মহাত্মা চন্টিক্লিয়ার, অর্থাৎ যিনি পরিষ্কার সুরে গেয়ে থাকেন, সেই মোরগপতি মরাঠাওয়াড়ার তেলিয়া গাঁওয়ের বর্ধিষ্ণু খামার খোন্দকার্স ফার্মের মুরগিঘরের ঢালু ছাদে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে মোরগকোশ রাগের তারসপ্তকে আলাপ ধরলেন— কোঁকর কোঁ, কঁক্ কঁ কঁ কঁ-অ-অ-অ। আকাশ-বাতাস চমকে উঠল। সুজ্জিবাবু বললেন, আরে যাই যাই, একটু সবুর করো। কাছাকোঁচাটা সামলে নিই! পুঁচকে রোগা খাল, খালের ধারের ঢালু জমি, খামারের আর সব পোষ্য, আকাশের নীল, বাতাসের হররা, সবার মুখে প্রশ্নচিহ্ন। ব্যাপার কী! ব্যাপারখানা কী! মহিষেরা গলা উঁচু করে বললে, গাঁ-আঁ-আঁ…তার আগে জানা চাই ব্যাপারটা-আ। ভেড়ার দলে ভ্যাঁ ভ্যাঁ কান্নার রব উঠল। এ নিশ্চয়ই একটা প্রলয়ংকর ব্যাপার হতে যাচ্ছে। সব ডুবে যাবে, ভেসে যাবে সেই সুনামির মতো, সেই ভূমিকম্পের মতো—নির্ঘাত মরণ! কেউ এক বার ভেবে দেখলে না, মরণের জন্যে প্রলয়ের দরকার কেন হবে তাদের? প্রতি দিনই তো ভেড়ারা ল্যামচপ হয়ে যাচ্ছে, সিজনে সিজনে ন্যাড়াবোঁচা হয়ে যাওয়া তো তুশ্চু কথা! গরুরা ভিল, বিফ হয়ে যাচ্ছে। শুয়োরেরা বেকন, হ্যাম, পর্ক, নানান রকম হচ্ছে। আর মুরগিদের তো কথাই নেই। মিনিটে মিনিটে গোটা মুরগি, কাটা মুরগি চালান যাচ্ছে বড় বড় ভ্যানে করে। বিজ্ঞানসম্মত দুধ-দোয়াখানাতে দুগ্ধপাত হচ্ছে চমৎকার, মারখানাতে জবাই হয়ে যাচ্ছে যাবতীয় ভক্ষ্য প্রজাতি। প্রলয় এর চেয়ে খারাপ কী করবে?
মহাত্মার গিন্নি আছে অজস্র। হারেম ভর্তি। জনা কয়েক মহাত্মা মিলে এই পাখি-খামারের প্রজনক। কিন্তু বেশির ভাগই ডিম-পাড়া গিন্নি। বাছা বাছা কিছু গিন্নি আছে, যারা জেনারেশনেক্সট-এর জন্ম দেবে। খামারে তাদের খাতির আলাদা। সব গিন্নির বড় গিন্নি পাটরানি ঘরের ফোকর দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল— কঁক কঁ কী কী? হঠাৎ এমন উদাত্ত গীতি?
চন্টিক্লিয়ার দু’পায়ে ভর দিয়ে আরও লম্বা হয়ে, গলা বাড়িয়ে গাল ফুলিয়ে রাগের আরোহ-অবরোহটি সাধলেন। কোঁকর কোঁ-ও-ও করে ঊর্ধ্বে চলে যাচ্ছে, আবার কঁৎ করে গোত্তা খেয়ে কঁক্ কঁক করে পুনরায় ঊর্ধ্বগতি। গলার ঘন ব্রাউন রঙের সঙ্গে নীল মিশে ব্রাহ্ম মুহূর্তের গায়েই বুঝি রং ধরে গেল! আকাশ বলে— এমন রং ধার দেবে দাদা? গাছপালা বলে— আমরা আরও নিকটজন, পেতে হলে আমরাই পাব, কেমন কি না! লাল লতপতে ঝুঁটিটি জবাগুচ্ছের মতো ফুটে উঠেছে। গলার তলার বিউটি-ঝালরটি দুলছে— চন্টিক্লিয়ার ঘাড় এ-দিক ও-দিক করে সুড়ুৎ করে মুখ নিচু করে বললেন, সুদিন আসছে।
—সুদিন?
মুরগিরা সরু গলায় বলল— আমাদের কি উইচিংড়ি ভাজা খেতে দেবে?
ভেড়ারা ভ্যা ভ্যা করে বলল— বোধহয় কাবলি ছোলা।
গরু-মোষেরা বলল— টাটকা ঘাসের সঙ্গে আখের গুড় মিশিয়ে দেবে, সোনালি খড়ের কুচি দিয়ে সাজানো। যা খেত্তে না! শুয়োরেরা ঘোঁতঘোঁত করে কী বলতে গিয়েছিল, অন্যরা থামিয়ে দিল— তোরা আর বকিসনি! যা টেস্ট তোদের! চুপ কর, চুপ কর!
ছুঁচলো মুখ গোমড়া করে শুয়োরেরা চুপ করে গেল। সুদিন এলে নিশ্চয়ই তাদেরও আসবে। কী, কেন, কেমন, এ সব জিজ্ঞেস করে মিছিমিছি দাবড়ানি খাওয়া কেন? দেশে দেশে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তাইল্যাণ্ড, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, সব, সব। সব দেশেই কোনও না কোনও মদনমোহন রতিকান্ত মোরগকর্তা গাল-গলা ফুলিয়ে গান করেন আর জানান দেন— সুদিন আসছে।
কেমন সুদিন? মোরগকর্তা জানেন না। প্রকৃতি তাঁকে সুদিন-দুর্দিনের আঁচটুকু পাওয়ার ক্ষমতা দিয়েছে, তার চেয়ে এক কড়া বেশি নয়। তবে চালাক কর্তা সে কথা বললেন আর কী! সমবেত জিজ্ঞাসার উত্তরে তিনি গেরেম্ভারি চালে বললেন— কেমন সুদিন চাস তোরা?
শাদা শাদা ব্রয়লাররা গাদাগাদি খাঁচাখুঁচির ভেতর থেকে কোনও মতে জবাব দিল— এই খাঁচা থেকে বেরোতে চাই, ঘুরব-ফিরব, দেখব-শুনব। তবে জবাই হতে নয়। অন্যরাও সব একবাক্যে বলল— পৃথিবীটা ভেজ হয়ে যাক না! আমরা কেউই জবাই হতে চাই না।
চন্টিক্লিয়ার বললেন— তবে তাই হোক। তথাস্তু। বলে তিনি ঘুমোতে লাগলেন। প্রশ্নোত্তর পর্ব বেশি ক্ষণ চলতে দিলে সমূহ বিপদ। কেননা, তিনি কিছুই জানেন না, খালি একটা আঁচ পান।
তবে, মহাত্মার কথা ফলতে দেরি হল না। হঠাৎ কথা নেই, বার্তা নেই, মুরগি চালান বন্ধ হয়ে গেল, রফতানি তো বটেই। দেশেও ভ্যান ভ্যান মুরগি-গাড়ি আর দেখা যায় না। মহাত্মা ঘাড় নিচু করে বললেন— কী? কী বলেছিলুম্ম্ম্।
ব্যাপারটা শুরু হল ইন্দোনেশিয়ার মস্ত খামারু সুধন্যপুত্রর লট-কে-লট বাছা বাছা মুরগি ইয়োরোপ থেকে ফেরত আসা দিয়ে। বললে— রুগ্ন পাখি দিয়েছ। সব চোখ লাল, ঘুষঘুষে জ্বর। তোমাদের সঙ্গে পাখি রফতানির চুক্তি খতম। অবাক কাণ্ড—পাঠালুম তাজা পদ্মের কলি! কোন কালো ঝড় আসিল রে, পড়িয়াছে ঢলি? সেই একই বৃত্তান্ত সব রফতানিকারদের। কোনও ভেট ধরতে পারে না। শেষে সব দাদার দাদা বড়দারা বলে পাঠালেন, এ হল গিয়ে বার্ড রোজিওলা। এক রকমের মারাত্মক মিজ্ল্স্, যাকে বাংলায় বলে হাম। খুব সম্ভব যাযাবর পাখি থেকে এসেছে। বন্য প্রাণী থেকে গৃহপালিততে? আসে না তো কখনও! হাঁ করে থাকে খামারুগণ। বড়দা ধমকে বলেন— এসেছে, আবার আসে না কী? আফ্রিকা থেকে এডস আসেনি? ইণ্ডিয়া থেকে ম্যালেরিয়া আসেনি? দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ফ্লু আসেনি? মানুষের ছোঁয়াচ লাগবে। আটচল্লিশ থেকে বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে মানুষ মারা যেতে পারে বাপ! ফুসফাস জ্বর, চোখ দুটি লাল, খিঁচুনি। ভাইরাস এইচ এন আর-থার্টিন এর নাম।
রাতভর ল্যাবরেটরিতে জেগে যুক্তরাষ্ট্রের সেজ ওষুধ কোম্পানির মেজ কেমিস্ট সদ্য-ভোরে বাইরে এসে আড়মোড়া ভেঙে একটা মস্ত হাই তুললেন। কাছেপিঠে কেউ নেই, তবু তিনি অর্থাৎ মি: পিটারসন শূন্যের দিকে মুখ তুলে কাকে যেন বললেন, ‘এক্সকিউজ মি প্লিজ’। কী অর্থে বললেন, কিছুই বোঝা গেল না। তবে, পিটারসনের মুখে একটি জয়মাল্য হাসি, সেই সঙ্গে কেমন একটা অদ্ভুতুড়ে ছায়া। সব মিলিয়ে তাঁকে ঠিক বোঝা গেল না।
কাঁটায় কাঁটায় এগারোটায় জরুরি মিটিং। সেজ কেমিস্ট লক্ষণীয় ভাবে অনুপস্থিত। ‘কী ব্যাপার, পিটারসন আসেনি কেন?’ ম্যানেজিং ডিরেক্টর জিজ্ঞেস করলেন চিফ কেমিস্টকে। তিনি সেলফোনে যোগাযোগ করলেন। কিছুক্ষণ ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ বাজার পর ঘোঁত করে পিটারসন বললেন, ‘ডান।’ তার পরে তাঁর নাসিকাগর্জন এবং সেলফোন অফ। চিফ কেমিস্ট বললেন এম ডি-কে। এম ডি বললেন মার্কেটিং ম্যানেজারকে। তিনি বললেন আর সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে।—ডান। একটা চাপা আহ্লাদ ঘুরতে লাগল মুখ থেকে মুখে।
ব্যবসা মানেই লাভ-লোকসান। হয় কাঁটা ওপরে, নয় নীচে। কাঁটাটা একটা সভ্যভব্য জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে থাকলে ব্যবসাদার খুশি। স্টেডি প্রফিট। কিন্তু, দিন বদলায়, এখন ঠ্যালার নাম বাবাজীবন। বাজার অনুভূমিক যাচ্ছে, অনুভূমিক যাচ্ছে। অমনি সব নতুন কায়দা, নতুন আইডিয়ার আঁক কষা শুরু হয়ে গেল। আইডিয়া এসেছে, এ বার লাভ উল্লম্ব হবে। যাক। এখন ইন্টারন্যাশনাল ড্রাগ অ্যাণ্ড মেডিসিন কন্ট্রোল বোর্ডের কাজটুকু ভালয় ভালয় হয়ে গেলেই সব দিক থাকে।
দীনবন্ধু পাখিরা শুনে অবাক। তার আপিসে আন্তর্জাতিক ওষুধ কোম্পানির এক সাহেব নিজে এসেছেন, সঙ্গে ভেটরিনারি, ইন্সপেকশন করবেন। নালিশ এসেছে: রুগ্ন পাখি পাঠাচ্ছে তৃতীয় দুনিয়া, সেল বন্ধ করে দিচ্ছে। রফতানি বন্ধ। সবে রফতানিটা ধরেছিল দীনবন্ধু। তার কাজ-কারবার যাকে বলে নিয়মমাফিক। সে ঘাবড়ায় না। করো বাবা, ইনিসপেকশন করো। এ অঞ্চলের সব চেয়ে বড় পোলট্রি পাখিরার, তার দেখাদেখি আরও কত ছেলে-ছোকরা সেল্ফ এমপ্লয় করছে ব্যাংক লোন নিয়ে।
সাহেব একটা পাখিকে প্যাখনা ধরে তুলে বললে, এই তো!
ভেট বললে— শিওর!
—কী শিওর? কীসের শিওর? দীনবন্ধু শুধোয়।
—যা সন্দেহ করেছিলুম। বার্ড রোজিওলা। বিপজ্জনক পাখি-মড়ক। পাখি ছেড়ে মানুষকেও ধরবে…বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে ফুসফাস জ্বর, চক্ষু লাল। একেবারে ফেটাল।
—বলেন কী? এ তো সব আলাদা করে রেখেছি! একে আমরা বলি, রানিখেত রোগ। ঝিমোয়, চোখ লাল, চুনের মতো পায়খানা করে। ওই যে চিমনি দেখছেন, ওইখানে এগুলি পুড়িয়ে দিই।
—উঁহু, এ সব বার্ড রোজিওলা। ম্যাড কাউ ডিজিজ শুনেছেন তো? ইংল্যাণ্ডে দেখা দিয়েছিল, মানুষের মধ্যেও ছড়ায়। ওরা অমন গো-খোর জাত— বিফ ছাড়া অচল। এক ধার থেকে সব জবাই করে ফেলেছে— বিফ স্টেক যাদের স্টেপল ফুড, সেই তারা। এও তাই। ডেঞ্জারাস।
পাখিরার মাথায় হাত। তার কারবার ফলাও। চেন আছে মুরগির দোকানের। কেনটাকি ফ্রায়েড চিকেন আসছে। পাখিরা লড়াইয়ে রাজি, প্রস্তুত একেবারে। আপামর জনসাধারণের ঘরে এখন চিকেন বেশ চিকণ ভাবে ঢুকে গেছে। প্রাণীজ প্রোটিন সম্পর্কে লোক এখন দারুণ সচেতন। পাঁঠাকে বলছে রেড মিট। সে ভেগে গেছে। বাজার ধরেছে মুরগি। যখন-তখন দেখবে, মুঠো করে ঠ্যাং বেঁধে মুণ্ডু নীচে করে, সাইকেলের রডে মুরগি বেঁধে ছেলে-ছোকরারা যাচ্ছে। মোড়ে মোড়ে খপাত করে হাত বাড়িয়ে খাঁচার থেকে চাক-বাঁধা এক ঝাঁক পাখি থেকে একটা তুলে নিয়ে, খ্যাঁশ করে গলাটা কেটে পালক ছাড়াতে শুরু করে দিচ্ছে মুরগিঅলা। রক্ত ছিটকোচ্ছে, বাবুরা বিবিরা সব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খোশগল্প করতে করতে কিনছেন। মুরগির মূলধন নিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠেছে সেল্ফ-এমপ্লয়ের ছেলেরা।
সাহেবের ভেট বলে— জানেন না! অন্য অন্য প্রদেশে মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটকে সব রুগ্ন পাখি মেরে ফেলছে। রোগ এ বার এসে গেছে পুবের দেশে। তবে হ্যাঁ, যাদের খুব রোগে ধরেছে তাদের মারুন, আর অন্যদের জন্য ভ্যাকসিন বেরিয়েছে। ওষুধও রেডি। খসখস করে প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন— এই নিন। ভ্যাকসিন…ওষুধ…
প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে পাখিরা বলে—আমরা তো এমনিই ভ্যাকসিন দিই আজ্ঞে। আর ওষুধ তো…
—না, না, এ স্পেশাল ভ্যাকসিন। স্পেশাল ওষুধ। মার্কিন কোম্পানি থেকে সদ্য বেরিয়েছে। কিনে নিন, লোককে বলে দিন। আর…অনেক পাখি মারতে হবে তো, কোম্পানি ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে।
সাহেব একখাম টাকা গুঁজে দিল পাখিরার হাতে। দীনবন্ধু পাখিরা হাঁ করে থাকে। মুরগি মরবে আমার, কমপেনসেট দেবে ওষুধ কোম্পানি? তাজ্জব বটে! এমন বদান্যতা তো ইদানীং-এর মধ্যে…তার পরেই দীনবন্ধু বোঝে। সেও ব্যবসাদার কিনা! ওহ! এই! দীনবন্ধু নিজের রানিখেত মুরগিগুলো যেমন রুটিন মেরে ফেলার, মেরে ফেলে অন্যদের বলে, রোজিওলা— নতুন রোগ এসেছে, সব সাবধান ভাইরা! মুরগি মেরে ফ্যালো, ভ্যাকসিন কেনো, ওষুধ কেনো, মুরগি বাঁচাও।
মুরগির দর হু-হু করে পড়তে লাগল। শেয়ার বাজারের চেয়েও বড় ধস। সব কাগজ খবরটি ধরে নিয়েছে। তৃতীয় দুনিয়ার বেশ পায়া-ভারী মতো হল। তোদের যদি ম্যাড-কাউ থাকে, আমাদেরও তা হলে বার্ড-রোজিওলা আছে! কম যাই না কিছু, আমরাও স্বাস্থ্য-সচেতন, মড়ুকে পাখি খাই না। আমাদের ব্যবসাদারগণও গণস্বাস্থ্যের কথা ভাবেন— মুরগিনিধন যজ্ঞ করেন। তাঁরাও ভ্যাকসিন কেনেন চটপট। ওষুধ কেনেন পটপট। সে সব কিনা রোগ ধরা পড়বার সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভাবিত হয়ে উন্নত দুনিয়া থেকে এসে গেছে!
বোকারাম জিজ্ঞেস করে— রোগ হবার সঙ্গে সঙ্গে ভ্যাকসিন এসে গেল?
হাঁদারাম জিজ্ঞেস করে— হিসেব করে তো দেখা যাচ্ছে, রোগের আগেই ওষুধটি বেরিয়েছে। দোকানে দোকানে বোঝাই স্টক।
তাদের বোকামিতে হাঁদামিতে লোক হা-হা ঠা-ঠা করে হাসল। সরকার দিনরাত ঘোষণা করছে— ভয় নেই, মুরগি সত্তর ডিগ্রি সেলসিয়াসে কুড়ি মিনিট ফুটিয়ে নিয়ে খান। কিচ্ছু হবে না। কে কার কথা শোনে! ৯০ টাকা থেকে ৭০ টাকা, ৭০ টাকা থেকে ৩০ টাকা। চতুর্দিকে মুরগি নিধন হচ্ছে। ছোট ব্যবসাদাররা অল্প দামে ছেড়ে দিচ্ছে। বড় ব্যবসাদাররা কেউ শ’য়ে শ’য়ে হাজারে হাজারে মেরে ফেলছে। কেউ সত্যি সত্যি মারছে, কেউ বলছে কিন্তু মারছে না। সে এক ভজকট কাণ্ড। মহা-মুরগি ভোজ আয়োজিত হল দিকে দিকে। মিনি-মাগনা ভোজ, লোকে কব্জি ডুবিয়ে খেল। মরি মরব, খেয়ে মরব বাবা! সরকারি লোকেরা তদারকি করলেন, কিন্তু কেউ খেলেন না। কেউ বললেন— রাত থেকে চোঁয়া ঢেকুর উঠছে, সুদ্ধু গ্লুকোজের জল খাচ্ছি ভাই। কেউ বললেন— ফুরিয়ে গেছে, খাব কী? জনগণেশ খেলেই আমাদের খাওয়া হল। কেউ আবার মুচকি হেসে বললেন— ভেজ হয়ে গেছি, জানেন না?
তেলিয়া গাঁওয়ের খোন্দকার্স-এ মহাত্মা চন্টিক্লিয়ার বললেন— কেমন, বলেছিলুম্ম্ না? সবাই সায় দেয়।
তার পর এক যজ্ঞি শুরু হল বটে! জবাই-যজ্ঞি। যে মুরগি বিক্রি হচ্ছে না, তার খাতির-যত্ন, খাবারদাবার দিনের পর দিন জুগিয়ে যাওয়াও তো লোকসান! তারাও মারা পড়ছে। দেখেশুনে ঠোঁটটি বুক-পালকের মধ্যে আরও গুঁজড়ে চন্টিবাবু ঘুমিয়ে থাকেন। সরকারি লোকও এখন টহল দিচ্ছে, ডব্লিউ এইচ ও থেকে নাকি সার্কুলার এসে গেছে, আর তো উপেক্ষা করা যায় না।
আরে, এ মোরগটা যে ঝিমোচ্ছে দেখি!
খোন্দকার্স-এর খোন্দকার হাঁ-হাঁ করে ছুটে আসে— ওটি আমার রাজ-মোরগ, মশাই! মাস্টার ব্রিডার। ও সাটিনের বিছানায় ঘুমোয়।…বলতে না বলতেই মহাত্মার ছেঁড়া মুণ্ডুটি লুটিয়ে পড়ে।
সরকারি লোকের পাশে পাশেই রয়েছে সেজ ওষুধ কোম্পানির ভেট। খোন্দকারের হাতে একটি খাম ধরিয়ে দেয়। বলে, মড়ুকে পাখি রাখা ঠিক না। তবু আপনার মাস্টার ব্রিডার বলছেন— কোম্পানি বাহাদুর ক্ষতিপূরণ চালু করেছেন।
খোন্দকারের হাহাকার থামে না— আহা হা হা, আমার অমন মরদ-মস্তান গো! সে মাথা চাপড়াতেই থাকে। চাপড়াতেই থাকে। এবং রোজিওলা যেমন হঠাৎ উদয় হয়েছিল, তেমনই হঠাৎ উবে যায়।
সেজ ওষুধ কোম্পানির মাল্টি-বিলিয়ন ডলার ব্যবসা হয়েছে। উপরন্তু দেশের পোলট্রি লাল হয়ে গেছে। রফতানি মালের সঙ্গে আর পাল্লা দিতে হয়নি। খামারুরা খুশি, জনগণ খুশি, ওষুধ কোম্পানি খুশি, সেনেটর খুশি, প্রেসিডেন্ট খুশি। তাই কোম্পানি মেজ কেমিস্ট পিটারসনকে উপযুক্ত লভ্যাংশ কমিশন দিয়েছে। তাই দিয়ে তিনি এক মস্ত সেলুন-কার কিনেছেন। ফিল্মস্টারদের গাড়ির মতো। ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে হু-হু করে গাড়ি ছোটান পিটারসন। এইটিই তাঁর নেশা। লং ড্রাইভ। গান চালিয়ে দিয়েছেন। গান, বিশেষ করে ক্লাসিক্যাল তাঁর আর এক নেশা। বাজছিল মুনলাইট সোনাটা। হঠাৎ রেকর্ডার পিলে চমকানো চিৎকার করে উঠল, কঁক কঁ কঁ কঁ—
পিটারসন এমন চমকে উঠলেন যে, হাত থেকে স্টিয়ারিং পিছলে গেল। সামনে পিছনে ছিল দুটি ট্রাক। মোক্ষম ধাক্কা। ঘটনা-শেষে চ্যাপ্টা পিটারসনকে আর চেনা যায় না। অবাক কাণ্ড— ওস্তাদ ড্রাইভার, পেটে অ্যালকোহল নেই, খামোকা এত অ্যান্টি-অ্যাকসিডেন্ট ব্যবস্থা থাকা গাড়ির এমন দশা! এ যে দ্বিতীয় টাইটানিক! শুকনো ডাঙায় আছাড়!
পাখির পরলোক আর মানুষের পরলোক যে এক, তা তো সাহেবের জানা ছিল না! কোটি কোটি মুরগির প্রেতাত্মার সামনে যতই পিটারসনের প্রেতাত্মা জোড়হাত করে, মুরগি-ভূতেরা তাকে ঠুকরে ঠুকরে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা দিচ্ছে। বলছে— ব্যাটা, আমাদের মুরগি করলি কেন? কেন? বলল্ল!
পিটারসন তখন বুঝিয়ে বলে— আহা, তোমাদের তো ঈশ্বরই মুরগি করে পাঠিয়েছেন, ভাইবোনেরা। আমি করব কী? মুরগি করেছি ওই ওদের, দ্যাখো!
চন্টিক্লিয়ার-সহ তাবৎ মুরগিকুল গলা নিচু করে দেখলে, পুরো তৃতীয় দুনিয়া ঝুঁটি-ফোলানো ঝালর-দোলানো প্রথম দুনিয়ার পেছন পেছন কঁক কঁক করতে করতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।