ভারতের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য বন জঙ্গল থেকে উঠে আসা কত আশ্চর্য কাহিনীই না শোনা যায় লোকের মুখে । কিন্তু নিঃসন্দেহে বলা যায় সব কাহিনীর সেরা হল নেকড়ে-বালক মোগলির কাহিনী। ভারতের উত্তর প্রান্তে ছোট পাহাড় ঘেরা এক জঙ্গলের জগতে এখনো ছড়িয়ে আছে মোগলির বন্ধুরা। হয়তো এখনো তারা নিজেদের প্রতিদিনের শিকারের অবসরে মোগলির কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ঘন গাছপালা আর পাতা-লতা ঘেরা এই বিস্ময়কর জঙ্গলে । জানা অজানা অসংখ্য বন্যপ্রাণীর বাস । এদের কেউ সবল, কেউ দুর্বল । কেউ হিংশ্র, কেউ নিরীহ । কারুর খাদ্য মাংস—তারা আমিষাশী ; কেউ খায় ঘাস, লতা-পাতা তারা শাকাশী। এমনি বিচিত্র সব প্রাণীর বাস এই জঙ্গলের রাজ্যে । যেমনি বিচিত্র তাদের জীবনযাত্রা তেমনি অদ্ভুত তাদের জীবনের ঘটনা। রহস্য আর রোমাঞ্চ ঘেরা জঙ্গলের পশুরাজ্যে কত বিস্ময়কর ঘটনাই না ঘটে। সব ঘটনার খবর মানুষের জগতে সব সময় কী আর পৌছয় । কখনো-সখনো দু’একটি ঘটনার কথা জঙ্গলের সীমানা অতিক্রম করে মানুষের গাঁয়ে গিয়ে পৌছয় যখন, তখন বিস্ময় ও কৌতুহলের আলোড়ন ওঠে। অরণ্য-শিশু মোগলির ঘটনা জানাজানি হবার পর এমনি আলোড়ন পড়েছিল অরণ্যপ্রান্তের চাষীবাসি মানুষদের গ্রামে। সেখান থেকে ক্রমে শহরে গঞ্জে । সে-কাহিনীই এখন তোমাদের শোনাব। মোগলি মানুষের ছেলে। কিন্তু শিশু বয়স থেকে তাকে মানুষ করেছিল এক নেকড়ে-মা। নেকড়ে-মা আর নেকড়ে-বাবার সঙ্গে সে তাদের পাহাড়ি গুহাতেই বড় হয়ে উঠেছিল। নেকড়ে মা-ই আদর করে তার নাম দিয়েছিল মোগলি। নেকড়েদের ভাষায় মোগলি কথার কী যে মানে তা কারুর জানা নেই ; মোগলি নিজেও হয়তো জানত না। তবু ওই নামেই সে তার পরিচয় দিত। এবারে শোন মোগলির জীবনের রোমাঞ্চকর কাহিনী। আকাশ-উঁচু গাছপালা আর তাদের পত্র-পল্লবের তলদেশে, ঘন ঝোপ-ঝাড়ের আড়ালে আবড়ালে, শুকনো পাতায় মচমচ শব্দ তুলে, কখনো বা নিতান্তই নিঃশব্দে বিচরণ করে অরণ্যবাসী জন্তু-জানোয়ার। অরণ্যই তাদের আবাসভূমি । অরণ্যই তাদের পৃথিবী। এই পৃথিবীর দুটি স্তর। একটি মাটির কোল ঘেসে-তাকে বলে প্রথম তল । আর দ্বিতীয় তল হল গাছের ওপরের শাখাপ্রশাখার জগৎ। বানর আর হনুমানদের পাশাপাশি এই দ্বিতলে বসবাস করে পক্ষীকুল। পুরোপুরি বসবাস না করলেও দ্বিতলে মাঝে মাঝে বিচরণ করে আরো কিছু প্রাণী। এদেরই মধ্যে একজন হল বধিরা। বঘিরা হল বাঘেদেরই নিকট আত্মীয় হিংস্র জানোয়ার প্যান্থার (চিতাবাঘ)। দেখতে-শুনতে বাধেরই মত—বাঘের সমাজেই এর গণ্য। তবে বঘিরার গায়ের রং কিন্তু হলুদ নয় ডোরাকাটা বা ফুটকাটাও নয়। বঘিরা ছিল মিশমিশে কাল রঙের এক প্যান্থার। সে বুনো মোষের মত সাহসী আর আহত হাতির মত বেপরোয়। তার দেহটা হাল্কা শক্তসমর্থ ও ভয়ঙ্কর। তার গায়ের চামড়া ছিল লোমের মত নরম । বধিরা ছিল এমনই সজাগ আর চতুর যে তার চোখ ও কান সর্বত্র খোলা থাকত। বনের পথ ধরে সে যখন চলত, শুকনো পাতায়ও তার পায়ের শব্দ উঠত না। আর চোখের পলকে সে যখন-তখন মাটি ছেড়ে অবলীলায় গাছের ডালে চড়ে বসতে পারত। নিঃশব্দ কিন্তু নিৰ্ভীক ছিল বাঘিরার চলাফেরা। জঙ্গলের কাউকে তোয়াক্কা করে না সে। তার বেপরোয়া স্বভাব আর হিংস্রতার খবর রাখে না এমন প্রাণী জঙ্গলে একটিও নেই! তাই দায়ে না পড়লে তার কাছ ঘেঁসত না কোন জন্তু। তবে জঙ্গলের প্রাণীদেরও তো একটা সমাজ থাকে। সেই সমাজের সভাসমিতিতে, আলাপ-আলোচনার সময়কালে হিংস্র নিরীহ, ঘাস-খেকো, মাংস-খেকো সব প্রাণীই মেনে চলে জঙ্গলের অলিখিত নিয়ম। নিজেরাই নিয়ম করে সেই নিয়ম ভেঙে অনিয়মকেই নিয়ম করে নিতে অভ্যস্ত কেবল দু পেয়ে মানুষের সমাজ । বাঘিরা নিজে যতই বেপরোয়া আর বুদ্ধিমান হোক না কেন, সে ভুল করেও কখনো জঙ্গলের নিয়ম ভঙ্গ করত না। সময়টা তখন বসন্তকাল । গাছে গাছে নতুন কচিপাতা আর রঙবাহারি ফুলের সমারোহ। হাওয়ার গায়ে চনমনে ভাব-পাখিদের গলায
় নতুন সুরের গান—পশুদের মনে ফুর্তির জোয়ার। বনে জঙ্গলে সর্বত্রই একটা খোলামেলা ভাব। এমনি দিনে বাঘিরাও খোলামেলা মন নিয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছিল জঙ্গলের এক প্রান্তে। কখনো মাটিতে, কখনো বা গাছের ডালে-জঙ্গলের দ্বিতীয় তল যাকে বলে। আপন খেয়ালে চলেছে বধিরা। এমনি সময়ে হঠাৎ একটা অদ্ভুত বিদঘুটে শব্দ তার সজাগ কানে এসে লাগল। শব্দটা আসছিল একটা উঁচু গাছের গোড়া-ঘেঁসা ঝোপের ধার থেকে। —ওঁয়া—ওঁয়া—ওঁ—ওঁ—আ– কান খাড়া করে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বাঘিরা। শব্দটা চিনতে কিন্তু সময় লাগল না তার। চমকে উঠে গাছের ওপরতলা থেকে মাথা ঝুঁকিয়ে ঝোপটার দিকে সন্ধানী দৃষ্টি ফেলল।
গল্পের দ্বিতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।