাস চাকরি বাদ দিয়েছিল, তখন অনেক অবজ্ঞা সহ্য করতে হয়েছে। কথায়-কথায় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত। যূথীর কোনো যোগ্যতা নেই, ঘরে বসে খাওয়া আর ঘুম ছাড়া কোনো কাজ নেই। এটা হয়নি কেন, ওটা হয়নি কেন, বাসায় এসেই এমন ব্যবহার করত। যূথীর সাথে বাইরে কোথাও বেড়াতে যায় না, সময় দেয় না। ছুটির দিনে জ্যাকসন হাইটসে গিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়। বউকে যে সময় দিতে হয়, এই বোধটা কখনোই কাজ করে না। ছোট ঘরে বিয়ে করে পস্তাতে হচ্ছে বলেও মানসিক অত্যাচার করে, দেশে যেতে দেয় না। একবার নিজের টাকায় ছেলেকে নিয়ে দেশ থেকে ঘুরে এসেছে। দেশে যাওয়ার আগে অনেক টাকার চেক স্বামীকে লিখে দিতে হয়েছে। কারণ স্বামীর ধারণা, দেশে গিয়ে এই টাকা ভাই-বোনদের দিয়ে আসবে। যূথীর টাকা মানেই তার টাকা, কারণ যূথী তার বিবাহিতা বউ।
যে কাজ করলে যূথী ভালো থাকে সেই কাজ যূথীকে করতে দেবে না। যেমন, গান শুনতে সে খুব পছন্দ করে, স্বামী বাসায় থাকলে গান শুনতে পারে না। যূথী সংসারের সব কাজ একা করে। বাজার করা, রান্না করা, লন্ড্রি করা, ঘরদোর সাফ করা, হাড়ি-পাতিল মাজা— সব কাজ। এর পরেও সব সময় কাজের ভুল-ত্রুটি নিয়ে রাগারাগি করে। স্কুলের চাকরি পেয়ে ও নিজের নামে অ্যাকাউন্ট খুলে সেখানে টাকা জমা রাখে। স্বামীর হুকুম হল, হয় চাকরি ছাড়তে হবে, নয় তো বাসা ভাড়া দিতে হবে। যূথী চাকরি ছাড়বে না, তাই স্বামীর এই দাবি মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু মন থেকে এটা মেনে নিতে পারছে না। এটা ওর কাছে অন্যায় দাবি মনে হচ্ছে।
এইটুকু শোনার পর আমার ফোন বেজে উঠল। আমার সামনে যূথী চোখভরা জল নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ওর দিকে শিঙারা এবং টিসু পেপার এগিয়ে দিলাম। ও টিসু পেপার নিয়ে চোখ মুছল।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।