মৃত মানুষ : আমি ভগবানের সাথে দেখা করতে চাই।
যমদূত গোছের কেউ : ওনাকে দেখা যায় না ,উনি নিরাকার।
মৃত মানুষ :আকার না দেখা যাক ,সাদা আলখাল্লা ধরনের পোশাক অথবা গাড়ির হেডলাইটের মত চোখ ধাধানো আলো ,কিছু তো দেখা যাবে !
যমদূত গোছের কেউ : সে আবার কি ? নিরাকারের পোশাক কি প্রয়োজন আর এখানে কখনো অন্ধকার হয় না যে ভগবান নিজেই আলো হয়ে ঘুরবেন।
মৃত মানুষ : ও তাহলে বোধ হয় সবটাই বুজরুকি। সে যাই হোক ,আমার ভগবানের সাথে কথা বলা দরকার। উনি কথা তো বলেন নাকি তাও বলেন না ?
যমদূত গোছের কেউ : তা বলেন তবে জন বিশেষে ,এভাবে সবার সাথে নয়।
মৃত মানুষ : ও এখানেও বাছ বিচার ? সামান্য প্রশ্ন করতে হলেও আগে যোগ্যতা বিচার করতে হবে ?
যমদূত গোছের কেউ : তা তো বটেই ! ওনাকে প্রশ্ন যে খুশি করতে পারলেও উত্তর উনি জন বিশেষেই দিয়ে থাকেন।
মৃত মানুষ : তা কি সেই যোগ্যতা প্রমানের মাপকাঠি ? পাপ পুন্যের হিসেব ?
যমদূত গোছের কেউ : পাপ পুন্যের হিসেব বলে কিছু হয় না।
মৃত মানুষ : সেকি ? শুধু নরক যাবার ভয় কত ইচ্ছাই যে অপূর্ন রয়ে গেল। আর শুধু পুণ্য লাভের আশায় বুকে পাথর রেখে দান ধ্যানে কত অপচয় না করেছি ,আর আপনি এখন বলছেন পাপ পুন্য বলে কিছু হয় না!
যমদূত গোছের কেউ: আপনি ভুল করছেন। হিসেব মানে তো যোগ বিয়োগ তাই তো ? একটা ছাগল আর ২ টো ঘোড়ার মধ্যে কি যোগ বিয়োগ হয় ?
মৃত মানুষ :মানে ঠিক বুঝলাম না !
যমদূত গোছের কেউ: মানে মানুষের করা প্রতিটা পাপ অথবা পুণ্য একেবারে আলাদা সত্বা ! একে অপরের সাথে যোগ বিয়োগ করার জন্য সমগোত্রীয় হওয়া আবশ্যক। এই ধরুন ঠাকুমার আঁচারের বোতল থেকে আঁচার চুরি করার জন্য হওয়া পাপের সাথে সেই ঠাকুমাকে শেষ সময় একবারও না দেখতে যাওয়ার পাপের কিভাবে যোগ করা যায় তা ভগবানের জানা নেই! আবার ধরুন রাস্তার কুকুর কে বিস্কুট দেওয়ার পুন্যের থেকে কিভাবে স্ত্রী র পেটের কন্যা ভ্রুণ হত্যা করার পাপ কে বিয়োগ করা যায় তাও ভগবানের অজানা। তাই প্রথম দিকে চেষ্টা করলেও ভগবানের আর হিসাব কষা হয়নি।
মৃত মানুষ : তাহলে বিচার টা কিভাবে হয় ? তার থেকেও বেশি যেটা জানা জরুরী সেটা হলো কত সময় ধরে হয় ?
যমদূত গোছের কেউ: বিচার তো হয়ে গেছে ! তৎক্ষনাৎ , মুহুর্তে ! একি আপনাদের হাইকোর্ট সুপ্রিমকোর্ট পেয়েছেন নাকি ? নাটক দেখার অবসর আপনাদের থাকতে পারে মশাই ,ভগবানের নেই।
মৃত মানুষ : তবে এখন শুধু ই ফল প্রকাশের অপেক্ষা ? একটা কথা বলুন বিচার যখন হয়েই গেছে তখন অপরাধীর শাস্তিও তৎক্ষনাৎ হলে কি ক্ষতি হত ? ভগবানের বিচার তো সবাই টিকিট কেটে দেখতো মশাই ,সারাজীবন শুধু কথার কথা হয়ে থাকত না ব্যাপারটা ,আপনি নিশ্চই জানবেন পরলোক ব্যাপারটা অনেকেই এখনো ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি তাই ব্যাপারটা জীবদ্দশায় চালু করতে পারলে ক্রাইম কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্ট র উপর চাপটা বেশ অনেকটাই কমত!
যমদূত গোছের কেউ: সবই তো বুঝলাম কিন্তু শাস্তি দেওয়ার জন্য যে যন্ত্র টা প্রয়োজন সেটা বেশির ভাগ মানুষই বিনা ব্যবহারে একেবারে খারাপ করে ফেলে ,তাই ভগবানের ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই। মাঝ রাস্তায় গাড়ি দাড় করিয়ে তো আর মেরামত করা যায় না মশাই , গ্যারেজ না করলে অতি বড় মেকানিকও যে ভীষণ অসহায় ! তাই পেট্রোল শেষ হবার অপেক্ষা ছাড়া কিছুই বিশেষ করার থাকে না, এখানে এলে সেই যন্ত্রকে আবার নতুন করে ইনস্টল করা হয় আর যেকোনো কাউকে শাস্তি দেবার আগে তার কার্যকারিতা ভগবান নিজের উপর পরীক্ষা করে দেখে নেন ।
মৃত মানুষ: কি সেই যন্ত্র ? আর পাপের শাস্তি টাই বা কি ?
যমদূত গোছের কেউ: যন্ত্রটার নাম হলো ‘বিবেক’ আর শাস্তির নাম হল ‘বিবেক দংশন’। অপরাধীর পাপের পরিমাপ অনুযায়ী নির্ধারিত হয় দংশনের তীব্রতা ! সামনে অপরাধের ফ্ল্যাশব্যাকের সাথে ক্রমান্যয়ে বাড়তে থাকে এই দংশনের ধ্রুপদী নৃত্য , জন বিশেষে কতক্ষণ চলবে তা মহাকালেরও অজানা , আমার মনে হয় ঠিক ততক্ষণ অব্দি যতক্ষণ না সেই অপরাধের শিকার হওয়াতে বেরোনো চোখের জলের শেষ বিন্দু টা পর্যন্ত মুক্তির বাষ্প হয়ে উড়ে যায়।
মৃত মানুষ (ঢোক গিলে ): সে তো অগনিত চোখের জল ,সমুদ্রের শেষ বিন্দু কোথায় তা কি আর কারো জানা আছে ! ইস ,আগে যদি একটু ধারণা থাকত ব্যাপারটা নিয়ে ! ‘বিবেকের দংশন’ তো নিদারুন যন্ত্রণা মশাই ,অনেক ছোটবেলায় আমার একবার হয়েছিল ,আমার অন্যায়ের জন্য যখন বড়দা মায়ের কাছে মার খেয়েছিল। সে দংশনের দায়ভার কারণে অকারণে সারা জীবনের অগণিত মুহুর্তে বয়ে বেরিয়েছি।
যমদূত গোছের কেউ: এখানে একেবারে ধুলো ময়লা হীন ঝকঝকে নতুন ইনস্টল করা বিবেক মশাই ,সদ্যজাত শিশুর নিষ্পাপ মুখের মতই সতেজ আর প্রানবন্ত,নিজের দোষ আড়াল করার কৌশল যার একেবারেই অজানা, এর দংশন একবার অনুভব করলে ওই সব আগুনের গহ্বর ,গরম তেলের কড়াই ,নরক নামক কাল্পনিক জায়গার জ্বালা যন্ত্রণাকে বেশ আরামদায়ক বলেই মনে হবে !
মৃত মানুষ : আচ্ছা ,ক্ষমা চাইলে কেমন হবে ? ভগবান তো শুনেছি খুব দয়ালু ,শাস্তি কম করে দেবেন নিশ্চই তাহলে একটু হলেও,কি বলেন ?
যমদূত গোছের কেউ:যার কাছে অপরাধ করেছিলেন তার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন কি ? সে যদি না করে থাকতে পারে তাহলে ভগবান কি করে করবে বলুন ,উনি বরাবরই ভীষণ ইনসেনসিটিভ!
মৃত মানুষ : আচ্ছা ,উনি নিজের উপর বিবেক যন্ত্রের কার্যকারিতা কিভাবে পরীক্ষা করেন ? ভগবান নিজেও কি পাপ করেন নাকি ?
যমদূত গোছের কেউ:এই ধরুন আপনার মতন মানুষকে সৃষ্টি করার দায়ভার কার ? সেই দংশনের ভাগীদার নিশ্চই আপনি বা আপনার জন্মদাত্রী মা নন !
মৃত মানুষ : তার মানে আপনি বললেন আমি খারাপ মানুষ ? আপনি জানেন আমি জীবন ভর কত কষ্ট করেছি ? হ্যা পাপ না হয় করেছি অনেক কিন্তু পুণ্যও তো কম করিনি।
যমদূত গোছের কেউ: আমি কিছুই জানি না। আপনি ভালো না খারাপ একটু পরেই ওই সামনের ঘর থেকে আসা আর্তনাদ বলবে ,তা সে খুশিরও হতে পারে অথবা ত্রাহি ত্রাহি রব ।
মৃত মানুষ : খুশির আর্তনাদ ? মানে পুণ্য ফল ?
যমদূত গোছের কেউ: হ্যা। তবে সেটা সবার জন্য এক। ভগবানের কাছে এর কোনো জন বিশেষে প্রকারভেদ নেই।
মৃত মানুষ : সেটা কিরকম যদি একটু বলেন।
যমদূত গোছের কেউ: যার জন্য সবচেয়ে ভীষন মুহূর্তেও এই কষ্টকর জীবনকে একবারও মুল্যহীন বলে মনে হয়নি ,কে যেন ভিতর থেকে বলেছে বারবার আপনাকে , এই জীবন না থাকলে তো সেও থাকতো না ,যার ক্ষনিকের সান্নিধ্য আপনাকে ভুলিয়ে দিত জীবনে অজস্র না পাওয়ার ক্ষোভ ! খিদের জ্বালায় , ব্যর্থতায় ,জীবনের প্রতিটা ক্ষণে , এমনকি মৃত্যুর পর পর্যন্ত যার মুখ আপনি একবারের জন্যেও ভুলতে পারেননি,সকল পুন্যের ফল স্বরূপ আপনি তার সঙ্গে কাটাতে পারবেন একটি সুখকর মুহূর্ত!
মৃত মানুষ : মাত্র একটি মুহূর্ত ? মাত্র একটি ?
যমদূত গোছের কেউ: মনে রাখবেন এখানে কিন্তু ঘড়ি নেই ,সময় এখানে চিরকাল নিশ্চল ,অপরিবর্তিত। তাই আপনার অজান্তেই ওই একটি মুহূর্ত ই হয়ে উঠবে চিরন্তন।