মেঘারণ্যে-১

মনে সুখ থাকলে নিজের জরাজীর্ণ বসতবাড়িটাও প্রাসাদতুল্য মনে হয়, আর ভ্রমণের সাধ জাগলে রেলের লক্কড়ঝক্কড় ট্রেনও উন্নত যান হিসেবে ধরা দেয়। এখানে যাত্রীদের বিনোদনের জন্যে কিছু না থাকলে কি হবে, পাশেই জানালাটা খোলা আছে- প্রকৃতি, পরিবেশ ও লোকালয়ভেদে সেখানে একের পর এক দৃশ্যপট পাল্টে যাচ্ছে। এখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা অপ্রতুল হলে কি হবে- কালিঝুলি মাখা কোচ ফ্যানগুলো তো ঘুরছে, হোক সেটা ঢিমেতালে।

অবশ্য দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর এই পদ্ধতি অধরা যতটা সহজভাবে মেনে নিয়েছে, নিবিড় ততটা নয়। বারবার প্রতীককে গালাগাল দিচ্ছে আর বলছে, “শালা, আর ট্রেন পাইলি না!”

প্রতীক ভেবে পায় না নিবিড়ের এত রাগ আসে কোত্থেকে। টিকেট করার সময় ট্রেন তো আর ডিসপ্লেতে থাকে না যে কোনটা কেমন চড়ে দেখে নিবে।

সুজানার আপাতত এসবে কোন মনোযোগ নেই। কানে ইয়ার-ফোন গুঁজে দিয়ে ও এখন নখে নেইল-পলিশ ছোঁয়ানোয় ব্যস্ত, যেন সহসাই কোন এক তরুণ এসে ওর হাত ধরে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বসবে, নখে নেইল পলিশ না দেখলে তরুণটি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যাবে।

নিবিড় ভাবছে এই সুজানা আর প্রতীকের যন্ত্রণাই কি ওর জন্যে যথেষ্ট ছিল না, যে আবার উটকো ঝামেলা হিসেবে অধরা এসে জুড়ে বসেছে।

মেয়েটার এভাবে ওদের সাথে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারটা নিবিড়ের কাছে এখনও এক রহস্য। গত কয়েকদিন কতভাবে বলা হয়েছে ওকে, রাজী হয়নি। অথচ আজ সকালে হুট করে ফোন দিয়ে জানাল যে ও যাচ্ছে।

এই রকম শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী মানুষ নিবিড়ের একদম পছন্দ নয়। ওদের আরেক ক্লাসমেট বাসা থেকে যাওয়ার অনুমতি পায়নি বলে, নইলে এই সময়ে এসে টিকেট ম্যানেজ হতো কোত্থেকে।

অধরা নিজেও অবশ্য কম রহস্যময় নয়। মেয়েটা এতদিন হয়ে গেল ওদের চেনে, অথচ এখনও পর্যন্ত কাউকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করেনি। সুজানাকে ‘তুমি’ আর অন্যদের ‘আপনি’- এটা কিছু হলো!

ট্রেন চলছে অলস গতিতে।
নিবিড় ভাবছে ও পরবর্তী স্টেশনে নেমে যাবে কি না। এভাবে যাওয়ার কোন মানে হয় না। এমনিতেও এ ট্রিপের খরচটা অনেক কষ্টে ম্যানেজ করেছে ও- ক’টা দিন নিজের সকল যন্ত্রণা ভুলে থাকার জন্য। কিন্তু পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে না এ যাত্রা সুখকর হবে।

প্রতীকের ওপর ওর মেজাজ সপ্তমে চড়া। অথচ এ নিয়ে প্রতীকের কোন মাথা ব্যথা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। নির্বিঘ্নে বকবক করে যাচ্ছে ও। সুজানার কাছে জানতে চাইছে রেলভ্রমণের এমন একটা দিক সম্পর্কে যেটা বাসভ্রমণে নেই।

সারাদিন রূপচর্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকা মেয়েদের জ্ঞানচর্চার পরিধি থাকে শিশুদের মতন। অনেক ভেবেচিন্তে ও বলল, “ট্রেন যাওয়ার সময় বাস সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকে, যেমনটা আমি যাওয়ার সময় ছেলেরা থাকে।”

প্রতীক অবজ্ঞার স্বরে বলল, “বলেছে তোকে!”

“তা নয় তো কী?”

প্রতীক বলে, “বলব?”

সুজানা বলে, “ডেফিনিটলি!”

প্রতীক এবার একটা রহস্য তৈরি করে শেষটায় গিয়ে বলল, “আরে, ট্রেনে টয়লেট আছে, বাসে নেই।”

“এইটা কিছু হইল!”

ওদের কথা শুনে নিবিড়ের মনে হলো দুইটাকেই আবার স্কুলে ভর্তি করানো দরকার।

আবহটা ভালোই জমিয়েছিল প্রতীক। অধরাও ভাবছিল কী হতে পারে উত্তরটা। ও মনে করেছিল প্রতীক হয়ত বলবে ট্রেন ভ্রমণে এমন অনেক কিছুই উপভোগ করা যায় যেটা বাস ভ্রমণে সম্ভব নয়। যেমন ট্রেন যখন নির্জন পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে তখন চারপাশের প্রকৃতি মনের গভীরে এমন এক অনুভূতি রেখে যায়, যা স্মৃতির বারান্দায় লতানো গুল্মের মতোই সজীব। তাছাড়া ট্রেনের নামগুলোও তো অদ্ভুত সুন্দর। ওরা যেটায় আছে সেটার নাম নীলাচল এক্সপ্রেস। যাত্রা শুরুর আগে অধরার খুব ইচ্ছে করছিল ট্রেনের দুই হাতল ধরে ঝুলে ছবি তোলার। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এক ধরনের সঙ্কোচ কাজ করায় ও তখন কিছু বলতে পারেনি।

অধরার এটা প্রথম রেলভ্রমণ। প্রথম অভিজ্ঞতাতে খুব সাধারণ ব্যাপারগুলোও এক ভিন্নরকম আবেদন তৈরি করে। অধরা জানালা দিয়ে বাইরের রোদ ঝলমলে আকাশ দেখছে, কখনও রেলসেতুর নিচ দিয়ে বয়ে চলা নদী, কখনওবা বিস্তীর্ণ সবুজে চোখ বুলাচ্ছে। কামরার ভেতরের যাত্রীদেরও দেখছে এক-আধবার। সেই লোকটা যে ট্রেন ছাড়ার আগে সীট নাম্বার ভুল করে ওদের একটি আসনে গা এলিয়ে বসে ছিল, সে এখনও বিরক্তিভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে- যেন ওরাই তার সীট দখল করে বসেছে। এক বৃদ্ধা কী নিয়ে যেন চেঁচামেচি করছেন- একটা বয়সে গেলে মানুষের মেজাজ হয়ত খুব খিটখিটে হয়ে যায়। ওপাশের জানালার ধারে বসা যাত্রীটি তার মুঠোফোনে কিছু একটা করছে, পাশের অপরিচিত যাত্রীটি হা করে দেখছে সেটা- অন্যের ব্যাপারে আমাদের আগ্রহের কমতি নেই। ছোট্ট মেয়েটি আদুরে গলায় বাবাকে ট্রেন নিয়ে নানান প্রশ্ন করছে- ওরও হয়ত এটা প্রথম রেলভ্রমণ।

সহসা সেই ছোট্ট মেয়েটির মাঝে অধরা নিজেকে কল্পনা করতে থাকে, আর তার বাবার জায়গায় ওর বাবাকে। মানুষ যে জীবন বাস্তবে যাপন করতে পারে না, সে জীবন হয়ত কল্পনায় যাপন করে। অধরা ভাবে, ছোট্ট মেয়েটি হয়ে ও যদি পারত বাবার সাথে এমন একটা ভ্রমণে বের হতে। মানুষ চাইলেই সব পারে, আবার অনেক কিছুই পারে না। সে চাইলেই পারে না অনেক ভালো লাগার মাঝে নিজের কষ্টগুলোকে বিলিয়ে দিতে। কষ্টগুলো চাপা যন্ত্রণা হয়ে ভেতরে ভেতরে গুমরে ওঠেই।

অধরা জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। ট্রেন এখন একটা বাঁক নিয়েছে। জানালা দিয়ে পেছনের বগিগুলো দেখা যাচ্ছে। অধরার ইচ্ছে করছে পুরো ট্রেনটা একবার ঘুরে দেখার- একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। কিন্তু একা যেতে মোটেও মন চাইছে না। কাকে নিয়ে যাবে ও? প্রতীক ঘুমে ঢুলুঢুলু। সুজানা ফোন নিয়ে ব্যস্ত। ও কি নিবিড়কে বলবে?

নিবিড় কপাল কুঁচকে রাগী-রাগী একটা মুখ করে রেখেছে। এখন ওকে কিছু বলা ঠিক হবে না। যদি হুংকার দিয়ে উঠে!

অধরা চুপচাপ বসে থাকে।

দুঃখিত!