মুসলমান চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁরা চিকিৎসা বিজ্ঞান ও ঔষূধ তৈরীর নিয়মকানুন সম্পর্কিত বই পুস্তক রচনায় অসামান অবদান রেখেছেন। এদের মধ্যে আল রাযী ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ।
ইরানের রাজধানী তেহরান। তেহরানের একটি এলাকার নাম রায়নগর। এখানেই জন্ম হয় আবু বকর মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়ার। সেটা ছিল ৮৮৫ খৃষ্টাব্দ। রায়নগর ছিল একটি শিক্ষা কেন্দ্র। এটি মৃৎ শিল্পের জন্যেও প্রসিদ্ধ ছিল। জন্মভূমির নামানুসারে আবু বকর রাযী নাম ধারণ করেন।
প্রায় ২০ বছর বয়সে বিদ্যা শেখার জন্য তিনি বাগদাদে যান। সেখানে বিখ্যাত চিকিৎসাবিদ ইবনে ইসহাকের কাছে চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেন। রসায়ন শাস্ত্রেও তার অনেক দখল ছিল। বাগদাদে থাকাকালে তিনি গ্রীক চিকিৎসা বিজ্ঞঅন/ইরানী চিকিৎসা প্রণালী এবং ভারতীয় আয়ুর্বেদ শাস্ত্রেও গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি পদার্থ বিজ্ঞান ও দর্শনেও পন্ডিত ছিলেন।
শিক্ষা শেষ হওয়ার পর তিনি কিছুদিন জুন্দেশাপুর বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রে শিক্ষানবিশীকরেন। িএ সময় চিকিৎসক হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সবধরনের রোগী তাঁর কাছে আসতে থাকে। তাঁর চিকিৎসায় রোগী ভাল হয়ে যেত। এর ফলে মানুষ তার দোয়া করতো। তিনি জ্ঞান বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় বেশী মন দিতে পারলেন না। বরং চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়েই সারাজীবন কাটান। সেকালে বাগদাদে তার মতো এত বড় চিকিৎসক আর কেউ ছিল না। তিনি খলিফা আল মুক্তাদিরের প্র্রদান চিকিৎসক ছিলেন। খলিফার অনুরোধে তিনি কয়েক বছর রায়, জুন্দেশাপুর ও বাগদাদে সরকারী হাসপাতালে প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন। িএ সময় পশ্চিম এশিয়অ ও পূর্ব ইউরোপ থেকে দলে দলে রোগীরা নিরাময়ের আশায় তাঁর কাছে ছুটে আসতো। খৃষ্টানরা ও ইহুদীরা পর্যন্ত তার কাছে থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য ভীড় জমাতো।
আল রাযী আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রণালীর মতো তাঁর নিজস্ব প্রণালীতে চিকিৎসা করতেন। তাঁর শিক্ষাদানও ছিল উন্নত ধরনের। তিনি ছাত্রদের হাতে কলমে শেখাতেন। তিনি ছাত্রদর হাসপাতালে গিয়ে রোগীদের সেবা যত্ন করে প্রত্যক্ষ্য জ্ঞান লাভের কথা বলতেন। সার্জারি বা শল্য চিকিৎসাতেও তার জোড়া মেলা ছিল ভার। তিনি গ্রীকদের চেয়ে উন্নত ভাবে সার্জারি করতেন। তখনকার দিনে রাযীর হাতে চিকিৎসা লাভকে রোগীরা আল্লাহর অপূর্ব নিয়ামত মনে করতো। তার হাতে চিকিৎসা করতেই তারা নিজেদেরে নিরাপদ ভঅবতো। রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় তিনি পচুর অর্থ আয় করতে থাকেন। তিনি ৪০ বছর পর্যন্ত চিকিৎসায় নিয়োচিত থেকে বহু জ্ঞান লাভ করেন। তিনি কয়েক বছর নানান দেশে সফর করেন। সে সময় বিভিন্ন দেশের রাজা বাদশাহরা তাকে বহু উপহার দেন।
শেষ বয়সে আল রাযীর দু’চোখে ছানি পড়ে। এর ফলে তিনি অন্ধ হয়ে পনে। তাকে অস্ত্র চিকিৎসা নেয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি অস্বীকার করে বলেন, বহুদিন যাবত আমি দুনিয়ার রূপ দেখে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তিনি ৬৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
আল রাযী আল কেমির চর্চা করতেন। তিনি নানা প্রকার এলকোহলত স্পিরিটও আবিষ্কার করেন। তিনি কিবাতুল আসরার (রহস্যের গ্রন্থ) নামে একটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। জিরার্ড ১১৮৭ খৃষ্টাব্দে এটিকে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদন করেন। চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত এই বইটি ইউরোপের সকল বিদ্যালয়ে পাঠ্য পুস্তক ছিল।
তিনিই প্রথম পদার্থের শ্রেণী বিভাগ করে রাসায়নিক পদার্থকে উদ্ভিদ প্রাণী ও খনিজ হিসেবে বিভক্ত করেছেন। বর্তমানেও তার এই পদ্ধতি আধুনিক হিসেবে স্বীকৃত। খনিজ দ্রব্যকে তিনি তরল ও নিরেট দ্রব্য পাথর, গন্ধক, সোহাগ ও লবনে বিভক্ত করেছেন। তিনি উদ্বায়ী ও অনুদ্বায়ী স্পিরিটে পার্থক্য দেখিয়ে গন্ধক, পারদ, আর্সেনিক ও আল এমোনেয়াককে স্থান দিয়েছেন। তিনি কৃত্রিম উপায়ে বরফ তৈরী করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। কেননা সে সময় পানি থেকে বরছ তৈরীর প্রণালী মানুষ জনত না।
আল রাযী চিকিৎসা বিজ্ঞানে একশোটি বই রচনা করেন। অন্যান্য বিষয়েও একশোটি বই রচনা করেন। প্রায় প্রত্যেক রোগ সম্পর্কেই তিনি ছোট ছোট বই লিখে গেছেন। মানুষের কিডনী ও গল ব্লাডারে কেন পাথর হয় সে সম্পর্কে তিনি একটি মৌলিক তথ্যপূর্ণ বই লিখেছেন। তিনি লাশ কাটার বিষয়েও আলোচনা করেছেন। কিন্তু তিনি বসন্ত ও হাম রোগ সম্পর্কে সর্বপ্রথম বিজ্ঞান সম্মত আলোচনা করেন। এই একটি মাত্র কারণেও তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এ সম্পর্কে তিনি রচনা করেন “আল জুদারী ওয়াল হাসবাহ” নাম গ্রন্থটি। এটি ল্যাটিন ও ইউরোপের সকল ভাষাকে অনুবাদ হয়। শুধামাত্র ইংরেজী ভাষাতেই এটি ৪০ বার মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়।
ইরানে থাকাকালে আল রাযী চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিখ্যাত গ্রন্থ “কিতাবুল মুনসরী” রচনা করেন। ১৫ শতকে এই বইটি ল্যাটিন অনুবাদ প্রকাশ করা হয়। এছাড়া তিনি আরেকটি চিকিৎসা গ্রন্থ কিতাব আল মুলুকী রচনা করেন।
আল রাযীর সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান হচ্ছে “আল হাবী”। এতে সর্বপ্রকার রোগ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়া এটি একই সাথে চিকিৎসা প্রণালী ও ঔষুধের ব্যবস্থা সম্বলিত একখানি অভিধান। এই বিরাট বইয়ের ২০টি খন্ড আছে। সিসিলির রাজা প্রথম চার্লসের আদেশে ইহুদী চিকিৎসক ফারাজ ইবনে সলিম এটিকে ভাষায় অনুবাদ করেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ অবদান হিসেবে আল হাবী ইউরোপীয়দের মনে অসামান্য প্রভাব বিস্তার করে। আল হাবীর নবম খন্ডটি ইউরোপের প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ পাঠপুস্তক হিসেবেষোল শত পর্যন্ত নির্দিষ্ট ছিল। এই বইটিতে আল রাযী প্রত্যেক রোগ সম্বন্ধে প্রথমে গ্রীক, সিরিয়, আরবী, ইরানী ও ভারতীয় চিকিৎসা প্রণালীর বিস্তারিত বর্ণনা দেন তারপর নিজের মতামত ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন। আল হাবী ও আল জুদারী ওয়াল হাসবাহ চিকিৎসা বিজ্ঞানের অসাধারণ গ্রন্থ। তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম চিকিৎসাবিদ এবং বিশ্বের সকল যুগের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকদের অন্যতম। িইবনে সিনা ও রুশ্দের পর আল রাযীর মত কোন মুসলিম মনীষী শিক্ষা ও রেনেসাঁয় তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।
আল রাযীই প্রথম মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসার কথা চিন্তা করেন। তাঁর গ্রন্থে এ ধরনের চিকিৎসার উপকারিতা সম্পর্কে বলা হয়েছে। তিনি ‘মানসিক শরীর’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এতে মনোবিদ্যা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
আল রাযী দর্শন শাস্ত্রে পন্ডিত ছিলেন। সম্প্রতি তাঁর একটি আত্মজীবনীর সন্ধান পাওয়া গেছে। এতে তিনি বলেন, তিনি গ্রীক দর্শন ভালভাবে জানেন। তিনি প্লেটোর দর্শনের উপর ভাষ্য লিখেছেন, অ্যারিষ্টটলের ন্যায়শাস্ত্রের সংক্ষিপ্ত সার রচনা করেছেন। পোরফিরির মতবাদ খন্ডন করেছেন।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।