মোরগ রাজাঃ দ্বিতীয় কিস্তী

মোরগ রাজের শৌর্য-বীর্য, ঢাল-তলোয়ার, বিত্ত-বৈভব, মনি-মানিক্য, চাকচিক্যের কথা দেশে বিদেশে প্রসিদ্ধ। রাজা বিয়ে করেন নি এখনো। আশে পাশের রাজ্যের রাজকুমারিরা রাজার দাসী। সে সব রাজ্যগুলোর অস্তিত্ব এখন মোরগরাজ্যে লীন হয়ে গেছে। মোরগ রাজা রাজ্যের সমস্ত আয় সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ও রাজ প্রাসাদেই ব্যয় করেন। অর্থহীন জনকল্যান, প্রজাপালনে তিনি কোন বরাদ্দ রাখেন না। মানুষের চাহিদার কোন শেষ নাই। খেতে পেলে বসতে চায়, বসতে পেলে শুতে চায়। সুতরাং এসব দিকে নজর দেয়াই ঝামেলা। প্রকৃতিগত ভাবে কেউ রাজা কেই প্রজা। রাজার রাজ জীবন। রাজা শক্তি সঞ্চয় করবে শক্তি প্রদর্শন করবে। যে সমস্ত রাজা শুধুমত্র প্রজাদের ভালমন্দ নিয়েই কাটিয়ে দেয় তাদের মত দূর্বলচিত্ত শৌর্যবীর্যহীন রাজজীবনকে তিনি আন্তরিক ঘৃণা করেন। রাজা হবে রাজার মত। রাজার নাম শুনে বৃক্ষ কুঞ্জেও কম্পন না ধরে থাহলে সে তো রাজা নয়, শেয়াল। মোরগ রাজের নামে আসলেই সবার থরহরি কম্প শুরু হয়।যুদ্ধবিগ্রহ ছাড়া শুধু মাত্র রাজ্যর ভালমন্দ নিয়ে পড়ে থাকার মত কাপুরুষতা তিনি করতেন না। দুনিয়া শক্তির পুজারি। হস্থী বাহিনি, অশ্বারোহী যোদ্ধা, তীরন্দাজ আর অস্ত্র-শস্ত্র বৃদ্ধির দিকেই মনযোগ বেশি।
রুন্ডি জয় করতে মোরগ রাজের মাত্র দুই দিন যুদ্ধ করতে হয়েছিল। তারপর রুন্ডির রাজা, সেনাপতি, রাজকুমার একসাথে বন্দী হয়। তারা এখনো বন্দী হয়ে আছে। মোরগরাজ লুটপাট পছন্দ করেন না। বিজয়ের পর ঘোষণ দিলেন বেসামরিক লোকজন যারা রাজার নিকট নিরপত্তা প্রত্যাশী তারা তাদের অস্থাবর সম্পত্তির অর্ধেক নিজ দায়িত্বে সেনাবাহিনীর নিকট পৌঁছে দেয়। যারা চালাকি করে ফাঁকি দিতে গিয়েছিল তাদের পুরো সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হল। মহারাজের সাথে প্রতারণার দায়ে তাদের কবজি উড়িয়ে দেয়া হল। রাজ্যের সমস্ত, হাতী-ঘোড়া বাজেয়াপ্ত করা হল। রুন্ডির রাজপ্রাসাদ দিনে দিনে বিরান হল। তবে গিরি রাজ্য জয় করতে মোরগরাজের বেগ পেতে হয়েছে। গিরি রাজ্যের তিনদিকে পাহাড়। মোরগ রাজ্য আর গিরি রাজ্যও পাহাড় দিয়ে আলাদা করা। পশ্চিম দিকটা শুধু খোলা। পাহাড় ডিঙিয়ে রাজ্য জয় করা খুব সহজ ছিল না। পাহাড় আর পাহাড়ে অবস্থিত নানা রকমের খনির জন্যই গিরিরাজ্য আক্রমন করতে হয়েছে। গিরিরাজের মত একজন অপদার্থের রাজত্বে এত ভরপুর ঐশ্বর্য কেবল মাত্র প্রকৃতির বিবেচনাহীন বন্টননীতির কারনেই সম্ভব। বনজ আর খনিজ সম্পদে ভরপুর গিরি রাজ্য আর সবুজ শ্যামলে ভরপুর রুন্ডি মোরগরাজের হস্তগত হলে তাঁর গৌরব গগণ স্পর্শ করল। গিরি রাজ্যের সব খনি বাজেয়াপ্ত করলেন।। পাহাড়ী এলাকা সরকারি সম্পত্তি হিসেবে ঘোষনা করলেন। আগের খনি মালিকদের কে তাদের জীবন জীবিকার প্রয়োজনে তাদেরকে সরকারি খনি শ্রমিক হিসেবে বাধ্যতামূলক নিয়োগ দিলেন। এতে খনি মালিকদের জীবিকার ব্যবস্থা হল আবার এতদিন তাঁরা শ্রমিকদের যে শোষণ নির্যতন চালিয়েছেন তার একটা ব্যবস্থা হল। বনজ সম্পদের উপর জনসাধারনের অধিকার সম্পূর্ণ বে-আইনী সাব্যস্ত হল।
এসব রাজ্য জয়ে মোরগের ভূমিকা অপরিসীম। আমরা আগেই জানেছি মোরগ রাজের মোরগগণ আমাদের সাধারণ মোরগের মত নয়। তারা মানুষের ভাষা বোঝে। মোরগরাজ তাদের ট্রেনিং দেন। তাদের ট্রেনিং এর জন্য নিযুক্ত সুনির্ধারিত বাহিনি আছে। তারা তাদেরকে বেশিক্ষণ উড়তে শেখায়, দ্রুত দৌড়তে শেখায়। এই সব মোরগের চঞ্চু খুবই শক্তিশালী ঠোকর দেয়ায় তারা ওস্তাদ। তাদের শেখানো হয় কিভাবে মানুষের মাথায় ঠোকর দেয়া হবে। আর আছে একদল জাদুকর। ছয়ফুট লম্বা জটাধারী বদখত এই সব জাদুকর দেখতে ভয় করে। এই জাদুকররা মোরগের ভাষা বোঝে। রাজা এদেরকাছেই শিখেছেন মোরগের ভাষা। আর অনেক ভেবেচিন্তে বের করেছেন কিভাবে এদের কাজে লাগানো যায়। এখানে বলে রাখা ভাল সব মোরগই কিন্তু ট্রেনিং এ আসে না। মোরগদের একজন আছেন মোরগসমাজের সর্বেসর্বা। তিনি ঠিক করে দেন কারা ট্রেনিং এ আসবে কারা আসবে না। নির্বাচিত মোরগদের প্রথমেই জাদুকররা জাদু করে দেন। জাদুর প্রভাবে এদের মাঝে অসুর জাগ্রত হয়। স্বাভাবিক মোরগ ধর্ম হারিয়ে এদের মাঝে তৈরি হয় এক ধরনের হিংস্রতা। যে সব মোরগ কোন কালেই ট্রেনিং এর উপযুক্ততা লাগ করে না তারা মূলত শেয়ালের পেটেই যায়।

জাদুকর আর রাজার জন্য মোরগ খাওয়া জাদুশাস্ত্রে নিষেদ। মোরগ পেটে গেলে জাদুবিদ্যা বিপরীত ক্রিয়া শুরু করে মস্তিষ্ক বিকৃতি দেখা দিবে। জাদুপ্রাপ্ত মোরগদের সাধারণ মোরগ হতে আলাদা করে দেয়া হয়। তাদের খাবার দাবার সুযোগ সুবিধা সবই সাধারণ মোরগ হতে আলাদা। এদের মাঝে আবার গুটি কয়েক মোরগ বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করে। তাদেরকে গুপ্তচর বৃত্তিতে নিয়োগ করা হয়। তাদের উপর বিশেষ জাদু প্রয়োগ করে তাদের অদৃশ্য করা হয়। ফলে সাধারণ মানুষ তাদের কে আর দেখতে পায় না। কিন্তু অদৃশ্য হবার এই ক্ষমতা অন্য প্রাণি বা মোরগের উপর কাজ করে না। ফলে এই উচ্চ ক্ষমতা সম্মপন্ন মোরগের প্রধান শত্রু এখনো শেয়াল। উচ্চ সাধনায় তৈরি এসব মোরগের অনেককেই শেয়াল হজম করেছে। রাজার মস্তিষ্ক বিকৃতির আশংকা থাকলেও এই সব শেয়ালের সে শংকা ছিল না। রাজা ও জাদুকরগণ কোনভাবেই বের করতে পারল না অতি উচ্চ ক্ষমতা সম্মপন্ন এই মোরগগুলো কিভাবে শেয়ালের বিষ্ঠাতে পরিনত হয়।
বিজিত দুই রাজ্যে রাজা চর হিসেবে মোরগদের ছেড়ে দিলেন আইন অমান্যকারিদের চিহ্নিত করার জন্য। প্রজারা মনে করেছিল দুর্গম অঞ্চলে রাত্রিবেলা রাজ আদেশ অমান্য করলে তা রাজার চক্ষুগোচর হবে না। কিন্তু দেখাগেল পাইকারি হারে নিপিড়নের বোঝা নেমে এল। অপরাধির সাথে সাথে পুরো অধিবাসিদের সকলেই সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের স্বীকার হলেন। গণহারে হত্যা লুন্ঠন চলল। জনগন টের পেল নতুন রাজার চোখ ফাঁকি দেয়া কত কঠিন। চারিদিক যেন নিশ্চুপ নিস্তব্ধ হয়ে এল। কি করতে কি বিপদ আসে কখন কোন আইন জারি হয়, কখন কোন এলাকার জনগনের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয় আবার কখন কার মাথার খুলি উড়ে যায় তা নিয়ে বিপদ। দলে দলে লোক পাশের বিরি রাজ্যে আশ্রয় নিতে লাগল।
দূর্মুখেরা বলে রাজা মোরগের জন্য যে সময় শ্রম আর অর্থ ব্যয় করেন তার কানাকড়িও তিনি প্রজাহিতে ব্যয় করেন না। ইচ্ছে করলে রাজা এদের জিহবা টেনে ছিঁড়ে ফেলতে পারেন। কিন্তু তিনি তা করেন না। তিনি সাধারনত মশামেরে হাত নষট করেন না। তবে বেশি জ্বালাতন করলে ওষুধ দিয়ে দেন। পাশের বিরি রাজ্যের মত তিনি সকলকে যুদ্ধে যেতে বাধ্য করেন না। তিনি জানেন এই হাড্ডি চর্ম সার চাষাভূষারা যুদ্ধে গেলে মকে শুধু খুশি করা হবে। তিনি প্রজাদের জ্বালাতন করেন না। তাদের কোন জ্বালাতনও তিনি পছন্দ করেন না। প্রজারা বিচার নিয়ে এসছিল দস্যুবৃত্তি বেড়ে গেছে।

ডাকাতির শিকার প্রজারা রাজদরবারে এসেছিল প্রতিকার চাইতে। রাজা বললেন ডাকাত ধরে নিয়ে আস আমি বিচার করব। আর প্রজাদের বাড়ি চুরি-ডাকাতি হবে তার প্রতিকার কেন তাকে করতে হবে তিনি তা বুঝতে পারেন না। পুরোটা গাফিলতি বলেই তাঁর ধারনা। তাঁর রাজপ্রাসাদ তো তিনিই পাহারা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। তার জান মাল সম্পদের নিরাপত্তা তো তাঁরই হাতে। প্রজাদের এসব ছোটোলোকি বিষয় আসয় তাঁর রাজকাজে ব্যঘাত ঘটায় ভালই।
গিরিপুর রাজ্যের পর বিরিপুর রাজ্যে। বিরিপুরের সাথে মোরগরাজ্যের কোন সম্পর্ক ছিল না। সম্প্রতি গিরিপুর মোরগরাজের দখলে যাওয়ার পর মোরগ রাজ বিরিপুরের প্রতিবেশি। গিরিরাজ্য দখলের পর শত শত নাগরিক বিরিপুরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। গিরিরাজ্যে বেশ কিছু পাঠশালা ছিল। মোরগ রাজা যদিও পাঠশালাকে সমাজের উপকারী কোন বস্তু হিসেব দেখেন না তবুও তিনি তা বন্ধ করেন নি। তবে পাঠশালা অবশ্যই মাঝে মাঝে রাজার লোক গিয়ে তদারক করে আসবে। এই সব পাঠশালায় মোরগরাজের শৌর্য-বীর্য আর বীরত্ব গাঁথা অবশ্য পাঠ্য। আগের কাপুরুষ রাজা হতে মুক্তি পেয়ে এদেশের পন্ডিত আর ছাত্রদের অন্তত কিছু হলেও পিন্ডি দান করা উচিত। দেশে কিছু কবিও পাওয়া গেল যারা রাজার গুণকীর্তন করে কবিতা লিখবে। আর তা পড়ানো হবে পাঠশালায়। একদল গায়কো জুড়ে গেল যারা সারা রাজ্যে রাজার মহত্ত গেয়ে বেড়াবে। সব পাঠশালা শুরু হবে আর ছুটি হবে মোরগ রাজের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে। বেশিরভাগ পণ্ডিত দ্বিগুণ উৎসাহে রাজার নামে জয়ধ্বনি দিতে লাগলেন। দু একজন উৎকট মূর্খ পন্ডিত মোরগরাজাকে এসব স্তুতির উপযুক্ত মনে করেনি। উলটো ছাত্রদের মাঝে রাজ বিদ্বেষ ছড়াচ্ছিল বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের জীব কেটে দেয়া হল। এ দলের বাকিরা বিরিরাজ্যে পালিয়ে বাঁচল। দলে দলে সাধারণ মানুষও বিরিরাজ্যে ছুটল।

গল্পের তৃতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!