মৃুক্তি পাখির লড়াই— তৌহিদ-উল ইসলাম

হঠাৎ চৈত্র মাসের মধ্যখানে পাকিস্তানি মিলিটারী এসে স্কুলে ভর্তি হল। আমাদের অনেকেই তখন ছাড়পত্র নিয়ে চলে গেল ভারতে।পড়াশুনার জন্য নয়,আত্মরক্ষার জন্য এই চলে যাওয়া। মিলিটারী বলতে স্বপনের বাবা। স্বপন আমাদের সাথে পড়ে। তাই মিলিটারী সম্পর্কে আমাদের ধারনা প্রচুর।কিন্তু এমন খারাপ ধারনা আমাদের মধ্যে কখনই ছিল না। ওরা স্কুলটা দখল করে নিল ,ভাল কথা। ওখানেই থাকুক। তাতে রফিক স্যারের জ্বালাতন থেকে বাচি। কিন্তু নেকড়ে বাঘের মত ওরা রাতের বেলা নানান অঘটন ঘটাচ্ছেÑ তা স্বয়ং স্বপনের বাবা হলেও মেনে নেয়া যায় না।
করতোয়া নদীর ওপাড় থেকে অনেক লোকজন এপাড়ে চলে এসেছে। স্কুলের আশে পাশের বাড়িগুলো প্রায় জন শূন্য। এখন নদীতে কোন জেলে নৌকা পর্যন্ত নেই। সব ডুবিয়ে রাখা হয়েছে। যাতে সহসা মিলিটারী নদী পার হয়ে আসতে না পারে। মাঝে মধ্যে নদীর ভাটিতে মেয়েদের লাশ ভেসে ওঠে। খবর আসে ভাটি থেকে উজানে। অনেকে দেখতে পায়। তারা ফিরে এসে মিলিটারীদের উপর ক্ষেপে যায়। কাক গুলো চীৎকার করে। মিছিল করে। সে খবর আসে স্কুলে মিলিটারী ক্যাম্পে। পঁচা লাশের গোপোন রহস্য কাকেরা ফাস করে দিচ্ছে। জয় বাংলার পাখিরাও মিছিল করে। ভারি মুস্কিল। ৫ জন মিলিটারীর একটা দল সকাল বেলা বেদায় গিয়ে পৌঁছে। ওরা যা শুনেছে তাই। নদীর কিনারে একটা শুকনো বাশের খোটায় একটা পঁচা লাশ আটকে আছে। সে লাশ নিয়ে অসংখ্য কাকের মিছিল। অমনি ঘ্যাট ঘ্যাট করে ফায়ার। মরে গেল পাঁচ-সাতটি কাক। অন্যেরা মুহূর্তে উধাও। এবার মিলিটারী ফিরে আসার জন্য পা বাড়াল। এমন সময় ছুটে আসল শত শত কাক। আকাশ মুখরিত হলো ওদের চীৎকারে।একজন মিলিটারী গর্জে উঠলো, এ্যা শালারা বিলকুল মুক্তি পাখি হ্যায়।ফায়ার! জেরগে ফায়ার।
এবার কাকের মৃতের সংখ্যা বেড়ে গেল। তবে আকাশে কাকদের দেখলেই মৃতের সংখ্যার চেয়ে ক্রমশ কাকের সংখ্যা বারছে। এক সময় মিলিটারীদের বন্দুকের গুলি ফুরিয়ে এল। বন্ধ হল ফায়ার। কাকেরা তাদের মাথার ওপর। ঠিক জঙ্গি বিমানের মত ঘুরপাক খাচ্ছে। ফলে পালাতে বাধ্য হল মিলিটারি।
মিলিটারিদের সাথে কাকদের যুদ্ধ ও মিলিটারদের পরাজয়ের খবর গ্রাময় ছরিয়ে গেল। বিকেল বেলা ঘটনাস্থলে এলেন মিটিারি ক্যাম্প কমান্ডার। সাথে কয়েকজন মিলিটারি। নদীর কিনারায় একটা গর্ত খুড়েমৃত কাক ওভাসমান লাশের উপর মাটিচাপা দিয়ে তারা ফিরে গেলেন। এ ঘটনার পর করতোয়র বুকে আর লাশ ভাসেনি। তবে শান্তি কমিটির পক্ষে জমির বলে বেরাচ্ছেন, তারা এলাকার শান্তি ফিরে আনার জন্য সব ধরনের প্রচেষ্ঠা চালাচ্ছেন।
হঠ্যাৎ খবর এল মিলিটারিরা স্বপনও তার মাকে ধরে এনেছেন। তবে শান্তি কমিটি জানালো, ঠিক ধরে নয়, নিরাপত্তার জন্য ওদে কে ক্যাম্পে নিয়ে গেছে। কিন্তু তালুকদার বাড়ির চাকর মন্টু আরি পেতে শুনেছে, স্বপনের বাবা মিলিটারি থেকে পালিয়ে এখন মুক্তিযুদ্ধ করছে। সেই আপরাধের জন্য ধরে নিয়ে গেছে তার স্রী পুত্রকে। মন্টুদার কথা শুনে আমার বুকটা কেপে ওঠে। আমি সুমনের খোঁজে বটতলার দিকে পা বাড়ালাম। কাল পরশু সুমনদের ভারত চলে যাবার কথা।আজ ওর বাবা বাড়ির বুযড়োদের নিয়ে ভারতে গেছেন। বটতলায় গিয়ে ঘাটের দিকে মানুষের ভির চোখে পড়ে। একজন মধ্য বয়সী মহিলা নদীর তীরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।আর ৫/৬ বছরের একটি ছেলে মা মা বলে হাউ মাউ করে কাদছে।সুমনের দেখা হল ঐ ভিরের মধ্যে। সে জানাল,মহিলাটি ছেলেকে মাথায় করে নদী পাড় হতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পরেছে। হয়ত বাঁচবেনা। ছেলেকে বাচাতে গিয়ে নিজেই মরতে বসেছে।
সুমনের কথা শোনার আগ্রহ আমার নেই। আমি বললাম, স্বপনের খবর জানিস? মিলিটারীরা ওকে আর ওর মাকে ধরে নিয়ে গেছে। Ñআমার কথা শুনে নদীর কিনারায় কান্নারত শিশুটির কথা ভুলে গেল সুমন। ভারি কন্ঠাবরে বলল, কার কাছে শুনলে রে তপু? কি করেছে ওরা? Ñ তালুকদার বাড়ির মন্টু দা। স্বপনের বাবা নাকি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে Ñ তাই।
তা হলে তো নিশ্চয় ওদের মেরে ফেলেছে। এই বলে সুমন একটা লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। আমিও চুপ করে আছি। স্বপন আমাদের দু’জনার প্রাইমারী স্কুলের ঘনিষ্ট বন্ধু। প্রাইমারী শেষ করে বিষ্ণু প্রসাদ স্কুলে এক সাথে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ছি। মুহূর্তে সুমনের চোখ জোড়া লাল হয়ে উঠলো। আমার ঘাড় স্পর্শ করে বলল, তপু শিঘ্রী একটা বুদ্ধি বের কব। স্বপনের প্রতিশোধ আমাদের নিতে হবে।
প্রতিশোধ ? কী ভাবে নেবে! আমরা ছোট। আমাদের তো আর মুক্তিযুদ্ধে নেবে না।
তা হলে বাবাকে বলতে হবে প্রতিশোধ নিতে। বাবা আমাদের ভারতে রেখে মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছেন।
কিন্তু ক্লু এর মধ্যে যদি স্কুল ছেড়ে মিলিটারিরা চলে যায়।
তাই তো। তা হলে কী করা যায়।
একটা বুদ্ধি আমার মাথায় এসেছে।
কী ?
প্রতি সন্ধায় মিলিটারিরা হাওয়া খেতে স্কুলের জাম তলায় আসে।
তাতে কী ?
আরে শোন না। জাম গাছের দক্ষিনের ডালে দক্ষিনের কান্ড ঘেষে একটা বিসাল মৌচাক আছে।
হ্যা আছে! তবে কী খাওয়াবে মিলিটারিদের।
আরে মধু কেন ? হুল খাওয়াবো। যদি চুপি চুপি গিয়ে সন্ধ্যায় ঢিল মারতে পারি মৌচাকে Ñ তবে আর মিলিটারিরা যায় কোথায়।
কিন্তু আমাদের যদি দেখে ফেলে।
তা কি করে সম্ভব !
জাম তলার দক্ষিণ দিকটা তো উচুঁ দেয়ালে ঘেরা। আমাদের দেখতেই পাবে না।
তা হলে চল, আজই সন্ধ্যে ঢুকে পড়ি।
যেমন বুদ্ধি তেমনই কাজ। সন্ধ্যে বেলা দু’জনে তুলসি ঘাটে এসে হাজির। বৈশাখী আকাশে মেঘের আনাগোনা। ঘাটের ওপর বাশঁবনে পাখিদের কোলাহল। করতোয়ার বুক জুড়ে দুরন্ত সাহস। দেশপ্রেম আর হাফপ্যান্ট মাথায় নিয়ে এক সাথে দু’জনে নদীতে নেমে পড়লাম। বৈশাখের ছোট নদী নিমিষেই পাড় হয়ে গেলাম। একটা শেয়াল আমাদের দেখে সম্মান জানিয়ে ডান দিকে পালিয়ে গেল। সুমন বলল ”শুভ লক্ষণ । এবার এগিয়ে চল।”

 
আমি চলতে গিয়ে আলোর মধ্যে একটা লম্বা হোঁচট খেয়ে স্বদেশের মাটিতে পড়ে গেলাম। সুমন হাত বাড়ানোর আগেই উঠে পড়লাম বীরের মত। এবার দু’জনে হাত ধরাধরি করে চলছি। হঠাৎ একটা টর্চ লাইটের আলো উত্তর দিক থেকে আমাদের মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। আমার হাতে হ্যাচকা টান দিয়ে সুমন একটা বড় আলের পাশে শুয়ে পড়ল। আমি পড়ে গেলাম ওর গায়ের ওপর। টর্চের আলো উত্তর দিক থেকে দক্ষিণে যাচ্ছে। দু’জন লোক পাশা-পাশি হাঁটছে। মাঝে মধ্যে কথা হচ্ছে তাদের। একজনের গলা চেনা গেল। জমির মুন্সি।স্কুলের মিলিটারী ক্যাম্পে যাচ্ছে ওরা। আমরা খেকশেয়ালের মত বসে থেকে মাথা উচু করে দেখছি। ওরা যখন মূল রাস্তার দিকে পা বাড়াল –আমরা তখন পথ চলতে শুরু করলাম। সোঁজা স্কুলের পেছনে দক্ষিণ দিকের একটা পাট ক্ষেতের মাঝ খানে বিশ্রামের জন্য বসে পড়লাম। তারপর জামতলায় মিলিটারীদের উপস্থিতি অনুমান করতে খড়গোশের মতো কান খাড়া করলাম। ভেসে আসছে জমির মুন্সির চেনা কণ্ঠ। এখন কেবল ইশারায় আমাদের সব কাজ সারতে হচ্ছে। উঠে দাড়ালাম একসাথে। দেয়ালের পাশ থেকে ইটের বড় বড় টুকরো হাতে তুলে নিলাম। তারগেট মৌচাক! এক সাথে ছুঁড়ে মারলাম দু’জনে। মৌচাক ভেঙে চৌচির। খটমট বুটের শব্দ জামতলায়। আমরা ফিরতি দৌড়ে শুনতে পেলাম ”ফায়ার ! শালা মুক্তি পাখি ! ফায়ার।”

********************

গল্পটি পাঠিয়েছেন-

তৌহিদ-উল ইসলাম
সহঃ শিক্ষক (বাংলা)
লালমনিরহাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়,লালমনিরহাট।
গীতিকার,বাংলাদেশ বেতার,বাংলাদেশ টেলিভিশন।

 

 

 

 

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!