এই যে ভায়া , হ্যাঁ আপনাকেই বলছি… কখনো কিজের চোখে ভুত দেখেছেন?” প্রশ্নটা যাকেই করা হোক সেই চোখ বন্ধ করে মাথা ঝাকিয়ে ডানে বামে নেড়ে না বোধক উত্তর দেবে।আমি জানি আপনি ও পারবেন না। ভুতের গল্প আপনি শুনেছেন আপনার দাদীমার মুখে, কিনবা আপনার নানীর মুখে। উনি আবার শুনেছেন উনার কোন এক ফুফাত বা খালাতো ভাইয়ের মুখে- তিনি আবার অন্য কোন এক আত্মীয়ের মুখে- এভাবে আস্ল মানুষটাকে খুঁজতে গেলে দেখা যাবে- উনি সাধারন একটা কাপড় দেখে মনে করেছেন শাকচুন্নি। আসলে বাংলার ভুতের এই গল্প গুলো এই আত্মীয় তত্ত্বের বেড়াজাল থেকে কখনোই বের হতে পারেনি। ভাবছেন কেন আমি এত কথা বলছি? কারন আমি সত্যি সত্যি ভুত দেখেছি। আর এটাকে ভুত না বলে অতৃপ্ত আত্মা বলা ভাল। তাহলে প্রথম থেকে ই শুরু করি। ঘটনাটা খুব একটা বেশী দিন আগের না।
আমার বিয়ে হয়েছে দিন দশেক হয়েছে। নবম দিন আমি আর আমার স্ত্রী রুপা গেলাম কক্সবাজার।আগেই বলে রাখি আমি কিন্তু একটু পাগল টাইপের। সংসার আমার কোন দিনই ভালো লাগেনি। সংসার বৈরাগ্যের কারনে প্রায় সময় আমি পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি জংগলে জংগলে। কোন এক অজানা কারনে সেই পাগলামি আমাকে হটাত ছেড়ে গেছে- ফলাফল আমি আজ বিবাহিত।আর রুপা নামের অজানা মেয়েটি আমার বউ। আর আমার মায়ের ইচ্ছেতেই আমি চোখমুখ বন্ধ করে কবুল করলাম আর তাঁর ইচ্ছাতেই হানিমুনে এলাম কক্সবাজার। আর আমার সেই ভৌতিক ঘটনার সুত্রপাত এই কক্সবাজারেই। আমি আর রুপার কারোরই হোটেল পছন্দ না- আমরা তাই আমার এই পরিচিত বন্ধুর রেষ্টহাঊজে ঊঠলাম। ঘটনা যেই দিনের সেদিন আমি মাত্র ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করতে করতে শাওয়ার নিচ্ছিলাম।
এমন সময় কলিং বেলের আওয়াজ। আমি ব্রাশ মুখে দিয়েই দরজার ফুটো দিয়ে বাইরে তাকালাম- কিন্তু বেচারা যে এসেছে- সে এমন ভাবে দাঁড়াল যে আমি তাকে দেখতেই পারছিনা। শেষে রাজ্যের সমস্থ বিরক্তি মুখে নিয়ে আমি দরজা খুলে দিলাম।আর খুলেই আমি অবাক হয়ে কিছু ক্ষন আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কারন যে আমার সামনে দাড়িয়ে আছে- সে আর যেই হোক সভ্য কোন মানুষ হতে পারেনা।সারা শরীর ময়লা মুখে গোঁফ দাঁড়ির জঙ্গল- দেখার মাঝে দেখা যাচ্ছে জ্বলজ্বলে চোখ দুটো। আর সেই চোখদুটি দেখে চিনলাম- সে আমার ছোটবেলার বন্ধু তৌহিদ। একসাথে আমরা স্কুলে পড়েছি- কলেজে বিড়ি টেনেছি, ইউনিভার্সিটিতে হলে থেকেছি- আরও কত কি? যেন এক সেকেন্ডে পুরনো সেই দিনগুলো আমার চোখের সামনে উঠে এল একে একে। আর সাথে সাথে আমি জড়িয়ে ধরলাম তৌহিদকে। রুপার সাথে পরিচয় পালা শেষ করে তৌহিদ কে নিয়ে গেলাম সেলুনে। সেখান থেকে চুল দাঁড়ির জংগল কাটিয়ে এনে বাসায় গোসল করালাম। তারপর একসাথে দুজনে বসে দুপুরের খাবার খেলাম। এভাবে যে কখন দিন কেটে রাত নেমে এল বুঝতেই পারলাম না।
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে তৌহিদ কে নিয়ে গেলাম কাছের একটা বারে। সেখানে পেগ চারেক হুইস্কি হিলে বাসায় আসার পথে তৌহিদের দিকে তাকিয়ে কিছুটা বিমর্ষ দেখাল। আমি কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই সে একটা কাহিনী শোনাল। তৌহিদে ভাষায় বলি- “তুই চাকরির জন্য ঢাকা চলে গেলে আমি খুব একা হয়ে যাই। আমি চট্টগ্রামেই ছিলাম। একটা ব্যাবসায় হাত দিয়েছিলাম- কিন্তু লস খেলাম”। এর মাঝেই কারেন্ট চলে গেল। আমি মোমবাতি জ্বালালাম। সাথে করে চার্জার আনিনি বলে নিজের কপাল চাপড়ালাম। তারপর আবার তৌহিদের কাছে এসে বসলাম। মোমবাতির আলোয় তৌহিদ আবার বলতে শুরু করল- ‘আমি যে ফার্মে জয়েন করেছিলাম সেখানে এক কলিগের সাথে আমার বেশ ভাব হয়েগেল। ওর নাম জীবন। আমার সাথে সাথে সে ও ভাবের পাগল। আমি ওকে সাধনা করতে বনে যেতে বলতেই সে একপায়ে খাড়া। তারপর আমি আর জীবন মিলে গেলাম বান্দরবান। কিন্তু সেখানে মাত্র দুদিন থেকে ই আমি অসুস্থ হয়ে গেলাম।সময়টা বর্ষা কাল ছিল। তাই মশক কুলের কামড়ের চোটে আমার ম্যালেরিয়া বেধে গেল।আমার জ্ঞান ছিলনা দুইদিন।
আমি জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে আবষ্কার করি একটা পাহাড়ি ঘরে- সেখানে আমার পাশে জীবন ও পড়েছিল- আর আমাদের দুজনকেই সুস্থ করে তুলল দেবী নামের এক পাহাড়ি মেয়ে। তারপর আমরা প্রায় একমাস পর আবার ফিরে আসি জঙ্গলে। আমি মনযোগের সাথে সাধনা করতে পারলেও জীবন কিছুটা অস্থির ছিল। পড়ে জানতে পারলাম দেবীর সাথে জীবনের মন দেয়া নেয়া হয়েছে- তখন খুব একটা খুশি হতে পারিনি। কারণ এটা জানার পরদিন ই আমাদের পাহাড়িরা উঠিয়ে নিয়ে যায়। পাহাড়িরা খুব সহজ সরল-কিন্তু ক্ষেপে গেলে ওদের থামানো যায়না- আর তাই দেবীর সাথে ভালবাসার দায়ে জীবনকে আর আমকে মার খেতে হল।আমি আর ওমুখ না হলেও জীবন কিন্তু দেবীর উপর ক্ষেপে গেল। কারন দেবীর আগে একটা স্বামী আর একটা মেয়ে আছে। জীবন ঠিক করল সে প্রতিশোধ নেবে। তাই এর পরের পূর্ণিমায় ওই পাহাড়ি গ্রামে যখন উৎসব চলছিল তখন জীবন এক কোপে দেবীকে দুই ভাগ করে ফেলে। লাশের পাশেই বসে ছিল জীবন।
ওকে এভাবে দেখে কারোর কিছু বুঝতে বাকি থাকেনা। সবাই মিলে প্রথমে জীবনকে মিলিটারির কাছে তারপর পুলিশে হস্তান্তর করে। তারপর বিচারে জীবনের ফাসি হয়। আমাকে একমাত্র বন্ধু হিসেবে জীবনের ফাঁসির সময় উপস্থিত থাকতে হয়। সেখানে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জীবনের মৃত্যু দেখেছি। বুঝিনা- কেন মৃত্যুর অনেক গুলো উপায় থাকতেও কেন বাংলাদেশে এখনো ফাঁসির মত একটা মধ্যযুগীয় বিচার ব্যাবস্থা এখনো রয়ে গেছে? দেখলাম নিজের চোখে সব। একজন জল্লাদ জীবনকে কালো কাপড় পড়িয়ে দিল। হাত পিছনে নিয়ে দড়ি দিয়ে বাঁধল। পায়ে শক্ত করে বেধে ঠিক বারোটা এক মিনিটে ঝুলিয়ে দিল জীবনকে। আমার চোখের সামনে জীবনকে মরণের দিকে ঠেলে দিল ওরা- আমি কিছুই করতে পারিনি। চেয়ে চেয়ে দেখেছি। এর পরের দৃশ্য আরও ভয়াবহ। এক ডাক্তাররুপি জল্লাদ জীবনের লাশটাকে নামাল। তারপর হাতপায়ের সব রগ একে একে কেটে দিল। তারপর লাশ নিয়ে গেল পোস্টমর্টেম করতে। একটা বাচ্চা যেখানে দেখেই বলতে পারবে যে জীবন আর বেঁচে নেই সেখানে ওর লাশ কেটে দেখার কি আছে সেটাই বুঝলাম না। সকালে যখন আমাকে লাশ হস্তান্তর করা হল তখন জীবনকে চেনা দায়। আমি ওর লাশ নিয়ে গেলাম জীবনদের গ্রামে। ওর তিন কূলে কেউ ছিলনা।
আমি ওর গ্রামের এক দুঃসম্পর্কের ভাইকে লাশ বুঝিয়ে দিলাম। তারপর আমি আর গ্রামের কিছু লোক মিলে লাশ দাফন করলাম জানাজা পড়ে। আসল ঘটনার শুরু এখান থেকে। আমি বাসায় ফিরে এলাম- কিন্তু শান্তি তে থাকতে পারলাম না। কেঊ যেন আমাকে কিছু একটা বলতে চাইছে। আমি সব সময় উপলব্ধি করি কেউ যেন আমাকে কিছু একটা বলতে চাইছে- কিন্তু আমি সেটা বুঝতে পারিনা। এটা আমার মা ও বুঝতে পারেনা। তারপর আমার মা এক হুজুর কে ডাকান। উনি এসে বলেন যে এক অতৃপ্ত আত্মা আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে চাইছে। আমি বললাম যেন হুজুর যোগাযোগ করেন। পরদিন রাতে হুজুর আস্র বসালেন। আসর বসানোর পর কিছু তুকতাক করতেই হুজুরের গলার স্বর কেমন যেন হয়ে গেল। হুজুর অন্য এক স্বরে বলল- যে সে হল জীবনের আত্মা- সে মরে গিয়ে ও শান্তি পাচ্ছেনা। যেন আল্লার দরবারে বিশেষ মোনাজাত করে ওর আত্মার শান্তি কামনা করা হয়। আমরা তাই করলাম। পরের দিন একটা ফাতিয়া দেবার ব্যবস্থা করলাম। আল্লার দরবারে সবাই মিলে মোনাজাত করলাম। এরপর থেকে আমরা আর কোন সমস্যা উপলব্ধি করিনি।
এতসবের পর আমি আর নতুন করে চাকরি করিনি। জঙ্গলে চলে গেলাম- সেখানে হটাত তোর কথা মনে হতে চলে এলাম”। কথাগুলো বলেই কেমন যেন চুপ হয়ে গেল তৌহিদ। আমি ও আর কথা বাড়ালাম না। তৌহিদকে একটা রুমে ঘুমাতে দিলাম। নিজে গিয়ে শুলাম আমাদের রুমে। তারপর- সকালে একটা বিকট চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি দৌড়ে গেলাম- দেখলাম রুপা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে তৌহিদের রুমের সামনে। আমি তাড়াতাড়ি রুমে ঢুকতেই নাকে একটা পচা গন্ধ বাড়ি মারল যেন- ঠিক মানুষ পচা গন্ধ। আমি রুমে গিয়ে যেটা দেখলাম সেটা বর্ণনা করতেই এখনো গা শিঊরে উঠছে। দেখলাম- তৌহিদের শরীরটা যেন এক মৃত লাশ। আমি হাতটা নিয়ে পালস দেখতে গিয়েই থেমে গেলাম। হাতের আর পায়ের রগ কাটা। তাড়াতাড়ি গলায় দেখলাম- দেখলাম গলায় একটা গাড় রশির দাগ। আমার তারপর আর হুশ ছিলোনা…… আমার জ্ঞান ফেরে দুইদিন পর পুলিশ কাষ্টাডিতে। আমাকে এরেষ্ট করা হয়েছে।
কারন আমি নাকি তৌহিদের লাশ ফাঁসি হবার পর ওর গ্রামে নিয়ে যাবার বদলে চুরি করেছি। আমি কোনভাবেই আদালতকে বুঝাতে পারলাম না- যে আমি মাত্র ১২ দিন আগে বিয়ে করেছি রুপাকে- আমার কোন কথাই ওরা বিশ্বাস করছেনা। আজ আদালতে মামলা উঠবে। আমাকে হাজির করা হচ্ছে। রুপা আছে বলেই ভরসা- নাহলে আমি হয়ত বাঁচতেই পারতাম না। আমাকেও ঝুলতে হত ফাঁসিতে নাহয় যাবতজীবন হয়ে যেত। তাই এখন কেউ জিজ্ঞেস করলেই বলি আমি ভুত দেখেছি- একেবারে চোখের সামনে দেখেছি। একসাথে মদ ও খেয়েছি। বিশ্বাস না করলে জাতীয় কারাগারের ১৩৭ নম্বর সেলে এসে আমাকে দেখে যেতে পারেন। আমি আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি………