মৃত্যুর প্রহর গুনছি।

পৃথিবী ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে কত বছর হলে?
খুবই সহজ একটা প্রশ্ন কিন্তু উত্তরটা অনেক কঠিন। এতো কঠিন, কেউ এর নির্দিষ্ট করে উত্তর দিতেই পারে না। উত্তরটা জানা আমার জন্য খুবই প্রয়োজন। পৃথিবীতে বেচে থাকতে আর ইচ্ছে করছে না। আমার বয়স এখন সাতচল্লিশ। এই সাতচল্লিশ বছরকে আমার কাছে এখন হাজার বছর মনে হচ্ছে। আমি এই পৃথিবীতে একজন ক্লান্ত, অসহায় নারী। আমার সবচাইতে বড় পরিচয় আমি একজন অসহায় মা!
পর পর দুটো সন্তান মারা গেল। সবাই আমাকে বলতে থাকলো- “অপয়া”। কতো হাজার বার আল্লাহর দরবারে দোয়া করেছি একটি সন্তানের জন্য। আজ আমি সন্তানের জননী। আমার সন্তান যখন পৃথিবীতে এসেছিলো, আমার তখন জীবন যায় যায় অবস্থা। ডাক্তার ছুটে এসে স্বামীকে বলেছিল- “আল্লাহ আল্লাহ করেন। মা, সন্তানের জীবন খুবই বিপদে। বাচে কিনা সন্দেহ”।
আমি ব্যথায় পর পর দুবার জ্ঞান হারালাম। ডাক্তার স্বামীকে বলেছিলো- “ যে কোন একজনকে বাচাতে হবে, হয় গাছ , নয়তো গাছের ফল। বলেন কোনটা বাচাতে চান”?
আমার স্বামী চোখের জল মুছতে মুছতে বলেছিল- “গাছকেই বাঁচান”।
ডাক্তার আমাকে বাঁচানোর জন্য উঠে পরে লাগলো। আমার যখন জ্ঞান ফিরল, আমি বুঝতে পারলাম- এ পৃথিবীতে এবারও আমার মা হওয়া সম্ভব নয়। আমার চোখের সামনে পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসতে থাকলো। সবকিছু শূন্য মনে হল। আমি ডাক্তারের হাত ধরে বললাম- “আমার সন্তানকে বাঁচান। আমি বাচতে চাই না। আমিতো পৃথিবীর আলো, বাতাস অনেক দেখেছি। এবার আমার সন্তানকে দেখতে দিন। ওর মাঝেই আমি বেচে থাকবো”।
ডাক্তার মনে হয় এরকম কথা কখনো শোনে নি। অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকলো।
আমি বাঁচলাম, আমার মুখের হাসি, মনের আনন্দকে শতগুণ বাড়িয়ে দিয়ে আমার সন্তানও বেচে গেল। সন্তানকে বুকে নিয়ে নিমেষেই ভুলে গেলাম দুই বার ব্যথায় জ্ঞান হারাবার অপরিসীম যন্ত্রণা।
কিছুদিনের মাথায় আমার স্বামী মারা গেল। আমি পড়ে গেলাম অকুল দু:খের সাগরে। এতোটুকু বাচ্চাকে কি ভাবে বড়ো করবো? পৃথিবীর পুরুষ জাতি নারীদেরকে করুণা করতে ভালোবাসে। স্বামী মারা যাবার কিছুদিনের মাঝেই আমি তা হারে হারে টের পেলাম। অনেকেই বিয়ে করবার জন্য আমাকে প্রস্তাব দিলো।
একবেলা খেয়ে না খেয়ে বড় করতে লাগলাম সন্তানকে। আমি বিয়ে করলে আমার সন্তানের কি হবে? কে দেখবে তাকে? নতুন বাবা এসে কি তাকে সন্তানের মর্যাদা দিবে? হাজারও রকম প্রশ্ন মাথায় ঘুরতে থাকলো।
এইতো ভালো আছি। একবেলা খাই অথবা না খাই সন্তান তো বড় হচ্ছে। মানুষ হচ্ছে। সে একদিন লেখাপড়া শিখবে। বিদ্বান হবে। বাবার মুখ, আমার মুখ উজ্জ্বল করবে। বিরাট বড় হবে একদিন। আশায় বুক বাধলাম। তখন আর আমার কোন কষ্টই থাকবে না।
মাঝে অনেক বছর কেটে গিয়েছে। কখন যে আমার সন্তান এতো বড় হয়ে উঠেছে বুঝতে পারি নি। আমার সন্তান এখন বিরাট বিদ্বান, বিরাট জ্ঞানী। বি.বি.এ পাস, শুনলেই বুকটা আনন্দে ভরে যায়। এলাকার মাঝে বাবার মুখ উজ্জ্বল করেছে। বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। এক মূহুর্ত কথা বলবার সময় নেই। হাজারটা প্রশ্ন করলে একটার উত্তর দেয়। এক সময় এই ছেলেই মা মা বলে আমার আচল জড়িয়ে ধরে থাকতো, ভাবতেই এখন অবাক লাগে।
আমার ছেলে এখন অনেক বড় হয়েছে। রাগি রাগি চোখে তাকায় আমার দিকে। কিছু বললেই ধমক দেয়। ফাইল পত্র ছুড়ে ফেলে চারিদিকে। সন্তানের এখন অনেক উন্নতি হয়েছে। আগে ফাইল-পত্র মেঝেতে ছুড়ে ফেলত, এখন আর মেঝেতে ছুড়ে ফেলে না। আমি সামনে দণ্ডায়মান থাকতে মেজেতে ছুড়ে ফেলবার কি প্রয়োজন।
কতো চেষ্টা করি নিজেকে বোঝাতে, ছেলে আমার বড় হয়েছে। ওর সাথে হিসেব করে গুনে গুনে কথা বলতে হবে। নাহলে ছেলে রাগ করবে। ভাংচুর করবে।
আগে যখন ছেলে রাগ করে ভাংচুর করতো আমি তখন প্রচুর হইচই করতাম, রাগারাগি করতাম। এখন আর কিছুই বলি না। ছেলে যখন ভাংচুর করে খাতা কলম ছুড়ে ফেলে আমি তখন চুপ করে বসে থাকি। যখন ভাংচুর বন্ধ হয় তখন একটি বার জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে জাগে- “বাজান, তুই কি আমাকে ভালোবাসিস”? কিন্তু ছেলের চোখের পানে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করা আর হয়ে উঠে না। যদি রাগ করে আবার ভাংচুর করা শুরু করে।
আজ আমার সকল আশা পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। ছেলেকে মানুষ করবার আশা ছিল, বড় করবার আশা ছিল। দুটো আশাই পূর্ণ হয়েছে। ছেলে আমার এখন বড় হয়েছে, বিদ্বান হয়েছে। আমার সকল আশা পূর্ণ হয়েছে কিন্তু এখন আমি আশা-শূন্য হয়ে পরেছি। মানুষের মন বড়ই বিচিত্র। আশা ছাড়া বাচতে পারে না। আমার আজ আর কোন আশাই অপূর্ণ নেই। তাই আমি এ পৃথিবী ত্যাগ করতে চাই। পৃথিবী ছেড়ে যাবার বয়স কতো? জানাটা আমার জন্য খুবই প্রয়োজন!

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!