মেঘের সমুদ্র

মেয়েটার চকলেট খুব পছন্দ। আমার হাতে বেগুনি রংয়ের মোবাইল দেখে সেটাকে ক্যাডবেরি ভেবেছিল। তাই ভেবেছিলাম এখান যাওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে তাকে এক প্যাকেট চকলেট দিব। কিন্তু …. দিতে পারিনাই।

মেয়েটার নাম অশ্বিনী। ফ্লাইট এটেন্ডেন্ট হিসেবে কাজ করে। সুন্দরী বলতে যা বোঝায়, অশ্বিনী তা না। কিন্তু তার পরেও মেয়েটার চটপটে ভাব আমাকে প্রথম থেকেই তার দিকে আকর্ষন করেছিল।

অশ্বিনীর সাথে আমার পরিচয় দিল্লিতে একটা হোটেলে। “মও”, আপনি “love at first sight ” এ বিশ্বাস করেন কিনা জানিনা, অশ্বিনীকে দেখে আমার সেই অবস্থা হয়েছে। দেখলাম, বিশাল এক গ্লাসে করে মেয়েটা স্ট্রবেরী মিল্ক শেক নিয়েছে। ভাবলাম, এতটুকু মেয়ে এতটা খেতে পারবে?

নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার কিছুক্ষণ বৃথা চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত না পেরে পরিচিত হতে গেলাম। সেখানেই মেয়েটার সাথে কথাবার্তা হল, সামান্য পরিচয় হল। তখনই আমার মোবাইল দেখে সে প্রায় কেঁড়ে নিতে যাচ্ছিল, পরে নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করল, “ওটা চকলেট? ” আমি সজোরে হেসে বললাম, ” না রে ভাই এটা আমার মোবাইল। ” মেয়েটা লজ্জা পেয়ে বলল, “ওহ্, আমি ভেবেছিলাম ক্যাডবেরি। ”

আমি কাজে এতই ব্যস্ত থাকলাম পরের দুইদিন যে পরিচয় হবার পর মেয়েটার সাথে ঠিকমতো কথাও বলতে পারলাম না। কিন্তু এই দুইদিনই মেয়েটাকে দেখতাম দূর থেকে, হাসতে, কথা বলতে। একটা অস্বাভাবিক ভাললাগা কাজ করতো। মেয়েটার হাসি খুব সুন্দর, ঈশ্বর না জানি কি দিয়ে বানিয়েছে মেয়েটাকে!

যাওয়ার আগেরদিন রাতে ডিনারে অশ্বিনীকে বললাম, “আমি আগামীকাল ভোরে মুম্বাই চলে যাচ্ছি। যাওয়ার আগে কি আপনার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলা যাবে? ” অশ্বিনী অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, “আমার সাথে? কি কথা? ” আমি কিছু বলার আগেই মেয়েটা বলল, “আচ্ছা, ভোরে আমি লবিতে আসব। ” বলে একটা লাজুক হাসি দিয়ে চলে গেল।

বুঝলেন মও, কপাল খারাপ হইলে যে কত রকমের খারাপ হইতে পারে। মেয়েটা আসল না। এইদিকে আমার বাস ছেড়ে দিবে একটু পরেই। করলাম কি, অশ্বিনীর জন্য একটা নোট লিখে রিসিপশন এ রেখে আসলাম, সেখানে আমার এয়ারপোর্ট টার্মিনাল নম্বর লেখা ছিল। যদি মেয়েটা আসে!

পুরোটা রাস্তা চোখ বন্ধ করে আসতে আসতে শুধু মেয়েটার কথা মনে হতে লাগলো। কোটের পকেটে চকলেটের প্যাকেট, একটু পর পর হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখছিলাম যে ঠিকঠাক আছে কিনা। টার্মিনালে দাঁড়িয়ে পুরো আধা ঘন্টা মেয়েটার জন্য অপেক্ষা করলাম, আসল না।

বুকের ভেতর একটা দশমনি ওজনের পাথর নিয়ে ইমিগ্রেশন ক্রস করলাম। কিন্তু বারবার পেছনে তাকাচ্ছিলাম আর পকেটে হাত দিয়ে চকলেটটা ধরছিলাম। ফ্লাইটে উঠার ঠিক আগ মুহুর্তে আমার মনে হল, না! এই চকলেট অন্তত অশ্বিনীকে না দিয়ে আমি মুম্বাই যাচ্ছিনা। কি মনে করে পেছনে তাকালাম, দূরে ঝাপসা ঝাপসা কি যেন দেখতে পাচ্ছিলাম, এক মুহুর্তের জন্য মনে হল, আরেহহ অশ্বিনী!

কোনমতে পাসপোর্টটা পকেটে ঢুকিয়ে দৌড় দিলাম সেইদিকে!
…………………………………………….
“তারপর? মেয়েটা এসেছিল? ” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

দিগ্বিজয় বলল, “নারে ভাই, সেটা অন্য এক ফ্লাইট এটেন্ডেন্ট ছিল। যখন বুঝলাম যে মেয়েটা হয়তো আর আসবেনা, ফ্লাইটের দিকে আবার রওনা করলাম। আর এই এখন আপনাকে গল্পটা শোনালাম। খুব ইন্টারেস্টিং না গল্পটা? “

আমি বল্লাম, “হুম, খুব ইন্টারেস্টিং! তা এখন আপনি কি করবেন? মেয়েটাকে খুঁজে বের করবেন না? “

দিগ্বিজয় একটা দিগ্বিজয়ী হাসি দিয়ে বলল, “খুঁজবো না মানে? সে কোন ফ্লাইটের এটেন্ডেন্ট তা তো জানিই। দরকার হলে রোজ আকাশে উড়ব অশ্বিনীকে খুঁজে বের করার জন্য! মও, আপনি তো গল্প লিখেন, আমার এই অদ্ভুত প্রেমের কাহিনী নিয়ে একটা গল্প লিখে ফেলেন না কেন? অবশ্যই লিখবেন কিন্তু! “

আমি বল্লাম, “জ্বি, চেষ্টা করব! চকলেটটা কি করেছেন? “

দিগ্বিজয় মাথা চুলকে বলল, “ভাই বিশ্বাস করেন, এত ক্ষুধা ছিল পেটে, না পারতে খেয়ে ফেলেছি! সমস্যা নাই, পরেরবার বেশি করে নিব চকলেট যাতে ক্ষুধা লাগলেও খেয়ে ফেলতে পারি। ” বলে হাহা করে হাসতে লাগল।

বাইরে তখন মেঘের সমুদ্র, এই সমুদ্রের উপর দিয়ে বিকট গর্জন করে প্লেন ছুটে চলেছে। প্রেমের জন্য সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করা মানুষ আছে, কিন্তু প্রতিদিন মেঘের সমুদ্র পার করার মত এই প্রথম কাউকে দেখলাম!

দুঃখিত!