যাকারিয়া (আঃ)

শ্রেষ্ঠ রাসুলদের একজন

হযরত যাকারিয়ার নাম আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন। তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ রাসুলদের একজন। মহান আল্লাহ গোটা বিশ্ববাসীর উপর যাদের সম্মানিত করেছেন, তিনি তাঁদেরই অন্যতম। তাছাড়া তিনি সেইসব নবী রাসুলদেরও একজন, মানুষকে সত্য পথে আসার আহবান করার কারনে যাদেরকে আল্লাহর দুশমনরা যাদের হত্যা করেছিলো। তাই তিনি একজন শহীদ নবী। তিনি ছিলেন বনী ইসরাইলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাসুল। হযরত ইবরাহীম ও ইয়াকুবের বংশধর তিনি। শুনুন আল্লাহর বানী –

“আর আমি ইব্রাহীমকে ইসহাক ও ইয়াকুবের মতো সন্তান দিয়েছি। তাঁদের প্রত্যেককে আমি সঠিক পথ দেখিয়েছি, যা দেখিয়েছিলাম ইতোপূর্বে নুহকে। একই পথ দেখিয়েছি আমি তাঁদের বংশধরদের মধ্যে দাউদ, সুলাইমান, আইয়ুব, ইউসুফ, মুসা, হারুণকে। মুহসিন লোকদের আমি এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকি। আমি একই পথ দেখিয়েছি যাকারিয়া, ইয়াহিয়া, ইলিয়াস ও ঈসা কে। এরা সবাই ছিলো সংস্কারক। সেই পথই দেখিয়েছি আমি ইসমাঈল, আলইয়াসা, ইউনুস ও লুতকে। এদের প্রত্যেককেই আমি বিশ্ববাসীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।” (সূরা আল আনয়াম ৮৪-৮৬)

 

দীনি নেতৃত্ব

বনি ইসরাইলের দীনি কার্যক্রমের কেন্দ্র ছিল বাইতুল মাকদাস। বনি ইসরাইলের মধ্যে হযরত হারুন (আঃ) এর বংশধর একটি গোত্রের উপর দায়িত্ব ছিল বাইতুল মাকদাসের রক্ষনাবেক্ষনের। হযরত যাকারিয়া (আঃ) ছিলেন এ গোত্রের প্রধান। গোত্রীয় প্রধান হিসেবে তিনিই ছিলেন এই মহান দীনি কেন্দ্রের পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক। তাকেই লরতে হত এই ঘরের সেবা ও পরিচর্যা। দীনের দাওয়াত ও শিক্ষা প্রচার এবং সৎকাজের আদেশ এবং অন্যায় অসৎ কাজ থেকে বারন ও বাধা দানই ছিলো তাঁর দীনি মিশনের মূল কাজ। তিনি ছিলেন আল্লাহর অনুগত দাস এবং সত্য সততা ও আদর্শের মূর্ত প্রতীক।

একটি ছেলে দাও আল্লাহ

কিন্তু হযরত যাকারিয়া এই দীনি নেতৃত্বের উত্তরাধিকারী নিয়ে ছিলেন খুবই চিন্তিত। তাঁর বংশে এমন কোন যোগ্য লোক ছিলো না তাঁর মৃত্যুর পর যে এই মহান দীনি দায়িত্ব পালন করতে পারতো। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। তাই পরবর্তী দায়িত্বের ব্যাপারে তিনি সব সময়ই ছিলেন চিন্তিত। এখন তাঁর বয়েস প্রায় একশো বছর। চিন্তা তাঁর বেড়েই চললো। হঠাৎ ঘটে গেলো একটি ঘটনা। ঘতনাতির আছে একটি পূর্ব কথা, শুনুন তবে সে কথাটি –

হযরত ঈসা (আঃ) এর নানী আল্লাহর কাছে মানত করলেন, হে আল্লাহ, আমার এখন যে সন্তানটি হবে, আমি ওকে তোমার জন্যে নজরানা দিলাম। ও তোমার জন্যে উৎসর্গিত হবে। তুমি এই নজরানা কবুল করে নাও। তিনি আশা করেছিলেন তাঁর একটি ছেলে হবে এবং তিনি ওকে বাইতুল মাকদাসে দীনের কাজের জন্যে বিশেষভাবে নিয়োগ করবেন। কিন্তু মানুষ যা চায় তা হয় না। আল্লাহ যা চান তাই হয়। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর একটি মেয়ে হলো। তিনি মেয়েটির নাম রাখলেন মরিয়ম। মরিয়ম প্রাপ্ত বয়স্ক হলে মানত অনুযায়ী ওকে তিনি পৌঁছে দিলেন বাইতুল মাকদাসে। এখন প্রশ্ন দেখা দিলো, সেখানে ওর দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করবে কে? মরিয়মকে দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করতে এগিয়ে এলেন অনেকে। এ দায়িত্ব পালনের জন্যে এগিয়ে এলেন হযরত যাকারিয়া। আরো এগিয়ে এলেন অন্যান্য গোত্রের ধর্মীয় নেতারা। তারা সবাই দাবী করলেন এ মহৎ সেবা প্রদানের। নিজের দাবী ত্যাগ করছেননা কেউই। ফলে অনুষ্ঠিত হলো কোরা (লটারি)। লটারিতে কার নাম উঠেছে জানেন? যাকারিয়া, হ্যাঁ, হযরত যাকারিয়ার নাম। তিনি দেখাশুনা শুরু করতে লাগলেন মরিয়মকে, এদিকে তিনি মরিয়মের খালু হন। হযরত যাকারিয়ার স্ত্রী এবং মরিয়মের মা সহোদর বন। ফলে মরিয়মের সেবা ও আদর যত্ন হতে লাগলো সুন্দর ও নিখুঁতভাবে। মরিয়ম ই’তেকাফ ও ইবাদাত বন্দেগীর মাধ্যমে নিজের আত্মার অনেক উন্নতি সাধন করেছেন। একদিনের ঘটনা। হযরত যাকারিয়া বাইতুল মাকদাসের সেই নির্দিষ্ট ঘরে দেখতে এলেন মরিয়মকে। কক্ষে ঢুকেই তিনি অবাক। দেখলেন মরিয়মের সামনে সাজানো রয়েছে অনেক সুস্বাদু ফল। এইসব ফল এই মওসুমের ফল নয়। জেরুজালেমে তো এখন এই ফল পাওয়া যায়না। বিস্মিত হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, মরিয়ম এ ফল তুমি কোথায় পেলে?

মরিয়ম – আল্লাহ পাঠিয়েছেন।

এ জবাব শুনে হযরত যাকারিয়ার অন্তরে আশার উদয় হলো। তিনি ভাবলেন, যে আল্লাহ মরিয়মকে বেমওসুমের ফল দিতে পারেন, তিনি ইচ্ছে করলে তো আমাকেও বড়ো বয়েসে ছেলে দিতে পারেন। তিনি দু’হাত উঠালেন আল্লাহর দরবারে। একটি ছেলে চাইলেন আল্লাহর দরবারে। তাঁর সেই দোয়া কুরআনে উল্লেখ হয়েছে এভাবে –

“প্রভু, তোমার বিশেষ ক্ষমতা বলে আমাকে একটি সৎ সন্তান দান করো। তুমি তো অবশ্যি দোয়া স্রবণকারী। ” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৩৭-৩৮)

“যাকারিয়া চুপে চুপে তাঁর প্রভুকে ডাকলো। সে বললো – প্রভু, আমার হাড়গুলো পর্যন্ত নরম হয়ে গেছে। মাথা বার্ধক্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে প্রভু। তোমার কাছে কিছু চেয়ে আমি কখনোই ব্যর্থ হইনি। আমি আমার পড়ে নিজের যোগ্য উত্তরাধিকারী না থাকার আশংকা করছি। এদিকে আমার স্ত্রী হলো বন্ধ্যা। তাই তুমি তোমার বিশেষ অনুগ্রহে আমাকে একজন উত্তরাধিকারী দান করো। যে হবে আমার ও ইয়াকুবের বংশের উত্তরাধিকারী। আর হে প্রভে, তুমি ওকে তোমার পছন্দনীয় মানুষ বানিয়ো।” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ২-৬)

“আর যাকারিয়ার কথা স্মরণ করো। যখন সে তাঁর প্রভুকে ডেকে বলেছিল, প্রভু, আমাকে একাকী ছেড়ে দিও না আর সর্বোত্তম উত্তরাধিকারী তো তুমিই।” (সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৮৯)

আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তিনি যা চান তাই করেন। তিনি কিছু করতে চাইলে বলেন, ‘হও’ আর সাথে সাথে তা হয়ে যায়। তিনি তাঁর দাস ও রাসুল যাকারিয়ার দোয়া কবুল করলেন। তিনি বৃদ্ধ পিতা আর বন্ধ্যা মায়ের ঘরে সন্তান দান করলেন। একটি সুপুত্র। নাম তাঁর ইয়াহিয়া। তিনি হযরত যাকারিয়ার শুধু একটি সুপুত্রই ছিলেন না, সেই সাথে আল্লাহ তাঁকে রিসালাতও দান করেন।”

 

হত্যা করা হলো তাঁকে

এ যাবত পরার পর আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন হযরত যাকারিয়া কোন সময়কার নবী? হ্যাঁ, তিনি হযরত ঈসা (আঃ) এর লাগভাগ পূর্বেকার নবী। তাঁর বয়েসের শেষ আর হযরত ঈসা (আঃ) এর আগমন প্রায় একই সময়। আর এসময়টা ছিল এখন থেকে মাত্র দুই হাজার বছর পূর্বে। এসময় ফিলিস্তিনের ইহুদীরা প্রকাশ্যে যিনা, ব্যাভিচার ও অশ্লীল কাজ করতো। যে দু চারজন ভালো মানুষ ছিলেন তারা ছিলেন নির্যাতিত। পাপ ও পাপিষ্ঠদের সমালোচনা করলে জীবনের নিরাপত্তা ছিলো না।

কিন্তু হযরত যাকারিয়া ছিলেন তো আল্লাহর নবী। মানুষকে অন্যায় অপ্রাধের কাজ থেকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করাই নবীর কাজ। নবী ও নবীর সত্যিকারের অনুসারী ঈমানদারেরা কখনো অত্যাচার ও নির্যাতনকে ভয় পান না। তাঁরা যে কোন পরিস্থিতিতে মানুষকে বিরত রাখার এবং সঠিক পথে ডাকার কাজ করে যান।

হযরত যাকারিয়া বনী ইসরাইলকে মন্দো কাজ করতে নিষেধ করেন। পাপের পথে বাধা সৃষ্টি করেন এবং তাঁদেরকে আল্লাহর পথে তথা সত্য ও ন্যায়ের পথে আসার আহবান জানাতে থাকেন। তাঁর ভালো কাজের আদেশ আর মন্দ কাজের বাধাদানকে পাপিষ্ঠ শাসক আর সমাজের অপরাধী নেতারা বরদাশত করতে পারেনি। তারা হযরত যাকারিয়াকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। শেষ পর্যন্ত অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার কারনে ইহুদী রাষ্ট্রের রাজা ইউআসের নির্দেশে আল্লাহর নবী হযরত যাকারিয়াকে ইহুদীরা হাইকালে সুলাইমানিতে পাথর মেরে হত্যা করে। এভাবে বনী ইসরাইল হত্যা করেছে বহু নবীকে। তাঁদের এইসব জঘন্য হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ করে আল কুরআনে মহান আল্লাহ বনী ইসরাইলকে লক্ষ্য করে বলেন –

“যখনই তোমাদের প্রবৃত্তির কামনার বিপরীত কোন জিনিস নিয়ে আমার কোন রাসুল তোমাদের কাছে এসেছে, তখনই তোমরা তাঁর বিরুদ্ধাচারন করেছো, কাউকেও মিথ্যা বলেছো আর কাউকেও হত্যা করেছো।” (সূরা আল বাকারা, আয়াত ৮৭)

কোন কোন বর্ণনা থেকে জানা যায়, ইহুদীরা হযরত যাকারিয়াকে করাত দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলেছিল।

আল কুরআনে হযরত যাকারিয়া

আল কুরআনে হযরত যাকারিয়াকে অতি উচ্চ মর্যাদার নবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআন মাজীদে তাঁর নাম উল্লেখ হয়েছে সাতবার। যেসব সূরা ও আয়াতে উল্লেখ হয়েছে সেগুলো নিম্নরূপ –

সূরা আলে ইমরানে ৩৭ নং আয়াতে দুইবার। একই সূরা আয়াত ৩৮। সূরা আল আনয়াম, আয়াত ৮৫। সূরা মরিয়ম, আয়াত ২ ও ৭। সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৮৯।

হযরত যাকারিয়া (আঃ) সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্যে পড়ুন- সূরা আলে ইমরানে ৩৫-৪১ আয়াত। সূরা মরিয়ম ১-১৫ আয়াত। সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৮৯-৯০।

 

কি শিক্ষা পেলাম?

আল কুরাআনের আলোকে আমরা হযরত যাকারিয়ার জীবনী থেকে কয়েকটি বড় বড় শিক্ষা লাভ করতে পারি। সেগুলো হলো –

১। পুত পবিত্র জীবন যাপন।

২। আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও বিনয়।

৩। যা কিছু চাওয়ার কেবল আল্লাহর কাছেই চাইতে হবে।

৪। আল্লাহকে সর্বশক্তিমান জানতে হবে।

৫। আল্লাহর কাছে সৎ ও নেক্কার সন্তান প্রার্থনা করতে হবে।

৬। মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকতে হবে।

৭। মন্দ কাজে প্রতিবাদ করতে হবে এবং বাধা দিতে হবে।

৮। ধৈর্য ও দ্রঢ়তার সাথে আল্লাহর পথে অটল থাকতে হবে।

৯। প্রয়োজনে আল্লাহর পথে শহীদ হবার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!